হৃদয়ের পুষ্টির উৎস আল-কুরআন

আল্লাহ তায়া’লা মানবজাতিকে হেদায়েতের জন্য যুগে যুগে অসংখ্য অগণিত নবী ও রাসূল দুনিয়াতে প্রেরণ করেছেন। সকল নবী ও রাসূল (সাঃ) গণের সকলেরই মিশন ছিলো মানুষকে দ্বীনের দাওয়াত দেওয়া আর নবী ও রাসূল গণের দাওয়াতি কাজকে পরিচালনা করার জন্য মহান আল্লাহ তায়া’লা ছোট বড় প্রায় ১০৪ খানা স্বর্গীয় কিতাব নাজিল করেছেন। তারমধ্যে মহাগ্রন্থ আল-কুরআন হলো সর্বশ্রেষ্ঠ।আল্লাহ তায়া’লা মুহাম্মদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর উপর সময়ের প্রয়োজনে সুদীর্ঘ ২৩ বছরে এ কিতাব নাযিল করেছেন।

মুহাম্মদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর জীবদ্দশায় সকল মুসলমানদেরকে মহাগ্রন্থ আল কুরআন থেকেই প্রশিক্ষণ দেওয়া হতো।কুরআনই ছিলো জীবনের পথচলার জন্য আলোকবর্তিকা স্বরুপ। জান্নাতের সুসংবাদ প্রাপ্ত ১০ জন সম্মানিত সাহাবাগণ এই কুরআনকে অনুসরণ করেই তাদের জীবন পরিচালনা করে মহান আল্লাহর সান্নিধ্য লাভ করেছেন।সুতরাং এই কুরআন ই যেন আমাদের জীবনসঙ্গী হয় সেটাই ইমানের অপরিহার্য দাবি।

কুরআন হচ্ছে মানবসত্তার উন্নতি সাধনের অসীম প্রেরণা ও সীমাহীন জ্ঞান ভান্ডার। সুতরাং আমাদের সবার উচিৎ কুরআন বুঝতে ও অন্তর দিয়ে অনুধাবন করতে পর্যাপ্ত সময় দেওয়া। ইন্টারনেটের উৎকর্ষতার যুগে খুব সহজেই তাফসীর পাওয়া যায়। যারাই কুরআনকে হৃদয় দিয়ে তেলাওয়াত করবে,বুঝবে আল্লাহ তায়া’লা তাদের ইমান বৃদ্ধি করে দিবেন। আল্লাহ তায়া’লা পবিত্র কুরআনে বলেন, নিশ্চয়ই মু’মিনরা এরূপই হয় যে, যখন (তাদের সামনে) আল্লাহর নাম উচ্চারণ করা হয় তখন তাদের অন্তরসমূহ ভীত হয়ে পড়ে, আর যখন তাদের সামনে তাঁর আয়াতসমূহ পাঠ করা হয় তখন তাদের ঈমান আরও বৃদ্ধি পায়, আর তারা নিজেদের রবের উপর বিশ্বাস করে। (আনফাল-২)।

অনেকেই বলে থাকে আমি কুরআন তেলাওয়াত করি বা শুনি তখন আমার অন্তর কেঁপে ওঠে না, আমার চোখ দিয়ে পানি আসে না বা আমার জীবনও বদলায় না। অন্তর পাথরের মতো শক্ত হয়ে গেছে। এইজন্য আমাদেরকে কুরআন অধ্যয়নের সময় এমন আন্তরিকতা রাখতে হবে যেন মাত্র কুরআন নাযিল হচ্ছে আর এই আয়াত আমার জন্য নাযিল হচ্ছে।কুরআন থেকে পুষ্টি গ্রহণ করে আমাদের হৃদয়ে ইমানের চারাগাছ রোপন করতে হবে। আর নিয়মিত এ গাছকে পরিচর্যা করতে হবে যাতে সেই ইমান নামক গাছটি নির্দ্বিধায় বেড়ে উঠতে পারে। কুরআন অধ্যয়নের সময় আমাদের সবাইকে একান্তভাবে মনে রাখতে হবে কুরআন নাযিলের মূল উদ্দেশ্য ই হলো মানুষকে হেদায়েতের পথ দেখি দিয়ে আল্লাহর পরিপূর্ণ কাছের বান্দা হওয়া। আল্লাহ তায়া’লা কুরআনে বলেন, ইহা ঐ গ্রন্থ যার মধ্যে কোন সন্দেহ-সংশয়ের অবকাশ নেই; ধর্ম-ভীরুদের জন্য এ গ্রন্থ পথনির্দেশ। (বাকারা-০২)

