জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে (জাবি) বর্ণিল আয়োজনে অনুষ্ঠিত হয়ে গেল প্রজাপতি মেলা-২০২৪। ‘উড়লে আকাশে প্রজাপতি, প্রকৃতি পায় নতুন গতি’-এ স্লোগানকে সামনে রেখে সংরক্ষণ ও গণসচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে শুক্রবার ( ৬ ডিসেম্বর) সকাল সাড়ে ৯টায় মেলার ১৪তম আসরের উদ্বোধন করেন উপাচার্য অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ কামরুল আহসান।
সকাল থেকেই রঙিন প্রজাপতির ওড়াউড়ি দেখতে মেলায় ভিড় জমান দর্শনার্থীরা। শিশু-কিশোরেরা পাহাড় সমান আগ্রহ নানা রঙের ফেস্টুন হাতে, কেউ কেউ বিভিন্ন প্রতিকৃতির মুখোশ পড়ে এদিক-সেদিক ঘোরাঘুরি করছিলেন। কারও গালে হাসছে হাতে আঁকা প্রজাপতির রঙিন প্রতিচ্ছবি। আর তরুণ-তরুণীরা এসেছিলেন পাঞ্জাবি–শাড়ি পরে।
জহির রায়হান মিলনায়তনের সামনে এবং বোটানিক্যাল গার্ডেনে সাদা ও সবুজ রঙের জাল দিয়ে ঘেরা ছোট্ট ঘর বিভিন্ন প্রজাতির ফুলের গাছ রাখা। সেগুলোর শাখায় শাখায়, ফুলের পাপড়িতে গিয়ে বসছে বাহারী ডানার প্রজাপতিগুলো। পাশে ভিড় জমিয়েছে শিশু-কিশোর, তরুণ-তরুণীসহ নানা বয়সী মানুষ। শিশুদের কেউ কেউ ছুঁয়ে দেখতে চায় প্রজাপতির রঙিন ডানা।
গোলাপি জামায় সাদা রঙের প্রজাপতির মেকি ডানা পরে মায়ের সঙ্গে মেলায় এসেছিলো ছোট্ট ইনশিয়া শেখ রীতি ও তার ছোট বোন। প্রজাপতি ছুঁয়ে দেখেছে কিনা জিজ্ঞেস করলে সে জানায়, ‘আমি প্রজাপতির ডানা হাত দিয়ে ছুঁইনি। কারণ প্রজাপতির ডানা অনেক নরম। হাত ফিয়ে ধরলে যদি ডানা ভেঙ্গে যায়, তাহলে প্রজাপতিটা আর উড়তে পারবে না।’ প্রজাপতির প্রতি ছোট্ট শিশুর এমন ভালোবাসা দেখে রীতিমতো মুগ্ধ হতে হয়।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ছবি চত্ত্বরে সবুজ, লাল ফিতা দিয়ে ঘেরা জায়গায় বিভিন গাছে প্রজাপতির দৃশ্য সম্বলিত ছবি ঝুলিয়ে দিয়ে প্রদর্শনীর ব্যবস্থা ছিলো। সেখানে ঘুরে ঘুরে ছবিগুলো দেখছিলেন উৎসুক প্রকৃতি প্রেমীরা। কেউ কেউ তুলছিলেন নানা ভঙ্গিতে ছবি।
মেলা উপলক্ষে প্রজাপতি পার্ক ও গবেষণা কেন্দ্র জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়। দিনব্যাপী সেখানে জীবন্ত প্রজাপতি, প্রজাপতিবান্ধব বৃক্ষাদি ও প্রজনন ক্ষেত্রসহ উন্মুক্ত বাগান ঘুরে দেখেন দর্শনার্থীরা।
জহির রায়হান মিলনায়তনে দিনব্যাপী মেলার আয়োজনের মধ্যে ছিল শিশু-কিশোরদের জন্য প্রজাপতি বিষয়ক ছবি অঙ্কন প্রতিযোগিতা, কুইজ প্রতিযোগিতা, আলোকচিত্র প্রদর্শনী, প্রজাপতির আদলে ঘুড়ি উড্ডয়ন, বারোয়ারি বিতর্ক প্রতিযোগিতা, প্রজাপতি চেনা প্রতিযোগিতা, প্রজাপতি বিষয়ক ডকুমেন্টারি প্রদর্শনী ও পুরস্কার বিতরণী।
এবারের মেলায় প্রকৃতি সংরক্ষণে সার্বিক অবদানের জন্য বন ও প্রকৃতি বিষয়ক সংগঠন ‘প্লানটেশন ফর নেচার’-এর প্রতিষ্ঠাতা সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের প্রকৌশলী সবুজ চাকমা-কে বাটারফ্লাই এওয়ার্ড প্রদান করা হয়। বাটারফ্লাই ইয়াং ইনথুসিয়াস্ট এওয়ার্ড প্রদান করা হয় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের শিক্ষার্থী মোঃ সাব্বির আহাম্মেদ-কে। এছাড়া মিডিয়া এ্যাওয়ার্ড (ডিজিটাল ক্যাটেগরি) পান সজিবুর রহমান।
