কৃষিকাজ করে ছেলেমেয়ের পড়ালেখার খরচ আর সংসার চালাতেন বকুল মিয়া। গেল ঈদুল আজহার পর থেকে কাজ কম থাকায় ধারদেনা করতে হয়েছে তাকে। বেড়ে যায় ঋণের টাকা। এই ঋণের টাকা পরিশোধের জন্য গত ১২ জুলাই বকুল মিয়া আসেন ঢাকায়। থাকতেন দক্ষিণখান এলাকায়। গ্যারেজ থেকে রিকশা ভাড়া নিয়ে চালাতেন। প্রতিদিন মোবাইল ফোনে কথা বলতেন স্ত্রী মনিকা বেগমের সঙ্গে। তার সঙ্গে সর্বশেষ কথা হয় গত ১৮ জুলাই সকালে। স্ত্রীকে বলেছিলেন, কয়েক দিন পর বাড়ি যাবেন। বকুল মিয়া ঠিকই বাড়ি ফিরেছেন, তবে লাশ হয়ে। গত ১৮ জুলাই ঢাকার উত্তরার আজমপুর রেলগেটে কোটা সংস্কার আন্দোলনের বিক্ষোভ চলাকালে গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন তিনি। এতে চরম অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে তার দুই শিশুসন্তান মাহাদী হাসান শুভ ও বুসরাত জান্নাত মিতুর ভবিষ্যৎ। আর অকালেই স্বামী হারিয়ে দিশেহারা বকুল মিয়ার স্ত্রী মনিকা বেগম
শুধু বকুল মিয়া নন, কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানে প্রাণ হারিয়েছেন এমন অন্তত ২৪ জন রিকশাচালক। তাদের প্রায় সবাই নিহত হয়েছেন গুলিবিদ্ধ হয়ে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী রফিক আমিন এই তালিকাটি তৈরি করেছেন। পরে তা ‘জুলাই ম্যাসাকার আর্কাইভ’-এ তুলে ধরেন। জুলাই-আগস্টের আন্দোলনে ছাত্র-জনতার সঙ্গে অংশ নিতে দেখা যায় বহু রিকশাচালককে। বিশেষ করে ঢাকায় ছাত্রদের সঙ্গে স্লোগান, মিছিলে সরব ছিলেন এই শ্রমজীবীরাও। নিহত হওয়া বেশিরভাগ রিকশাচালক পরিবারের সদস্যদের মুখে আহার তুলে দিতে রিকশা নিয়ে বের হয়ে লাশ হয়ে ফেরেন। তারা পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি হওয়ায় এখন পথে বসেছে পরিবারগুলো।
শহীদ হওয়া বকুল মিয়া শেরপুরের শ্রীবরদী উপজেলার চাউলিয়া গ্রামের শামছুল হকের ছেলে। তার স্ত্রী মনিকা বেগম দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘মোবাইল ফোনে খবর পাই। পরে আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে যোগাযোগ করে ঢাকার হাসপাতাল থেকে স্বামীর লাশ বাড়িতে নিয়ে আসি।’
তার প্রশ্ন ‘আমার স্বামীর তো কোনো দোষ নেই। কেন তারা গুলি কইরা মারল? এখন আমার ছেলেমেয়েকে পড়ালেখার খরচ কে দেবে? কীভাবে সংসার চালামু? আমার ছেলেমেয়ের পড়ালেখা এখন অনিশ্চিত।’
এ ছাড়া শহীদ রিকশাচালকদের তালিকায় রয়েছেন সাগর, ইমন, আবু সুফিয়ান, হাফিজুর ইসলাম, কমর উদ্দিন, আসাদুল হক বাবুল, কামাল মিয়া, নুরু বেপারি, রমজান, মাসুদুর রহমান জনি, সুমন হাসান, বিপ্লব হোসেন, ইমন গাজী, মাসুম মোল্লা, জাহাঙ্গীর হাওলাদার, বাবু মোল্যা, কামাল মিয়া, রনি প্রামাণিক, মনিরুজ্জামান মনির, মো. তুহিন, মনজু মিয়া, রিপন এবং অজ্ঞাতপরিচয় একজন।
খাবার নিতে এসে গুলিবিদ্ধ হন মনজু মিয়া : রাজধানীর বড়বাড়ী জয়বাংলা রোড এলাকায় গত ২০ জুলাই পুলিশের গুলিতে রিকশাচালক মনজু মিয়ার মৃত্যু হয়। ওই দিন খাবার নেওয়ার জন্য বাসার বাইরে বের হলে হঠাৎ গুলি লাগে তার। ছটফট করতে করতে লুটিয়ে পড়েন মনজু মিয়া। এলাকাবাসীর সহযোগিতায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