কুরআন অধ্যয়নের মূল উদ্দেশ্য থাকবে কুরআনকে ভালোভাবে জানা এবং কুরআনের আমলগুলোকে নিজের জীবনে বাস্তবায়নের মাধ্যমে নিজের জীবনকে ঢেলে সাজানো।হযরত ওসমান ও ইবনে মাসউদ রা. থেকে বর্ণিত আছে যে, সাহাবায়ে কেরামগণ আল্লাহর রসুল সাঃ এর কাছ থেকে ১০ টি আয়াত শুনার পর তা পুরোপুরি বুা এবং তা নিজের জিবনে বাস্তবায়ন না করা পর্যন্ত সামনে অগ্রগামী হতেন না।তারা কুরআনকে হৃদয় দিয়ে বুঝার চেষ্টা করেছেন যার জন্য ওনাদের কোনো একটি সূরা বা পারা শেষ করতে কয়েক বছর পর্যন্ত লেগে যেতো। কুরআন যতই অধ্যয়ন করা হবে ততই মানুষের জীবন অটোমেটিক পরিবর্তন হতে থাকবে।কুরআন অধ্যয়নের পরেও যদি মানবজীবনে কোনো পরিবর্তন না আসে তাইলে বুঝতে হবে আমরা কুরআনের কাছেও যেতে পারি নি। কেউ কুরআনকে জানবে কিন্তু বাস্তব জীবনে এর প্রতিফলন ঘটাবে না তাকে অবশ্যই অবশ্যই শাস্তির সম্মুখীন হতে হবে। আমাদের নবী মুহাম্মদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, আমার উম্মতের মধ্যে অনেক মুনাফিক আসবে যারা কুরআন তেলাওয়াতকারী। (আহমদ)।

কুরআনকে জানা বুঝা ও অধ্যয়নের জন্য সবচেয়ে বেশি দরকার হলো আগ্রহের সাথে কুরআনের কাছে আসা। আর যারাই কুরআনকে বুঝার জন্য কুরআনের কাছে আসবে আল্লাহ তায়া’লা তাদের পথকে অনেক বেশি সহজ করে দিবেন এবং স্বয়ং আল্লাহ নিজেই সহযোগিতা করবেন।এ বিষয়ে আল্লাহ তায়া’লা কুরআন নাজিল করে আমাদেরকে সান্ত¡নার বাণী শুনিয়েছেন, যারা বলে আমাদের রাব্ব আল্লাহ! অতঃপর অবিচল থাকে, তাদের নিকট অবতীর্ণ হয় মালাইকা (ফেরেশতা) এবং বলে, তোমরা ভীত হয়োনা, চিন্তিত হয়োনা এবং তোমাদেরকে যে জান্নাতের প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছিল তার জন্য আনন্দিত হও। (সূরা হা-মীম সাজদাহ-৩০-৩১)।

কুরআনকে নিজের জীবনের সঙ্গী বানিয়ে নিতে হবে। নিজের জীবনের প্রতিটি পরতে পরতে কুরআনকেই সঙ্গী করতে হবে। রান্না ঘর থেকে শুরু করে জীবনের সবগুলো কাজ হবে কুরআন অনুযায়ী। যে কুরআনের কাছাকাছি থাকবে,কুরআনের সংস্পর্শে থাকবে তারই মর্যাদা বহুগুণে বেড়ে যাবে। একজন মুমিনের কাজ হলো কুরআনকে অন্তর দিয়ে ধারণ করা এবং নিজের এই ছোট্ট জীবনকে কুরআন অনুযায়ী পরিচালনা করা। রাসুল (সা.) আমাদের জন্য দু’টো পথপ্রদর্শক রেখে গেছেন। যেগুলোকে ভালোভাবে আকড়ে ধরে রাখলে কোনো মানুষ কখনো পথভোলা হবে না।এ দুটো জিনিসের মধ্যে প্রথম টি হলো আল-কুরআন।আর দ্বিতীয়টি হলো মৃত্যুর কথা খেয়াল রাখা। আমরা সবসময়ই কুরআনের সাথে থাকবো আর সবসময়ই আমাদের একটি কথা মনে রাখতে হবে যে আমাদের চিরস্থায়ী নয়। আমাদের জীবন টা নশ্বর। যদি আমরা কুরআনকে ভালো করে আকড়ে ধরে রাখতে পারি তাইলে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত কোনো কিছু আমাদেরকে আল্লাহকে বিমুখ করতে পারবে না।যখন আমি আর আপনি কুরআনকে নিজের জীবনের পাথেয় করে নেবো ঠিকই তখন আমাদের আর অন্য কোনো প্রশিক্ষণের দরকার নেই। তখন পবিত্র কুরআন ই আমাদেরকে সঠিক পথ দেখানোর জন্য যথেষ্ট হবে।

