আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস আজ

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে ৪টি মানদণ্ড নির্ধারণ করেছেন। চারটি মানদণ্ড হচ্ছে- স্মার্ট সিটিজেন অর্থাৎ প্রতিটি নাগরিক প্রযুক্তি ব্যবহারে দক্ষ হবে; স্মার্ট ইকোনমি অর্থাৎ অর্থনীতির সব কার্যক্রমে প্রযুক্তি ব্যবহার করা হবে; স্মার্ট গভর্নমেন্ট এবং স্মার্ট সোসাইটি। স্মার্ট সোসাইটি বা সমাজের জন্য যা দরকার- তা ‘ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী’র কাছে পৌঁছায়নি। বৈশ্বিক মহামারি কোভিড-১৯ পরবর্তী সময়ে ‘ইনডিজিনাস পিপলস ডেভেলপমেণ্ট সার্ভিসেস’ গবেষণা অনুযায়ী ৯২ শতাংশ নৃ-গোষ্ঠীর মানুষের আয় কমে গেছে। নতুন করে দারিদ্র্যসীমার নিচে যুক্ত হয়েছে পাঁচ লাখ মানুষ। এখন জাতীয় দারিদ্র্যসীমার হার ২১ শতাংশে। আর চরম দারিদ্র্যসীমার হার ১১ শতাংশের নিচে; কিন্তু ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর মধ্যে দারিদ্র্যসীমার এই হার পার্বত্য চট্টগ্রামে ৬৫ শতাংশ এবং সমতলে ৮০ শতাংশ। দেশের জাতীয় গড় আয় বাড়লেও তাদের আয় এখনো বাড়েনি। বিগত ১১ বছরে তাদের ওপর ৪৬০টি সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে। স্মার্ট গর্ভমেন্ট বা বিচার ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীকে স্মার্ট বাংলাদেশের স্মার্ট নাগরিক গড়ার দাবি ওঠেছে সর্বত্র। আজ ৯ আগস্ট, আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবসে আত্ম-নিয়ন্ত্রণ অধিকারসহ ১২ দফা দাবি জানিয়েছেন পাহাড়ি ও সমতলের নৃ-গোষ্ঠী।

জাতিসংঘ এ বছরের থিম নির্ধারণ করেছে- ‘আত্ম-নিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে আদিবাসী তরুণরাই মূল শক্তি।’ জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস তার বাণীতে বলেছেন, বিশ্বজুড়ে আদিবাসী জনগণ কঠিন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করছে, তাদের ভূমি ও সম্পদের অধিকার হুমকির মুখে পতিত, তাদের অধিকার অবদমিত এবং তারা ক্রমাগতবিপন্নতা, প্রান্তিকতা ও বঞ্চনার শিকার। তবে

আদিবাসী তরুণরা অধিকার ফিরে পাওয়ার সংগ্রাম করছে। বৈশ্বিক জলবায়ু কর্মসূচি আন্দোলনের তারা নেতৃত্ব দিচ্ছে। তরুণরা ন্যায্যতা ও সাম্যের জন্য এডভোকেসি করছে। তারা নিজস্ব সংস্কৃতি সংরক্ষণ ও উদযাপন, মানবাধিকারকে এগিয়ে নেয়া এবং আদিবাসী ইতিহাস ও ইস্যু সম্পর্কে বিশ্বব্যাপী সচেতনতা সৃষ্টির কাজ করছে।

মূলত জাতিসংঘ ১৯৯৪ সাল থেকে বিশ্বব্যাপী পালন করে আসছে এই দিবসটি। বাংলাদেশে ২০০৪ থেকে পালিত হয়ে আসছে। মূলত ২০০১ সালে বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম গঠিত হওয়ার পরে বেসরকারিভাবে বৃহৎকারে আন্তর্জাতিক দিবসটি পালিত হচ্ছে। বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের রাজশাহী ও রংপুর বিভাগের জেলা রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, পাবনা, সিরাজগঞ্জ, বগুড়া, জয়পুরহাট, নাটোর, নওগাঁ, রংপুর, দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁও, গাইবান্ধা প্রভৃতি জেলায় সাঁওতাল, শিং (গঞ্জু), ওঁরাও, মুন্ডারি, বেদিয়া মাহাতো, রাজোয়ার, কর্মকার, তেলী, তুরী, ভুইমালী, কোল, কড়া, রাজবংশী, মাল পাহাড়িয়া, মাহালী জাতিগোষ্ঠী বসবাস করছে। অন্যদিকে পার্বত্য চট্টগ্রামে (রাঙ্গামাটি, বান্দরবান ও খাগড়াছড়ি) চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, তঞ্চঙ্গ্যা, মুরং বা ম্রো, খিয়াং, লুসাই, পাংখোয়া,বম, খুমী ও চাক জনগোষ্ঠী বসবাস করছে। বাংলাদেশের ৪০ লাখ আদিবাসী তাদের নিজস্ব সাংস্কৃতিক পরিচয়, ভূমির অধিকার ও নাগরিক মর্যাদার স্বীকৃতি দাবিতে দিবসটি উদ্যাপন করে থাকেন।

