ট্রল বা ব্যঙ্গ করা জঘন্য অপরাধ

কারো ব্যাপারে উস্কানিমূলক কথা, পোস্ট বা মন্তব্য করা; অথবা কোনো কার্যকলাপের মাধ্যমে কাউকে হয়রান বা ব্যক্তির সমালোচনা করে তার বিরোধিতা করাই হলো ট্রল। ট্রল বলতে বাহ্যিক দৃষ্টিতে ‘নিছক মজা করা’ বলে মনে হতে পারে, কিন্তু ভয়ানক বাস্তবতা হলো-ট্রলের মধ্যে পরোক্ষভাবে কাউকে অপমান করা এবং ব্যঙ্গ করার মাধ্যমে তাকে হাসির পাত্রে পরিণত করা হয়। ট্রল করা শান্তিকামী সামাজের জন্য বিষাক্ত ব্যাধির মতো। ভুল মানুষেরই হয়। আমরা কেউই ভুলের ঊর্ধ্বে নই। ভুল হওয়া একটি স্বাভাবিক বিষয়; কিন্তু এই স্বভাবজাত ভুলকে কেন্দ্র করে একশ্রেণীর মানুষ ট্রল করে থাকে। নিতান্ত কম ক্ষেত্রে তারা এটিকে মজা-আনন্দ হিসেবে করে থাকলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এই ট্রলবাজির পেছনে থাকে কোনো অসৎ উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের কারণ। যে উদ্দেশ্যেই করুক এটি একটি মন্দ কাজ। বর্তমান সমাজে হরহামেশাই ট্রল করার প্রবণতা দেখা যায়। ফেসবুক ইনস্টাগ্রামসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের বদৌলতে ট্রল করা এখন অনেক সহজ হয়ে গেছে।একজনের একটি ছবি বা ভিডিও ভুলে প্রকাশ হয়ে গেলে এটাকে ভাইরাল করে ট্রল করা, কোনো বক্তার ওয়াজ কাটিং করে তাকে নিয়ে ট্রল করা, কারো আকার-আকৃতি নিয়ে বা কোনো মেয়ের স্বামী বয়সে বেশি বড় হলে বা কোনো ছেলে তার থেকে বয়সে বড় কাউকে বিয়ে করলে; সুন্দরী মেয়ের কালো বর হলে আবার কালো মেয়ের সুন্দর বর হলে; কেউ একটু মোটা হলে কিংবা কেউ একটু চিকন হলে-ইত্যাদি বিষয়ে ট্রল যেন একশ্রেণীর মানুষের রীতিমতো অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। তারা একবারও ভেবে দেখে না তখন ওই মানুষটার কি অবস্থা হয়। জীবন তার কাছে বিষম হয়ে উঠে। কখনো তো পরিস্থিতি আত্মহত্যা পর্যন্ত পৌঁছে যায়!

ট্রল বা ব্যঙ্গ করে মজা নেওয়া এবং অন্যকে নিয়ে ঠাট্টা-বিদ্রূপ করা মুমিনের কাজ নয়। অপর ভাইকে ঠাট্টা বিদ্রুপ করা, তার দোষ চর্চা করা মুমিনের গুণ হতে পারে না। আল্লাহ তাআলা বলেন, বলুন! তোমরা কি আল্লাহ, আল্লাহর আয়াত ও তার রাসূলকে নিয়ে ঠাট্টা করছিলে? অজুহাত দেখিও না। তোমরা ঈমান জাহির করার পর কুফরিতে লিপ্ত হয়েছ। আমি তোমাদের মধ্যে এক দলকে ক্ষমা করলেও, অন্য দলকে অবশ্যই শাস্তি দিব। (সূরা আত-তাওবাহ, আয়াত : ৬৫-৬৬)। কিছু মানুষকে দেখা যায় অপরের নাম নিয়ে ট্রল করে। নাম নিয়ে ট্রল করাও মারাত্মক গুনাহ। নাম সবার জীবনের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। মানুষকে তার নামেই ডাকা উচিত। কখনো কারো নাম নিয়ে ব্যঙ্গ করা উচিত নয়।

