আগামী জুলাই মাস থেকে উঠে যাচ্ছে ব্যাংকঋণের সুদহারের সীমা। এখন সর্বোচ্চ ৯ শতাংশের যে সীমা নির্ধারিত আছে, তা আর থাকছে না। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) শর্ত মেনে এই সুদহার বাজারভিত্তিক করবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তাতে ঋণের সুদহার দুই অঙ্কে (ডাবল ডিজিট) গড়াবে।
এতে ব্যবসার প্রতিযোগিতা সক্ষমতা কমে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন ব্যবসায়ীরা।
ব্যাংকঋণের সুদহার নির্ধারণ হবে ছয় মাস মেয়াদি ট্রেজারি বিলের সঙ্গে সম্পর্ক রেখে। ট্রেজারি বিলের সুদহারের সঙ্গে অতিরিক্ত ৩ শতাংশ পর্যন্ত যোগ করা যাবে। এখন ছয় মাস মেয়াদি ট্রেজারি বিলের সুদহার ৬.৯৯। ফলে এখনকার হিসাবে ঋণের সুদ হতে পারে সর্বোচ্চ ১০ শতাংশ। তবে ব্যাংকঋণের সুদের সর্বোচ্চ হার কত হবে, বাংলাদেশ ব্যাংক তা প্রতি মাসে নির্ধারণ করে ঘোষণা করবে। এ হার ঠিক করার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংক তার নির্ধারিত সূত্র অনুসরণ করবে। নতুন এই ব্যবস্থা কার্যকর হবে জুলাই মাস থেকে। এর নাম দেওয়া হয়েছে ‘শর্টটার্ম মান্থলি অ্যাভারেজ রেট’ বা স্মার্ট।
গতকাল রোববার বাংলাদেশ ব্যাংকে অনুষ্ঠিত ব্যাংকার্স সভায় আলোচনার পর এই সিদ্ধান্তের কথা জানানো হয়েছে। তবে বলা হয়েছে, কেন্দ্রীয় ব্যাংক আরো পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে। পাশাপাশি ভোক্তা ঋণে সর্বোচ্চ সুদহার কত হবে, তা-ও নির্ধারণ করে দেওয়া হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদারের সভাপতিত্বে সভায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর, প্রধান অর্থনীতিবিদসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) চেয়ারম্যান ও ব্র্যাক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) সেলিম আর এফ হোসেনের নেতৃত্বে সব বাণিজ্যিক ব্যাংকের এমডিরা সভায় উপস্থিত ছিলেন।
বৈঠক শেষে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক মেজবাউল হক বলেন, ‘ট্রেজারি বিলের ছয় মাসে সুদের সঙ্গে আরো ৩ শতাংশ স্প্রেড যোগ করা হলে ব্যাংকের সুদের হার নির্ধারিত হবে। ’
অর্থনীতিবিদরা ঋণ ও আমানতের সুদহার বাড়ানোর সুপারিশ অনেক দিন ধরেই করে আসছেন। তাঁদের যুক্তি, এতে মূল্যস্ফীতির চাপ কিছুটা কমানো যাবে। এরই মধ্যে মূল্যস্ফীতির চাপ সামলাতে তিনবার নীতি সুদহার বাড়িয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক; কিন্তু ব্যাংকঋণের সুদহার না বাড়িয়ে শুধু রেপোর সুদহার বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতির লাগাম টেনে ধরার পদক্ষেপ কতটা কাজে লাগছে, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে অর্থনীতিবিদদের।
এ ছাড়া আইএমএফ বাংলাদেশের জন্য যে ৪৭০ কোটি ডলারের ঋণ অনুমোদন করেছে, তাতে এসব সংস্কার আনার শর্ত দেওয়া হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ ব্যাংক আগামী জুলাইয়ের মধ্যে একটি সুদহার করিডর ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। সুদহার করিডর এমন একটি ব্যবস্থা, যার মাধ্যমে সুদহারের বেঁধে দেওয়া সীমা ধীরে ধীরে তুলে নেওয়া ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতি সুদহারে পরিচালনভিত্তিক পরিবর্তন করা যায়। ২০২০ সালের এপ্রিল থেকে ব্যাংক খাতে সুদের হার ঋণে সর্বোচ্চ ৯ শতাংশ কার্যকর আছে। তবে আমানতের সুদহারের সীমা তুলে নিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