আদিবাসী না ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী : বাংলাদেশ সরকার সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে দেশের আদিবাসীদের ক্ষুদ্র নৃ- গোষ্ঠী, সম্প্রদায় বা উপজাতি হিসেবে আখ্যায়িত করলেও বাংলাদেশের এই জনজাতি নিজেদের আদিবাসী হিসেবে পরিচয় দিতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। সরকারের সংশ্লিষ্টরা বলছেন, যাদের আদিবাসী বলা হচ্ছে, তারা এখানকার আদি বাসিন্দা নয়। তারা হচ্ছে, এ ভূখণ্ডের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী। সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী (বর্তমান শিক্ষামন্ত্রী) ডা. দীপু মনি ২০১১ সালে ঢাকায় বিদেশি কূটনীতিকদের আহ্বান জানিয়েছিলেন পার্বত্য চট্টগ্রামের ‘ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীর’ জনগণকে যেন ‘আদিবাসী’ বলা না হয়। সরকারের অবস্থান হচ্ছে, এখানকার মানুষের ইতিহাস ও সংস্কৃতি ৪ হাজার বছরের পুরনো।

প্রত্মতাত্ত্বিক গবেষণা সেটিই প্রমাণ করে। কিন্তু পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মানুষ মিয়ানমার এবং কম্বোডিয়া থেকে আসা শুরু করে। সেজন্য তারা এখানকার আদিবাসী নয়। অন্যদিকে ১৯৯৭ সালে সম্পাদিত শান্তিচুক্তিতেও পার্বত্য চট্টগ্রামকে ‘উপজাতি অধ্যুষ্যিত অঞ্চল’ হিসেবে বর্ণনা করা হয়। আর জাতিসংঘের কোনো দলিলেও ‘আদিবাসী’ বিষয়ে সর্বসম্মত সংজ্ঞা নেই। ২০০৭ সালে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৬১তম অধিবেশনে আদিবাসী জনগোষ্ঠীর অধিকার নিয়ে একটি ঘোষণাপত্র অনুমোদিত হয়। এতে ১২টি ক্ষেত্রে আদিবাসীদের অধিকারকে স্বীকৃতি দেয়া হয়। বিশেষ করে ভূমি সংক্রান্ত অধিকারগুলোই ছিল মুখ্য। ঘোষণাপত্রে- ভূমি ও ভূখণ্ডের অধিকার; আদিবাসী জনগোষ্ঠীর ভূমি ও ভূখণ্ডের ওপর সামরিক কার্যক্রম বন্ধের অধিকার; তাদের ভূমি থেকে জোরপূর্বক উচ্ছেদ প্রক্রিয়া থেকে রেহাই পাওয়ার অধিকার এবং তাদের সম্মতি ছাড়া যেসব ভূমি, ভূখণ্ড এবং সম্পদ ছিনিয়ে নেয়া হয়েছে- সেগুলো পুনরুদ্ধার ও ফেরত পাওয়ার অধিকারের কথা বলা হয়।

প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে পেছনে রেখে স্মার্ট বাংলাদেশ অসম্ভব : গবেষকদের মতে, বাংলাদেশের ৪০ লাখ আদিবাসী জনগণ এখন এক কঠিন সংকট ও অনিশ্চয়তার মধ্যে দিন কাটাতে বাধ্য হচ্ছে। আদিবাসীদের ঐতিহ্যগত ও প্রথাগত ভূমি থেকে ক্রমাগত তারা উচ্ছেদের মুখোমুখি হচ্ছে। ভূমি, বন ও প্রাকৃতিক সম্পদের চিরায়ত অধিকার থেকে আদিবাসীরা বঞ্চিত হচ্ছে। আদিবাসীদের বঞ্চিত রেখে আগামীর স্মার্ট বাংলাদেশ সম্ভব নয়।