মনজু মিয়া (৪০) রংপুরের পীরগাছার ছাওলা ইউনিয়নের জুয়ানের চর গ্রামের এনছের আলীর ছেলে। পরিবার নিয়ে বড়বাড়ী জয়বাংলা রোড এলাকার একটি বাসায় ভাড়া থাকতেন। ভূমিহীন মনজু মিয়া সংসারে কিছুটা সচ্ছলতা আনতে দুই বছর আগে স্ত্রী রাহিমা বেগমকে ঢাকায় নিয়ে আসেন। তিনি রিকশা চালাতেন, আর স্ত্রী একটি গার্মেন্টসে চাকরি করতেন। তাদের চার বছরের মেয়ে ও দুই বছর বয়সী ছেলে তাম্বুলপুর ইউনিয়নের রহমতচর গ্রামে নানার বাড়িতে থাকত। স্বামীকে হারিয়ে শোকে কাতর রাহিমা বেগম বলেন, ‘পুলিশ আমার স্বামীকে গুলি করে হত্যা করেছে। আমাদের বেঁচে থাকার স্বপ্নটুকু কেড়ে নিয়েছে। বাচ্চা দুটোর ভবিষ্যতের কথা ভেবে কত আশা নিয়ে ঢাকায় গিয়েছিলাম। এখন তো আমার আর কিছুই থাকল না। কে দেখবে আমার অবুঝ বাচ্চাদের? কার কাছে বিচার চাইব? আমরা তো গরিব মানুষ, আল্লাহর কাছে বিচার চাইছি।’
আন্দোলনের মাঝে পড়ে নিহত বাবু মোল্যা : সংসারের অভাব-অনটন মেটাতে রিকশা চালাতে ঢাকায় আসেন বাবু মোল্যা। গত ১৯ জুলাই রিকশা নিয়ে বের হয়ে যাত্রাবাড়ীতে আন্দোলনের মাঝে পড়ে পুলিশের গুলিতে আহত হন। পরে ঢামেক হাসপাতালে মারা যান। পরদিন ২০ জুলাই মরদেহ গ্রামের বাড়ি গোপালগঞ্জের মুকসুদপুরের দক্ষিণ গঙ্গারামপুরে নিয়ে দাফন করা হয়। পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিকে হারিয়ে তিন শিশুসন্তান নিয়ে চরম বিপাকে পড়েছেন বাবুর স্ত্রী।- দেশ রূপান্তর
চাল-ডাল না থাকায় বাধ্য হয়ে বের হয়েছিলেন রনি : আন্দোলনের কারণে সরকার কারফিউ জারি করায় দুদিন রিকশা চালাতে পারেননি রনি প্রামাণিক। রোজগার বন্ধ থাকায় ঘরে ছিল না চাল-ডাল। সন্তানের জন্য ওষুধ কেনাও দরকার ছিল। এজন্য বাধ্য হয়ে ২০ জুলাই সকাল ৯টার দিকে গ্যারেজ মহাজনের কাছ থেকে রিকশা নিয়ে বের হন। বেলা ১১টার দিকে সাভার বাসস্ট্যান্ডে অপেক্ষা করছিলেন যাত্রীর জন্য। এরই মধ্যে হঠাৎ আন্দোলনকারীদের ছত্রভঙ্গ করতে গুলি ছোড়ে পুলিশ, যা লাগে রিকশাচালক রনির শরীরে। খবর পেয়ে শিশুসন্তানকে কোলে নিয়ে হাসপাতালে গিয়ে স্বামীর নিথর দেহ পড়ে থাকতে দেখেন স্ত্রী সাথী বেগম। দেখেন তার বুকে-পিঠে অসংখ্য গুলির চিহ্ন।
সাথী বলেন, ‘আমার স্বামী তো আন্দোলন করেনি। তারপরও তাকে জীবন দিতে হলো। ছেলেরা বাবা বাবা বলে হয়রান হচ্ছে। ওদের থামাতে পারছি না। অবুঝ সন্তানদের কী বুঝ দেব? এক বেলা খাওয়ার মতো ঘরে চাল-ডালও নেই। ওদের কীভাবে বড় করব, বুঝে উঠতে পারছি না।’