কার্যকর হবে জুলাই থেকে
কেন্দ্রীয় ব্যাংক সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে ছয় মাস মেয়াদি ট্রেজারি বিলের সুদের হারের সঙ্গে ৩ শতাংশ যুক্ত করে যে সুদ হয়, তা নিতে পারবে ব্যাংকগুলো। ব্যাংকার্স সভায় জানানো হয়, প্রতি মাসে ট্রেজারি বিলের একাধিকবার নিলাম হয়। ফলে এর সুদের হারের ওপর ভিত্তি করে একটা গড় হার নির্ধারণ করা হবে। যদি ট্রেজারি বিলের সুদহার কমে যায়, তবে অতিরিক্ত হার বাড়িয়ে সুদের হার বাজারের সঙ্গে সমন্বয় করা হবে। বাংলাদেশ ব্যাংক প্রতি মাসে গড় সুদহার কত হবে, তা নির্ধারণ করে জানিয়ে দেবে। পাশাপাশি ছয় মাস মেয়াদি গড় সুদহারও জানাবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। আগামী জুনে যে মুদ্রানীতি দেওয়া হবে, তাতে এ নিয়ে বিস্তারিত ঘোষণা থাকবে। এটি কার্যকর হবে জুলাই থেকে।
ব্যবসায়ীরা যা বলছেন
তবে ব্যাংক খাতে ঋণের সুদ হার সর্ব্বোচ্চ ৯ শতাংশ তুলে নেওয়ার বিরোধিতা করেছেন ব্যবসায়ীরা। ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) সভাপতি ব্যারিস্টার মো. সামীর সাত্তার গণমাধ্যমকে বলেন, ‘ঋণের সুদহারের সীমা উঠে গেলে ব্যবসার ব্যয় আরো বেড়ে যাবে, আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতা সক্ষমতা কমে যাবে। যাঁরা নতুন ঋণ নিয়ে ব্যবসা করতে চান কিংবা যাঁরা কারখানা সম্প্রসারণ করতে চান তাঁরা নিরুৎসাহিত হবেন। এতে বেসরকারি খাতে অভ্যন্তরীণ ঋণের চাহিদা কমবে। বিনিয়োগে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। সবচেয়ে বেশি সমস্যা হবে যাঁরা বড় অঙ্কের ঋণ নিয়েছেন তাঁদের ঋণের খরচ বেড়ে যাবে। ’ এই ব্যবসায়ী নেতা বলেন, ‘করোনার পর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের নেতিবাক প্রভাব পড়েছে ব্যবসায়। এর সঙ্গে গ্যাস-বিদ্যুৎ, জ্বালানিসহ সব কিছুর দাম বেড়ে গেছে। ঠিক এমন সংকটের মধ্যে আবার যদি ঋণের সুদহার বেড়ে যায়, তাহলে ব্যবসা টিকিয়ে রাখা কঠিন হয়ে পড়বে। ’
হুন্ডি রোধে ব্যবস্থা
রেমিট্যান্স বাড়াতে বাংলাদেশ ব্যাংক ও বাংলাদেশ ফিন্যানশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) বেশ কিছু উদ্যোগ নিয়েছে। এ ছাড়া হুন্ডির চাহিদা কমানোর দিকে মনোযোগ দিচ্ছে আর্থিক খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা। কোনো ব্যাংক যদি ডলার ক্রয়ের ক্ষেত্রে অনিয়ম করে তাহলে বাংলাদেশ ব্যাংক যথাযথ ব্যবস্থা নেবে বলে সাংবাদিকদের জানিয়েছেন মেজবাউল হক। তিনি বলেন, ‘বিএফআইইউ ও বাংলাদেশ ব্যাংক বিভিন্ন উদ্যোগের পরে রেমিট্যান্স বেড়েছে। একই সময়ে আমরা হুন্ডির চাহিদা কমানোর দিকে মনোযোগ দিচ্ছি। হুন্ডির চাহিদা আন্ডার ইনভয়েসিং থেকে তৈরি হয়। আমরা যদি আন্ডার ইনভয়েসিং ও ওভার ইনভয়েসিং নিয়ন্ত্রণ করতে পারি তাহলে আমরা হুন্ডির চাহিদা কমাতে পারব। ’ তিনি বলেন, ‘হুন্ডি যে করছে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছি। একই সময়ে এর চাহিদা কমানোর চেষ্টা করছি। এদিকে রেমিট্যান্সের ক্ষেত্রে বাফেদার নির্ধারিত একটি দর আছে। আমরা ব্যাংকগুলোকে বলেছি, নির্ধারিত এই দামেই যেন রেমিট্যান্সের ডলার ক্রয় করে। তবে কোনো ব্যাংক যদি ডলার ক্রয়ের ক্ষেত্রে অনিয়ম করে তাহলে বাংলাদেশ ব্যাংক যথাযথ ব্যবস্থা নেবে। ’