জানতে চাইলে ইতিহাসবিদ, গবেষক অধ্যাপক ড. মেসবাহ কামাল ভোরের কাগজকে বলেন, আত্মস্বীকৃতি না পাওয়া বড় সমস্যা। ভূমি থেকে ক্রমাগত অধিকার হারাচ্ছে। সংস্কৃতি ও স্বতন্ত্রতা হারাচ্ছে। জীবন ধারণ কষ্টকর হয়ে দাঁড়িয়েছে। তিনি বলেন, স্মার্ট বাংলাদেশের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে- এর বৃহত্তর লক্ষ্য রয়েছে। এর অন্যতম উদ্দেশ্য এসডিজি অর্জন। এসডিজি পূরণের মূলকথা হলো- কাউকে পেছনে রেখে উন্নয়ন অসম্ভব। প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে পেছনে রেখে এসডিজি অর্জিত হবে না। আর এতে স্মার্ট বাংলাদেশ সম্ভব নয়।

এ ব্যাপারে বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সাধারণ সম্পাদক সঞ্জীব দ্রং ভোরের কাগজকে বলেন, ভূমি সমস্যা সবচেয়ে বড় সমস্যা। ভূমির অধিকার নেই। আদিবাসী জনগোষ্ঠীর বড় অংশ পাহাড়ে ও বনে বাস করে। ঐতিহ্যগতভাবে তারা যে ভূমি অধিকার পেয়ে আসছে, আন্তর্জাতিকভাবে এটি স্বীকৃত হলেও রাষ্ট্রীয়ভাবে এর স্বীকৃতি নেই। ফলে কখনো ইকোপার্ক, কখনো বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের কারণে তারা হারায়। অন্যদিকে সমানতালে অর্থনৈতিকভাবে এগিয়ে যেতে পারছে না। ফলে এদের জন্য সরকারের বিশেষ ব্যবস্থা নেয়া প্রয়োজন। বাংলাদেশে আদিবাসী জনগোষ্ঠীর মধ্যে ৩৯টি ভাষা পাওয়া গেছে। এর মধ্যে অনেক বিলুপ্তির পথে। ভাষাগুলো রক্ষা করা প্রয়োজন।

১২ দফা দাবি : আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস উপলক্ষে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে সমাবেশ করবে বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম। সমাবেশে ১২ দফা দাবি তুলে ধরা হবে। দাবিগুলো হচ্ছে- আত্ম-নিয়ন্ত্রণ অধিকারসহ আদিবাসীদের সাংবিধানিক স্বীকৃতি দেয়া, রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক ও ভূমির অধিকার নিশ্চিত করা, আদিবাসী তরুণ সমাজের নেতৃত্ব বিকাশ, প্রশিক্ষণ, শিক্ষা, উন্নয়ন ও অগ্রগতির জন্য বিশেষ পদক্ষেপ নেয়া, আদিবাসী ইস্যুতে অন্যান্য দেশের মতো সরকার, জাতিসংঘ ও আদিবাসী জনগণ- এই ত্রিপক্ষীয় সংলাপের জন্য উৎসাহ ও প্রণোদনা দেয়া, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করা, সমতল অঞ্চলের আদিবাসীদের জন্য পৃথক মন্ত্রণালয় ও ভূমি কমিশন গঠন, আদিবাসীদের ভূমিতে তাদের স্বাধীন সম্মতি ছাড়া ইকোপার্ক, সামাজিক বনায়ন, ট্যুরিজম, ইপিজেড বা অন্য কোনো প্রকল্প গ্রহণ না করা, আদিবাসীদের ওপর সব নিপীড়ন, নির্যাতন ও হয়রানি বন্ধ করাসহ সব মিথ্যা মামলা অবিলম্বে প্রত্যাহার করা, জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে ২০০৭ সালে গৃহীত আদিবাসী বিষয়ক ঘোষণাপত্র ও আইএলও ১৬৯ নম্বর কনভেনশন অনুসমর্থন ও আইএলও কনভেনশন-১০৭ বাস্তবায়ন করা, জাতীয় সংসদে আদিবাসীদের জন্য বিশেষ কোটা সংরক্ষণ বা আসন বরাদ্দ রাখা, সরকারি প্রথম শ্রেণিতে আগের মতো আদিবাসী কোটা সংরক্ষণ করা, অন্যান্য চাকরিসহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি কোটা যথাযথ বাস্তবায়ন করা এবং রাষ্ট্রীয়ভাবে আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস উদযাপন করা।