নিয়মিত কুরআন তেলাওয়াত একজন মুমিনের জন্য অত্যাবশ্যক ই বলা চলে। দিনের শুরুও হবে কুরআন তেলাওয়াত দিয়ে আবার শেষও হবে কুরআন তেলাওয়াত দিয়ে।নিয়মিত রুটিন করে সহজ ও ছোট ছোট সূরা গুলো তেলাওয়াত করা সাথে অর্থসহ পড়ার চেষ্টা করা।এতে করে কুরআনের মূল স্বাদ টা পাওয়া যাবে। প্রতিদিন ফজরের নামাজ আদায় করার পর কুরআন তেলাওয়াতের মাধ্যমে দিনের কার্যসূচী শুরু করা এবং রাতে ঘুমানোর পূর্বে কুরআন তেলাওয়াতের মাধ্যমে দিনের পরিসমাপ্তি করা।কুরআন তেলাওয়াতের সর্বোত্তম সময় ফজরের পর এবং রাতের বেলা।

একজন মুমিন তার প্রতিদিনের কর্মতৎপরতা শুরু করবে কুরআনের তেলাওয়াতের মাধ্যমে। কুরআন তেলাওয়াত আত্মাকে সতেজ করে।ইমানকে বহুগুণে বৃদ্ধি করে।আল্লাহ তায়া’লা পবিত্র কুরআনে বলেন, নিশ্চয়ই মু’মিনরা এরূপই হয় যে, যখন (তাদের সামনে) আল্লাহর নাম উচ্চারণ করা হয় তখন তাদের অন্তরসমূহ ভীত হয়ে পড়ে, আর যখন তাদের সামনে তাঁর আয়াতসমূহ পাঠ করা হয় তখন তাদের ঈমান আরও বৃদ্ধি পায়, আর তারা নিজেদের রবের উপর নির্ভর করে। (সূরা-আনফাল-০২)। সুতরাং একজন মুমিন হিসেবে নিজের ইমানকে তাজা করার জন্য প্রতিদিন কুরআন তেলাওয়াত করা খুব জরুরি। মনে করতে হবে কুরআন তেলাওয়াত ছাড়া দিনটাই অসম্পূর্ণ। মাঝেমধ্যে অনেক বেশি তেলাওয়াতের চেয়ে প্রতিদিন অল্প কিছু তেলাওয়াত করা উত্তম।

মনের মাধুরি মিশিয়ে কুরআনকে তেলাওয়াত করতে হবে। কুরআন পৃথিবীর স্বাভাবিক কোনো বই বা পুস্তক নয় যে, নিজের মতো করে তেলাওয়াত করা যাবে। বরং কুরআন হলো মহান রবের পক্ষ থেকে বান্দার জন্য জীবনবিধান।হাদিসের বর্ণনা হলো, যে ব্যক্তি তিন দিনের কম সময়ে কুরআন তেলাওয়াত শেষ করবে সে কুরআনের কিছুই বুঝে নি।অপর এক হাদিসে রাসুল (সা.) হযরত ওমর ফারুক (রা.) কে এক সপ্তাহের আগে কুরআন তেলাওয়াত শেষ করতে নিষেধ করেছেন। অথচ আমরা দেখি যে, সন্ধ্যা রাতে তেলাওয়াত শুরু করে ভোর বেলার মধ্যেই কুরআন তেলাওয়াত শেষ করা হয় যা পুরোপুরি হাদিস বা সুন্নাহ পরিপন্থী কাজ। আরেকটি বর্ণনায় পাওয়া যায়, সূরা বাকারাহ বা আলে ইমরানের মতো বড় সূরা তাড়াহুড়ো করে তেলাওয়াতের চেয়ে কুরআনের সবচেয়ে ছোট্ট সূরা সুন্দর ও তারতীলের সহিত তেলাওয়াত করা অতি উত্তম।

কুরআনকে হৃদয় দিয়ে তেলাওয়াত করতে হবে। সর্বোচ্চ শুদ্ধভাবে কুরআনকে তেলাওয়াত করার চেষ্টা করতে হবে। আল্লাহ তায়া’লা পবিত্র কুরআনে বলেন, ‘আর কুরআন আবৃত্তি কর ধীরে ধীরে স্পষ্ট ও সুন্দরভাবে’। ( সূরা মুযাম্মিল-০৪)। সবিশেষ কুরআন তেলাওয়াত ই হবে আমাদের দিনের প্রথম ও প্রধান কাজ।তাহলে আশা করা যায় আল্লাহ তায়া’লা আমাদের জীবনকে বরকতময় করবেন ইন শা আল্লাহ।