ট্রল করা কবীরা গুনাহ। ইসলাম অন্যকে নিয়ে ট্রল করা বা ব্যঙ্গ করাকে গর্হিত কাজ বলে ঘোষণা করেছে। পবিত্র কুরআনে মহান আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, হে মুমিনগণ! পুরুষগণ যেন অপর পুরুষদের উপহাস না করে। তারা (অর্থাৎ যাদেরকে উপহাস করা হচ্ছে) তাদের চেয়ে উত্তম হতে পারে এবং নারীগণও যেন অপর নারীদের উপহাস না করে। তারা (অর্থাৎ যে নারীদের উপহাস করা হচ্ছে) তাদের চেয়ে উত্তম হতে পারে। তোমরা একে অন্যকে দোষারোপ করো না এবং একে অন্যকে মন্দ উপাধিতে ডেকো না। ঈমানের পর গুনাহের নাম যুক্ত হওয়া বড় খারাপ কথা। যারা এসব থেকে বিরত না হবে তারাই জালেম।।’ (সুরা হুজুরাত : ১১)।

মহানবী (সা.) এক হাদিসে বলেছেন, এক মুসলিম অপর মুসলিমের (দ্বীনি) ভাই। মুসলিম ব্যক্তি অপর মুসলিমের ওপর অবিচার করবে না, তাকে অপদস্থ করবে না এবং অবজ্ঞা করবে না। (মুসনাদে আহমাদ : ১৬৬৪৪)। আমাদের সমাজে কারো অসুস্থতা এমনকি মৃত্যু নিয়েও ট্রল করার প্রবণতা দেখা যায়। মানুষ পাপী হলেও তার অসুস্থতা ও মৃত্যু নিয়ে ট্রল করা উচিত নয়। একদিন আমাদের রাসূল (সা.) এর পাশ দিয়ে জানাজার জন্য একটি লাশ বহন করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল। তখন তিনি দাঁড়িয়ে গিয়েছিলেন। এসময় তাঁকে বলা হয়েছিল- লাশটি একজন ইহুদির। তিনি বলেছিলেন, ‘সে কি মানুষ নয়?’ (বুখারি : ১৩১২)। ট্রল কুৎসিত মনোভাবের বহিঃপ্রকাশ। আজকাল ট্রল এক ধরনের মানসিক রোগে পরিণত হয়েছে। তারচেয়ে ভয়ানক কথা হলো-এটা সমাজের অনুভূতিতে একটা সাধারণতম বিষয় বলে আস্তানা পেতেছে।

মানুষের বাক-স্বাধীনতা আছে, কিন্তু এর সীমা কতটুকু তা আমাদের জানা দরকার। একজন মানুষ অন্যকে নিয়ে কখনোই হাসি,তামাশা করতে পারে না। কারো দোষ প্রকাশ হলে তা নিয়ে ট্রল না করে গোপন রাখাই হলো ইসলামের শিক্ষা। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, যে ব্যক্তি দুনিয়াতে কোন মুসলিমের দোষ গোপন করে নেবে, আল্লাহ তার দোষত্রুটিকে দুনিয়া ও আখেরাতে গোপন করে রাখবেন। (সুনানে ইবনে মাজাহ হাদিস নং-২৫৪৪)। সুতরাং একজন মুসলিমের জন্য জরুরি হলো অপরকে ট্রল না করে গোপনে তাকে সংশোধন করা এবং তার কল্যাণ কামনা করা। জারীর বিন আব্দুল্লাহ (রা.) বলেন, আমি নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কাছে প্রত্যেক মুসলিমের কল্যাণ কামনার জন্য বায়আত গ্রহন করলাম। (সহীহ মুসলিম : ৫৬)। আল্লাহ আমাদের ট্রলসহ সর্বপ্রকার গুনাহ থেকে হেফাজত করুন ! আমীন!