অনুষ্ঠিত প্রজাপতি মেলার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্যে মেলার আহ্বায়ক অধ্যাপক ড. মো. মনোয়ার হোসেন বলেন, প্রজাপতি এই পরিবেশের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। পরাগায়নের মাধ্যমে প্রজাপতি পরিবেশ ও প্রকৃতি এবং বনাঞ্চল রক্ষায় ভূমিকা রাখছে। প্রজাপতিসহ বিভিন্ন পতঙ্গ আমাদের বাস্তুসংস্থান টিকিয়ে রেখেছে। তিনি প্রজাপতি রক্ষায় এর বাসযোগ্য পরিবেশ অক্ষুণ্ণ রাখার ওপর গুরুত্বারোপ করেন এবং প্রজাপতিসহ সকল পতঙ্গ টিকিয়ে রাখতে জৈববৈচিত্রের সাথে সমন্বয় করে দ্রুত মাস্টারপ্লান কার্যকরের দাবি জানান তিনি।
এসময় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ কামরুল আহসান বলেছেন, প্রজাপতিসহ সকল প্রাণের প্রতি মানুষের দায়িত্ব শুধু সহানুভূতি দেখানো নয়, তাদের প্রতি আমাদের নৈতিক দায়বদ্ধতাও রয়েছে। প্রজাপতি মেলা আয়োজনের মাধ্যমে আমাদের নৈতিক বিবেচনা প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে। আজ প্রাণিবিদ্যা বিভাগের কীটতত্ত্ব শাখার আয়োজনে প্রজাপতি মেলা ২০২৪ উদ্বোধনকালে প্রধান অতিথির ভাষণে উপাচার্য এসব কথা বলেন।
তিনি আরও বলেন, প্রজাপতির কাছ থেকে মানুষের শেখার আছে। প্রজাপতি পরাগায়ণের মাধ্যমে কোনো প্রকার ক্ষতি ছাড়াই আমাদের জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। ধর্ম, বর্ণ এবং বৈচিত্র্যেভেদে মানুষের কাছেও সকল মানুষ নিরাপদ হতে হবে। প্রজাপতির কাছ থেকে গোটা বিশ্বকে নিরাপদ রাখার শিক্ষা গ্রহণ করতে হবে মানুষকে। সকল ষড়যন্ত্র থেকে নিজেদের মুক্ত রাখতে হবে। উপাচার্য প্রকৃতির সুষ্ঠু পরিবেশ বজায় রাখার জন্য সবাইকে দায়িত্বশীল হওয়ার আহ্বান জানান।
প্রাণিবিদ্যা বিভাগের সভাপতি অধ্যাপক ড. মো. মানছুরুল হকের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে অন্যান্যের মধ্যে আরও বক্তব্য রাখেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য (শিক্ষা) অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ মাহফুজুর রহমান, উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) অধ্যাপক ড. সোহেল আহমেদ, জীববিজ্ঞান অনুষদের ডিন (ভারপ্রাপ্ত) অধ্যাপক মোহাম্মদ মাফরুহী সাত্তার, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের সভাপতি অধ্যাপক আবদুল্লাহ আল মাসুদ, প্রকৃতি ও জীবন ফাউন্ডেশনের অধিকর্তা মুকিত মজুমদার বাবু, বন বিভাগের বণ্যপ্রাণী অপরাদ দমন ইউনিটের পরিচালক মো: ছানাউল্যা পাটওয়ারী এবং আরণ্যক ফাউন্ডেশনের প্রতিনিধি মুরাদ বিন আজিজ প্রমুখ।
উল্লেখ্য, এবারের মেলার টাইটেল স্পন্সর হিসেবে রয়েছে ‘কিউট’। সহযোগী সংগঠন হিসেবে থাকছে প্রকৃতি ও জীবন ফাউন্ডেশন, ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব নেচার (আইইউসিএন) ও অরণ্যক ফাউন্ডেশন ও বাংলাদেশ বন বিভাগ।