সাবেক হুইপ স্বপন নিজেকে ‘খাদেম’ বললেও ছিলেন খাদক

২০০৮ সালের নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে জয়পুরহাট-২ (কালাই-ক্ষেতলাল-আক্কেলপুর) সংসদীয় এলাকায় তেমন পরিচিতি ছিল না আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন এমপির। তাঁর বাড়ি সংসদীয় আসন জয়পুরহাট-১-এর পাঁচবিবি উপজেলার পশ্চিম বালিঘাটা গ্রামে।

ওই এলাকায় তখন স্বপন নামে স্থানীয় আওয়ামী লীগের আরো দুজন সুপরিচিত নেতা ছিলেন, যাঁদের একজন হিন্দু অন্যজন মুসলমান। হঠাৎ করেই এই স্বপনের আবির্ভাব ঘটে।

তিনি হিন্দু না মুসলমান তা-ও জানত না এলাকাবাসী। ওই সময় ‘স্বপন দাদা না ভাই’ শিরোনামে জাতীয় একটি দৈনিকে সংবাদও প্রকাশিত হয়।

নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন সামান্য ভোটের ব্যবধানে পরাজিত হন। কিন্তু আওয়ামী লীগ একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে সরকার গঠন করায় কপাল খোলে তাঁর।দলের কেন্দ্রীয় কমিটির রাজশাহী বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক পদ পেয়ে যান তিনি। এরপর হয়ে ওঠেন দোর্দণ্ড প্রতাপশালী।

পরের একতরফা নির্বাচনগুলোতে টানা তিনবার সংসদ সদস্য হন স্বপন। দুই দফায় জাতীয় সংসদের হুইপও ছিলেন।হলফনামায় তাঁর বর্তমান ঠিকানা নির্বাচনী এলাকা ক্ষেতলালের ভাসিলা পশ্চিমপাড়া গ্রামে, যেখানে তিনি কোনো দিনই বসবাস করেননি।

ক্ষমতা পেয়ে অঢেল সম্পদের মালিক হতে থাকেন স্বপন ও তাঁর পরিবার। এলাকায় তথা গোটা জেলায় দলীয় কর্মকাণ্ড সবই পরিচালিত হতো তাঁর নির্দেশনায়। প্রতিটি সভায় নিজেকে পরিচয় দিতেন ‘খাদেম’ হিসেবে। তাঁর কথার ফুলঝুড়িতে পরিচ্ছন্ন নেতা মনে হলেও আসল রূপ ছিল ভিন্ন।

তাঁর রোষানল থেকে রেহাই পাননি সরকারি কর্মকর্তা, পুলিশ, সাংবাদিক এমনকি নিজ দলের নেতারাও। হাসিনা সরকারের পতনের পর অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে এরই মধ্যে স্বপনের দেশ ত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছেন আদালত। তবে আগেই তিনি লন্ডনে পালিয়ে গেছেন বলে জানা গেছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, স্বপন তাঁর সাম্রাজ্য নিয়ন্ত্রণ করতেন একটি সিন্ডিকেটের মাধ্যমে। এই সিন্ডিকেটে ছিলেন সাবেক পৌর মেয়র মোস্তাফিজুর রহমান মোস্তাক, সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান জহুরুল ইসলাম, পাঁচবিবির সাবেক মেয়র হাবিবুর রহমান, জেলা আওয়ামী লীগের প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক মাসুদ রেজা, ক্ষেতলাল উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান মোস্তাকিম মণ্ডলসহ কয়েকজন।

জেলার হাসপাতালগুলোর কোটি কোটি টাকার সামগ্রী কেনার টেন্ডার, বড় বড় হাট-বাজার ইজারা, সড়ক-সেতু ও নদীর উন্নয়নকাজ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সভাপতি, শিক্ষক-কর্মচারী নিয়োগ সবই নিয়ন্ত্রণ করত আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপনের সিন্ডিকেট।

বিগত সরকারের সময়ে জেলার পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো), সড়ক ও জনপথ বিভাগ এবং স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের (এলজিইডিই) শত শত কোটি টাকার উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ কাগজে-কলমে অন্য ঠিকাদারের নামে থাকলেও তা বাস্তবায়ন করেছে হুইপ স্বপনের আস্থাভাজন মাসুদ রেজা।

