রাজনৈতিক ঐক্যে রাষ্ট্রপতি ইস্যুর সমাধান

সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগপত্র ইস্যুতে রাষ্ট্রপতি মোঃ সাহাবুদ্দিনের মন্তব্যের পর অন্তর্র্বতীকালীন সরকারের ভেতরে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়েছে। একাধিক উপদেষ্টা ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়াও ব্যক্ত করেছেন। গতকাল মঙ্গলবার বঙ্গভবন ঘেরাও কর্মসূচি থেকে রাষ্ট্রপতিকে পদত্যাগের জন্য ২৪ ঘণ্টা সময় বেঁধে দিয়েছে শিক্ষার্থীদের কয়েকটি সংগঠন। ওই সময়ের মধ্যে মোঃ সাহাবুদ্দিন রাষ্ট্রপতির পদ না ছাড়লে ‘দুর্বার আন্দোলন’ গড়ে তোলার হুশিয়ারি দিয়েছেন তারা। তবে আইন ও সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রপতিকে পদ থেকে সরিয়ে দেওয়ার প্রক্রিয়া নিয়ে জটিলতা রয়েছে। রাষ্ট্রপতিকে সরিয়ে দেওয়া হলে কিংবা তিনি পদত্যাগ করলে, কার কাছে পদত্যাগ করবেন, পরবর্তী রাষ্ট্রপতি নিয়োগ দেবে কে- এমন প্রশ্ন উঠেছে। এ অবস্থায় আইন বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, সংবিধানে সমাধান না খুঁজে রাষ্ট্রপতিকে অপসারণে রাজনৈতিক ঐকমত্য প্রয়োজন। সংবিধান বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, বিদ্যমান নিয়ম অনুযায়ী সংসদ রাষ্ট্রপতিকে অভিশংসন করতে পারে; কিন্তু সরকার পরিবর্তনের পর সংসদ বাতিল করে দেওয়ায় সেই সুযোগ আর নেই। আবার রাষ্ট্রপতি চাইলে স্পিকারের কাছে পদত্যাগ করতে পারেন; কিন্তু স্পিকার পদত্যাগ করেছেন এবং ডেপুটি স্পিকার কারাগারে থাকায় সেটিও সম্ভব হচ্ছে না। এমন পরিস্থিতিতে শেখ হাসিনার পদত্যাগ ইস্যুতে বক্তব্য দেওয়া রাষ্ট্রপতির পদত্যাগ বা অপসারণের দাবি উঠলেও সেটি সংবিধান অনুযায়ী হওয়া সম্ভব নয়। সুপ্রিমকোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বলেন, একটাই পথ খোলা আছে- প্রধান বিচারপতিকে কিছু একটা করার। যদিও সেটা পুরনো ফরমেট। সংবিধানের একাদশ সংশোধনী প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, তখন দেশে উপরাষ্ট্রপতির পদ ছিল। তখন প্রথমে প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদকে উপরাষ্ট্রপতি হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। পরে তিনি রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব নিয়েছিলেন। এখন আমাদের উপরাষ্ট্রপতি পদ নেই। তার পর রাষ্ট্রপতি রিজাইন করবেন কোথায়? সংবিধানের ৫০-এর ৩ উপ-অনুচ্ছেদে বলা আছে- রাষ্ট্রপতি তার পদত্যাগপত্র পাঠাবেন স্পিকারের কাছে। রাষ্ট্রপতির নিয়োগের বিষয়ে সংবিধানের ৪৮ অনুচ্ছেদে বলা আছে- রাষ্ট্রপতি নিয়োগ দেবেন সংসদের নির্বাচিত সদস্যরা। এখন তো সংসদ নেই, তা হলে কার কাছে পদত্যাগপত্র পাঠাবেন? জটিলতা নিরসন প্রসঙ্গে জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বলেন, আমাদের সংবিধানে অনেক কিছু নেই। একটা অভ্যুত্থান হয়ে সরকার উৎখাত হবে সেটা নিশ্চয়ই সংবিধানে