মনির হত্যায় শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মামলা : আন্দোলনের সময় রিকশাচালক মনিরুজ্জামান মনিরকে গুলি করে হত্যার অভিযোগে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ ২৬ জনের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। সম্প্রতি ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মো. আক্তারুজ্জামানের আদালতে নিহতের বোন নিলুফার ইয়াসমিন বাদী হয়ে এ মামলা করেন। আদালত বাদীর জবানবন্দি রেকর্ড করে শাহবাগ থানা-পুলিশকে অভিযোগটি এজাহার হিসেবে গ্রহণের নির্দেশ দেয়। বাদীপক্ষের আইনজীবী আব্দুল হান্নান ভূঁইয়া এসব তথ্য জানান। মামলার অভিযোগে বলা হয়েছে, গত ৫ আগস্ট রাজধানীর শাহবাগ থানাধীন ফুলবাড়িয়া এলাকায় গুলিবিদ্ধ হন রিকশাচালক মনিরুজ্জামান মনির। পরে ঢামেক হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
থানার সামনে রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে ছিলেন কামাল মিয়া : কোটা সংস্কার আন্দোলন চলাকালে গত ১৯ জুলাই রাজধানীর পল্টন থানা এলাকায় গুলিতে নিহত হন রিকশাচালক কামাল মিয়া (৩৯)। এ ঘটনায় পল্টন থানায় অজ্ঞাতপরিচয় দুষ্কৃতকারীদের আসামি করে ২০ জুলাই হত্যা মামলা করেন নিহতের স্ত্রী ফাতেমা খাতুন। মামলার এজাহারে বাদী বলেন, ‘আমার স্বামী কামাল মিয়া পেশায় রিকশাচালক। গত ১৯ জুলাই সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে প্রতিবেশীর মাধ্যমে জানতে পারি যে, আমার স্বামী রক্তাক্ত অবস্থায় পল্টন মডেল থানার সামনে বটতলা গলির মুখে পড়ে আছে। তখন আমি ও আমার মেয়ে তাকে উদ্ধার করে দ্রুত ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাই। এরপর কর্তব্যরত চিকিৎসক আমার স্বামীকে মৃত ঘোষণা করেন।’
নিহত রিকশাচালকদের তালিকা সংগ্রহ করা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী রফিক আমিন দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘ইতিহাসের শ্রেণি চরিত্র আছে। শ্রমিক-কৃষক, নিম্নবর্গের মানুষকে ইতিহাস থেকে মুছে ফেলা হয় অথবা আড়াল করা হয়। কিন্তু তারাই মূলত লড়াই করে ইতিহাস নির্মাণ করে। ১৫ জুলাই ঢাকা শহরে রিকশাশ্রমিকদের মিছিলে সেøাগান উঠেছে “ছাত্র ভাই ভয় নাই রাজপথ ছাড়ি নাই”। এখন পর্যন্ত পাওয়া তথ্যে তারা অন্তত ২৪ জন জন শহীদ হয়েছেন, অসংখ্য পঙ্গু হয়েছেন, আহত হয়েছেন। এই তথ্যগুলো আমি পত্রিকা থেকে সংগ্রহ করেছি। কাজ চলমান রয়েছে। আরও নাম যুক্ত হতে পারে এই তালিকায়। তারাও ইতিহাসের অংশ। এজন্য এই তালিকা প্রস্তুত করছি।’
আন্দোলনে শহীদ সবাইকে সহায়তা দেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাবেক অন্যতম সমন্বয়ক ও জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশনের সাধারণ সম্পাদক সারজিস আলম। তিনি বলেন, ‘আমরা ইতিমধ্যে শহীদ পরিবারগুলোকে সহায়তা দেওয়া শুরু করেছি। এই সহায়তা থেকে কেউ বাদ যাবে না। প্রতি সপ্তাহে ২০০ পরিবারকে এ সহায়তা দেওয়া হবে। আপাতত ঢাকা থেকে এ কার্যক্রম শুরু হয়েছে। পর্যায়ক্রমে আট বিভাগেই শহীদদের পরিবারকে সহযোগিতার কাজ করা হবে। রিকশাচালকরাও এই আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন, তাদের আমরা শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি। তাদের পরিবারের পাশে আমরা থাকব।’