আলোচনায় খেলাপি ঋণ
ব্যাংকার্স সভায় খেলাপি ঋণ আদায়ে ব্যাংকগুলোকে বলা হয়েছে। যাতে লক্ষ্যমাত্রার মধ্যে খেলাপি ঋণ রাখা যায়। আইনি কাঠামোর মধ্য থেকে ব্যাংকগুলো যাতে খেলাপি ঋণ আদায়ে উদ্যোগী হয়, সে বিষয়ে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
অর্থঋণ আদালতের মামলার বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র বলেন, ‘মামলা নিষ্পত্তি দীর্ঘমেয়াদি প্রক্রিয়া। আমাদের আইন বিভাগের মাধ্যমেও মামলাগুলো তদারকি করা হচ্ছে। সে ক্ষেত্রে একটা পরিসংখ্যান উপস্থাপন করা হয়েছে। প্রায় ১৪ হাজার মামলা নিষ্পত্তি করা হয়েছে। তবে আবার হয়তো ১২ থেকে ১৩ হাজার মামলা নতুন করে যোগ হয়েছে। তবে মামলা নিষ্পত্তির গতি বাড়ানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। ’ তিনি আরও বলেন, ‘অর্থঋণ আদালতে ব্যাংকগুলোর মামলায় খেলাপিদের দায়ের পরিমাণ ছিল ৮২ হাজার কোটি টাকা; কিন্ত মামলাগুলো নিষ্পত্তি হয়ে গেছে, তবে ব্যাংকগুলো আদায় করতে পেরেছে ২১ হাজার কোটি টাকা। মামলার রায় পেলেও সম্পদ বিক্রিসহ অন্যান্য কার্যক্রম শেষ করতে দীর্ঘমেয়াদি সময় প্রয়োজন। আইনি জটিলতা থাকায় এসব কাজে অনেক সময় লাগে। তাই মামলা নিষ্পত্তি ও আদায়ের মধ্যে বড় একটি ব্যবধান থাকে। ’
রপ্তানি মূল্যও পরীক্ষা হবে
সভায় বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে জানানো হয়, আগে যে পণ্য আনতে সাড়ে আট বিলিয়ন ডলার খরচ হচ্ছিল, এখন সাড়ে পাঁচ বিলিয়ন ডলার দিয়েই এসব পণ্যের ঋণপত্র খোলা যাচ্ছে। আমদানি পণ্যের মূল্য পরীক্ষা করায় ডলার খরচ কমে আসছে। বেশি ডলার খরচ করে পণ্য আনা কমে গেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক এখন ৩০ লাখ ডলারের বেশি ঋণপত্রের মূল্য যাচাই করে অনুমোদন দিচ্ছে। পাশাপাশি বিভিন্ন ঋণপত্রের মূল্য আগের চেয়ে বেশি যাচাই-বাছাই করছে। অপ্রয়োজনীয় আমদানির অনুমোদন দিচ্ছে না। ফলে ঋণপত্র খোলা কমে গেছে। এখন যেসব পণ্য রপ্তানি হচ্ছে, তার সঠিক মূল্য নির্ধারণ করা হচ্ছে কি না, তা তদারকি শুরু করবে বাংলাদেশ ব্যাংক। এতে রপ্তানির আড়ালে অর্থপাচার কমে আসবে। ফলে প্রবাস আয়ে যে হুন্ডি প্রথা আছে, তা-ও কমে আসবে বলে মনে করছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
এবিবি ও বাফেদা রেমিট্যান্সের দর ১০৭ টাকা নির্ধারণ করেছে। এই রেট মেনেই সব ব্যাংকে রেমিট্যান্স নিয়ে আসার নির্দেশনা থাকলেও ১২টি ব্যাংক অতিরিক্ত টাকা দিয়ে রেমিট্যান্স আনছে। ফল ব্যাংকগুলোর ফরেক্স রিজার্ভ বাড়ানোর জন্যই নির্ধারিত দরের চেয়ে বেশি দরে রেমিট্যান্স আনছে। সভায় এই ধরনের কার্যক্রম থেকে বিরত থাকতে ব্যাংকগুলোকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। রেমিট্যান্স সংগ্রহের ক্ষেত্রে যেসব ব্যাংক অতিরিক্তি দরে ডলার নিয়েছে সেসব ব্যাংকে অডিট করবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।