লেখা থাকবে না। কোনো কিছু নেই, এটা ধরে নিয়ে এগোতে হবে। সেক্ষেত্রে প্রধান বিচারপতিকে রাষ্ট্রপতি নিয়োগ দিয়ে দিতে পারে। সেটা করার জন্য রাজনৈতিক ঐক্য লাগবে। কারণ সেটা পরবর্তী সময়ে বৈধতা দিতে হবে। বৈধতা না দিলে এই কার্যক্রম নিয়ে প্রশ্ন থেকে যাবে। তিনি আরও বলেন, যেহেতু রাষ্ট্রপতি পদ ফাঁকা রাখার সুযোগ নেই, তাই সমাধান করতে হবে রাজনৈতিকভাবে। সংবিধানের মধ্যে খোঁজাখুঁজি করতে থাকলে সেখানে কিছু মিলবে না। সংবিধান খুঁজতে গেলে কানা গলিতে হারিয়ে যাবেন। সমাধান হলো রাজনৈতিক ঐক্য। এ ছাড়া সম্ভবন নয়। আরেক জ্যেষ্ঠ আইনজীবী শাহদীন মালিক বলেন, রাষ্ট্রপতিকে অপসারণ করতে পারে সংসদ; কিন্তু সেটি বাতিল করা হয়েছে। আবার তার পদত্যাগেরও সুযোগ নেই। সে কারণে সংবিধান ও আইনগতভাবে তাকে সরিয়ে দেওয়া সম্ভব নয়। তবে স্বৈরাচারী সরকারের বিদায়ের পর সবকিছু তো সংবিধান অনুযায়ী হচ্ছে না। তাই নিয়ম বা সংবিধানের প্রশ্ন অবান্তর। বরং জনআকাক্সক্ষার আলোকে তাকে সরিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা সরকার চাইলে করতেই পারে। তিনি আরও বলেন, আন্দোলনের সঙ্গে ছিলেন না কিংবা বিদায়ী সরকারের ঘনিষ্ঠ হিসেবে অনেককেই তো সরকার সরে যেতে বলেছে। সেসব ক্ষেত্রে তো সংবিধান দেখা হয়নি। সুতরাং রাষ্ট্রপতির ক্ষেত্রেও তা হতে পারে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক শেখ হাফিজুর রহমান কার্জন বলেন, গণ-অভ্যুত্থানের পর সবকিছুই বাতিল করা যেতো। তবে তা না করে কোনোটি বাদ দেওয়া হয়েছে আবার কোনোটি রাখা হয়েছে বলেই এই জটিল পরিস্থিতি সামনে এসেছে। সংবিধান স্থগিত করা হয়নি; কিন্তু আবার সেটি পুরোপুরি অনুসরণও করা হচ্ছে না। সব মিলিয়ে একটি লিগ্যাল অ্যানার্কি বা আইনি নৈরাজ্য তৈরি হয়েছে। ফলে হয়তো অনেক কিছুই করতে হচ্ছে, যা নিয়ম মেনে হবে না। বাংলাদেশে অস্বাভাবিক পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রপ্রধান হওয়া কিংবা বিদায় নেওয়ার ঘটনা নতুন নয়। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান হত্যার ঘটনার পর খন্দকার মোশতাক আহমেদ নিজেকে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করেছিলেন। পরে সামরিক অভ্যুত্থানের মুখে খন্দকার মোশতাক আহমদ একই বছরের ৫ নভেম্বর রাষ্ট্রপতির পদ থেকে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। ওই দিনই সামরিক অফিসারদের অনুরোধে নতুন রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথগ্রহণ করেন তৎকালীন প্রধান বিচারপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েম। ১৯৭৭ সালে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক জিয়াউর রহমানের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করে পদত্যাগ করেন বিচারপতি সায়েম। এ ছাড়া গণ-আন্দোলনের মুখে ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলেন সাবেক সামরিক শাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। ওইদিন প্রথমে পদত্যাগ করেছিলেন তখনকার ভাইস প্রেসিডেন্ট মওদুদ আহমদ। এরশাদ সরকারের পতনের পর পঞ্চম সংসদ নির্বাচন পরিচালনার জন্য তিন মাসের অন্তবর্তীকালীন বা অস্থায়ী একটি সরকার গঠন করা হয়েছিল। ওই সময় আওয়ামী লীগ এবং বিএনপিসহ আন্দোলনকারী সব দলের ঐকমত্যের ভিত্তিতে তৎকালীন প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে সেই অস্থায়ী সরকার গঠন করা হয়েছিল। সেজন্য বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদকে প্রথমে উপরাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হয় এবং এর পর তিনি অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করেন। এ ছাড়া তিনি অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব পালনের পর নির্বাচন শেষে প্রধান বিচারপতির পদে ফিরে গিয়েছিলেন। পরে এই দুটি বিষয়ে বৈধতা দেওয়া হয়েছিল সংবিধানের একাদশ সংশোধনীর মাধ্যমে। আইনজীবীদের মতে, রাষ্ট্রপতি মোঃ সাহাবুদ্দিন বর্তমান প্রধান বিচারপতির কাছে পদত্যাগ করলে, প্রধান বিচার বিচারপতি তা গ্রহণ করে নিজেই রাষ্ট্রপ্রধানের দায়িত্ব গ্রহণ করতে পারেন। যদিও পরবর্তী সংসদকে এই প্রক্রিয়ার বৈধতা দিতে হবে। এ জন্য রাজনৈতিক ঐকমত্য প্রয়োজন। জ্যেষ্ঠ আইনজীবী হাসনাত কাইয়ুম বলেন, এখন অস্বাভাবিক সরকার কাজ করছে। তাই সংবিধানের মাঝ দিয়ে বৈধতা-অবৈধতা সাংবিধানিক পদ্ধতিতে খুঁজে পাওয়া কঠিন। তবে সেটাও তারা কাভার করার জন্য আপিল বিভাগ থেকে একটি রেফারেন্স (প্রাসঙ্গিক মতামত বা সুপারিশ) করে নিয়ে আসছে। এখন পর্যন্ত তারা সংবিধানের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণভাবে চলার চেষ্টা করছেন। অর্থাৎ যা সঙ্গতিপূর্ণ নয়, সেগুলো রেফারেন্সের মাধ্যমে করা হয়েছে। তাই অন্তর্র্বতী সরকারের এই রাষ্ট্রপতিকে অপসারণের পদ্ধতি কী হবে, সেটার জন্য তাদেরকে এখন সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগ থেকে রেফারেন্স নিতে হবে। সেই রেফারেন্স অনুয়ায়ী তারা একজনকে বাদ বা নতুন একজনকে নিয়োগ দিতে পারেন। বিদ্যমান আইনি কাঠামোয় এ ছাড়া আর কোনো ব্যবস্থা নেই। গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মুখে দেশত্যাগে বাধ্য হন সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনা। সেদিন রাতে জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে রাষ্ট্রপতি মোঃ সাহাবুদ্দিন বলেছিলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রাষ্ট্রপতির কাছে পদত্যাগপত্র জমা দিয়েছেন এবং তিনি তা গ্রহণ করেছেন। এর আড়াই মাসের মাথায় গত ১৯ অক্টোবর দৈনিক মানবজমিনের একটি প্রতিবেদনে রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দিন মন্তব্য করেন, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগের ‘কোনো দালিলিক প্রমাণ’ তার কাছে নেই। রাষ্ট্রপতির এমন বক্তব্য দেশজুড়ে তোলপাড় সৃষ্টি হয়।