সৃষ্টিকুলে যেসব মহা মনিষীগণ শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করেছেন, তারা শিষ্টাচার ও মার্জিত ব্যবহারের মাধ্যমেই মানুষের মন জয় করে নিয়েছেন। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছিলেন শিষ্টাচারের মূর্তপ্রতীক।উত্তম ব্যবহারের জন্য তিনি ছোট-বড় সবার নিকট অত্যন্ত প্রিয় এবং আস্থার পাত্র ছিলেন। সংযম, বিনয়, ভদ্রতা ছিলো তাঁর ব্যাক্তিত্ত্বের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। এ কারণেই রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আইয়ামে জাহিলিয়্যাতের যুগে কাফেরের হৃদয় জয় করেছেন। এবং আল-আমিন নামেও ভূষিত হয়েছেন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পরবর্তী যুগেও সাহাবিগণ এই শিষ্টাচারের মাধ্যমেই গোটা পৃথিবী জয় করেছেন। সুতরাং বলা যায় মানবজীবনের ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্র গঠনে যেকোনো সমস্যা নিরসনে অন্যতম পদ্ধতি হলো এই শিষ্টাচার।
শিষ্টাচারের গুরুত্ব; আদর্শ ও সুশৃঙ্খল সমাজ গঠনে শিষ্টাচারের গুরুত্ব অপরিসীম। শিষ্টাচারের গুরুত্ব সম্পর্কে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন : ‘নিশ্চয়ই উত্তম চরিত্র, ভাল ব্যবহার ও পরিমিত ব্যয় বা মধ্যপন্থা অবলম্বন করা নবুওয়াতের পঁচিশ ভাগের এক ভাগ।’ (আবু দাউদ : ৪৭৭৬)। শিষ্টাচার হলো ভদ্র, মার্জিত ও রুচিসম্মত আচরণ।যা মানুষকে সংযমী ও বিনয়ী করে তোলে।এই গুণ হঠাৎ করেই কারও মধ্যে গড়ে ওঠে না। এর জন্য গ্রহণ করতে হয় দীর্ঘ প্রস্তুতি পর্ব। শিষ্টাচারের বীজ মূলত বপিত হয় শিশুকালে। এক্ষেত্রে পারিবারিক ভূমিকাই প্রধান। শিশুরা অনুকরণ প্রিয়। পরিবারের বড়রা যে রকম ব্যবহার করে শিশুরাও তাই অনুসরণ করে। নি¤েœ যাপিত জীবনে ইসলামী শিষ্টাচারের কতিপয় দিক তুলে ধরা হলো :
সালাম বা সম্ভাষণ : ইসলামী জীবন বিধানে ছোট-বড়,পরিচিত-অপরিচিত সবাইকে সালাম দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।এবং সালামের জবাব দেওয়ার জন্যও অধিক গুরুত্বারোপ করা হয়েছে।আল্লাহ তায়ালা বলেন; ‘যখন তোমরা সালাম ও অভিবাদনপ্রাপ্ত হও, তখন তোমরা তার চেয়ে শ্রেষ্ঠতর সম্ভাষণ কর অথবা একইভাবে অভিবাদন কর। নিশ্চয়ই আল্লাহ সব বিষয়ে হিসাব গ্রহণকারী।’ (সূরা নিসা : ৮৬)।
দৈনন্দিন জীবনে শিষ্টাচার : জীবনের প্রতিটি কাজ একটি নীতি-আদর্শ অনুসারে বা শিষ্টাচার অনুযায়ী চলতে হয়। শৃঙ্খলা অনুসারে চললে সমাজে ভারসাম্য বজায় থাকে। নির্দেশনা অনুসারে কাজ করা না হলে সে কাজ সুচারুরূপে সম্পন্ন হয় না এবং তাতে কাঙ্ক্ষিত ফলও অর্জিত হয় না। মানুষের সঙ্গে ওঠাবসা, পানাহার, বসবাস ও সহাবস্থান সমাজজীবনের মৌলিক কাজ। এসব প্রাত্যহিক কর্মকা-ে শিষ্টাচারের সর্বোত্তম উদাহরণ হলেন মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম । আল্লাহ্ বলেন ; ‘তুমি অবশ্যই মহান চরিত্রের অধিকারী।’ ( সুরা আল-ক্বলম : ৪)।
প্রতিবেশীর সাথে সদাচরণ করা: প্রতিবেশীর সাথে সদাচরণ করা মুসলমানের অন্যতম কর্তব্য। সামাজিক শৃঙ্খলা রক্ষার্থে হৃদয়ের সবটুকু ভালোবাসা উজাড় করে দিয়ে প্রতিবেশীর সাথে সুসম্পর্ক স্থাপন করা। আল্লাহ তায়ালা বলেন : ‘তোমরা সদাচরণ কর নিকটাত্মীয়, অনাথ, নিঃস্ব, নিকট প্রতিবেশী, দূর প্রতিবেশী, পার্শ্বস্থিত সঙ্গী, পথিক ও তোমাদের অধিকারভূক্ত দাস-দাসীদের সঙ্গে। নিশ্চয় আল্লাহ তা‘আলা তাদের ভালোবাসেন না যারা গর্বে স্ফীত অহংকারী।’ (সূরা আন-নিসা : ৩৬)। প্রতিবেশীর হক অতীব গুরুত্বপূর্ণ বিধায় তাকে কষ্ট দেওয়া হারাম। আবু শুরাইহ (রা.) থেকে বর্ণিত, একদা রাসুল্ল্লুাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন : ‘আল্লাহর শপথ সে মুমিন নয়, আল্লাহর শপথ সে মুমিন নয়, আল্লাহর শপথ সে মুমিন নয়। জিজ্ঞেস করা হল, কে সে জন ইয়া রাসুলুল্লাহ? তিনি বললেন, যার প্রতিবেশী তার অত্যাচার থেকে নিরাপদে থাকতে পারে না’। (মিশকাত : ৪৯৬২)।
লজ্জাশীলতা : লাজুকতা সভ্যতা বিকাশে রুচির পরিচায়ক। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছিলেন লজ্জাশীলতার মূর্ত প্রতীক।হযরত সালিম ইবনে আবদুল্লাহ্ ইবনে উমার (রা.) থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দেখলেন, এক ব্যক্তি তার ভাইকে লাজুক স্বভাবের জন্য তিরস্কার করছে, তিনি তাকে লক্ষ্য করে বললেন : তাকে ছেড়ে দাও। মনে রেখো লজ্জা ঈমানের অংশ। (সহীহ, মুসলিম) এ মর্মে ইমরান ইবনে হুসাইন (রা.) থেকে বর্ণিত হয়েছে : আল্লাহর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন : ‘লজ্জাশীলতা (শুধু) কল্যাণ ছাড়া আর কিছুই নিয়ে আসে না।’ (বাইহাকী)।
পবিত্রতা ও পরিচ্ছন্নতা : শিষ্টাচারের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো পবিত্রতা ও পরিচ্ছন্নতা। মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তওবাকারীদের ভালবাসেন ও পবিত্রতা অর্জনকারীদের ভালবাসেন।’ (সুরা বাকারা : ২২২)। হাদিসেও বিভিন্ন উপায়ে পরিচ্ছন্নতার গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে এবং নানাবিধ শিক্ষা দেওয়া হয়েছে। এমনকি পরিচ্ছন্নতা রক্ষাকে ঈমানের অংশ বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। আবু মালেক আশআরি (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন : ‘পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ঈমানের অর্ধেক।’ (মুসলিম : ২২৩)।