হলফনামায় স্বপনের যত সম্পদ : ২০০৮ সালের নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দেওয়া হলফনামায় ব্যবসায় ও মৎস্য চাষে আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপনের বার্ষিক আয় ছিল মাত্র তিন লাখ ৯৫ হাজার টাকা। নগদ পাঁচ লাখ টাকা ছিল। স্ত্রী ও নির্ভরশীলদের নামে কোনো অস্থাবর সম্পদ ছিল না। স্থাবর সম্পদের মধ্যে নিজ নামে ১০০ শতাংশ কৃষি জমি ছিল, যার মূল্য ছিল মাত্র সাড়ে ২১ হাজার টাকা। অকৃষি জমি ছিল ৫.৫০ শতাংশ, যার মূল্য ছিল সাড়ে ১৭ হাজার টাকা। স্ত্রী ও নির্ভরশীলদের নামে স্থাবর সম্পদও ছিল না।

সর্বশেষ দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তাঁর হলফনামা বলছে, বার্ষিক আয় এক কোটি ১৪ লাখ ৬০ হাজার ৩৫২ টাকা ও নির্ভরশীলদের আয় ২৪ লাখ পাঁচ হাজার ৮৪ টাকা। নগদ টাকা চার লাখ ৫০ হাজার টাকা ও স্ত্রীর নগদ এক লাখ টাকা। অস্থাবর সম্পদ তাঁর এক কোটি ৮৮ লাখ ৬১ হাজার ৮২০ টাকা এবং স্ত্রীর ৫৬ লাখ ৩৬ হাজার ৯৩২ টাকার। স্থাবর সম্পদে সাড়ে ৭৪ শতাংশ অকৃষি জমি যোগ হয়েছে, যার দাম ১৬ লাখ ২৬ হাজার ৯৩১ টাকা। ঢাকার পূর্বাচলে সাড়ে ৭ কাঠা জমি আর দুই কোটি ১৫ লাখ টাকায় ফ্ল্যাট কেনার জন্য অগ্রিম দেওয়া আছে।

তাঁর স্ত্রীর স্থাবর সম্পদ সাত লাখ টাকার ৩০.৪০ শতাংশ কৃষি জমি এবং ১৬ লাখ ২৬ হাজার ৯৩১ টাকার ৭৪.৭৫ শতাংশ অকৃষি জমি। সেই সঙ্গে ঢাকার সাভার এলাকায় ৫ শতাংশ জমি আছে, রাজধানীর এক অভিজাত আবাসিক এলাকায় ৫ কাঠা জমি কেনার জন্য ৭৫ লাখ টাকা বায়না দেওয়া রয়েছে। এ ছাড়া জয়পুরহাট শহরে এক কোটি পাঁচ লাখ টাকার ফ্ল্যাট কেনার জন্য অগ্রিম দেওয়া আছে। নির্ভরশীলদের নামে পেঁচুলিয়া মৌজায় এক কোটি ২৬ লাখ ৭০ হাজার টাকার কৃষি জমি এবং জয়পুরহাট মৌজায় এক কোটি ৫৩ লাখ ৯২ হাজার টাকার অকৃষি জমি রয়েছে। তবে এলাকায় জনশ্রুতি আছে, হলফনামার বাইরেও স্বপন ও তাঁর পরিবারের অনেক সম্পদ রয়েছে।

নির্বাচনী এলাকার তিন উপজেলায় কলেজ সরকারীকরণের নামেও কয়েক কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে এমপি স্বপনের বিরুদ্ধে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ক্ষেতলাল সরকারি ছাঈদ আলতাফুন্নেছা কলেজ পরিচালনা কমিটির সাবেক একজন সদস্য অভিযোগ করেন, কলেজের একজন প্রভাষক নিয়োগে ১৩ লাখ টাকা নিয়ে শিক্ষার্থীদের জন্য বাস কিনে দেবেন বলেছিলেন কলেজের তৎকালীন সভাপতি স্বপন এমপি। কিন্তু এমপি সাহেব কথা রাখেননি।

জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক গোলাম মাহফুজ চৌধুরী অভিযোগ করেন, নবম সংসদ নির্বাচনে স্বপন মনোনয়ন পাওয়ার পর আমরা কয়েকজন টাকা দিয়ে সহযোগিতা করেছি। তাঁকে সিগারেট পর্যন্ত কিনে দিতে হয়েছে। এখন তিনি অঢেল সম্পদের মালিক। নেতাকর্মীদের সঙ্গে তিনি কুকুর-বিড়ালের মতো ব্যবহার করতেন।

ক্ষেতলাল উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আনোয়ারুজ্জামান তালুকদার নাদিম বলেন, স্বপন জনবিচ্ছিন্ন ও হাইব্রিডদের দিয়ে দল পরিচালনা করে ত্যাগী নেতাকর্মীদের কোণঠাসা করে রেখেছিলেন। তাঁর ভয়ে কেউ মুখ খুলতে সাহস পেতেন না।