সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগপত্র ইস্যুতে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের মন্তব্যের পর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্বদানকারীদের অনেকেই তার বিদায় চাইলেও আইন ও সংবিধান অনুযায়ী তাকে পদ থেকে সরিয়ে দেয়ার সুযোগ আছে কিনা, সেই প্রশ্ন উঠেছে।
একই সঙ্গে তারা অবশ্য বলছেন যে, গণঅভ্যুত্থানের পর ‘আইন ও সংবিধানের’ বিষয়টিই গুরুত্বহীন হয়ে পড়েছে। ফলে ‘জনআকাঙ্ক্ষার’ আলোকে রাষ্ট্রপতিকে সরিয়ে অন্য কাউকে সে পদে বসাতে চাইলেও’ সেটি অসম্ভবও কিছু নয়। যদিও সরকার পরিবর্তনের পর দেশের সংবিধান স্থগিত করা হয়নি।
অন্যদিকে রাজনৈতিক দলগুলো বিশেষ করে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী রাষ্ট্রপতির তীব্র সমালোচনা করলেও ‘তার পদত্যাগ কিংবা অপসারণের’ দাবির প্রশ্নে সতর্ক অবস্থান নিয়েছে।
বিএনপি দলীয়ভাবে সিনিয়র নেতাদের এ বিষয়ে বিচ্ছিন্নভাবে মন্তব্য না করার পরামর্শ দিয়েছে আর জামায়াতে ইসলামী শুধু বলেছে ‘রাষ্ট্রপতি অসত্য বক্তব্য দিয়ে ওই পদে থাকার অধিকার হারিয়েছেন’।
প্রসঙ্গত, দৈনিক মানবজমিনের প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী তার লেখা এক রিপোর্টে উল্লেখ করেছেন যে রাষ্ট্রপতি তাকে বলেছেন ‘শেখ হাসিনার পদত্যাগের কোন দালিলিক প্রমাণ তার হাতে নেই’।
তার এ বক্তব্যের তীব্র সমালোচনা করে রাষ্ট্রপতির বিরুদ্ধে মিথ্যাচারের অভিযোগ এনেছেন আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল এবং বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা। রাতেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন জায়গায় মিছিল-সমাবেশ করে রাষ্ট্রপতির পদত্যাগ দাবি করেছেন তারা।
সামাজিক মাধ্যমে অন্তর্বর্তী সরকার সমর্থক ও আওয়ামী লীগ বিরোধীরা রাষ্ট্রপতির তীব্র সমালোচনা করে তার পদত্যাগ কিংবা তাকে সরিয়ে দেয়ার দাবি জানাচ্ছে।
গত পাঁচ আগস্ট শেখ হাসিনা দেশ ছাড়ার পর প্রথমে সেনাপ্রধান ও পরে রাষ্ট্রপতি জাতির উদ্দেশ্যে দেয়া ভাষণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদত্যাগ করেছেন এবং তিনি তা গ্রহণ করেছেন বলে জানিয়েছিলেন।
সোমবারের বিতর্কের পর বঙ্গভবন থেকে বিজ্ঞপ্তি দিয়ে বলা হয়েছে -‘মীমাংসিত বিষয়ে নতুন করে কোন বিতর্ক সৃষ্টি না করার জন্য’ রাষ্ট্রপতি সকলের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।
রাষ্ট্রপতিকে কি সরিয়ে দেয়া সম্ভব?
বিদ্যমান নিয়ম অনুযায়ী সংসদ রাষ্ট্রপতিকে অভিশংসন করতে পারে। কিন্তু সরকার পরিবর্তনের পর সংসদ বাতিল করে দেওয়ায় সেই সুযোগ আর নেই। আবার রাষ্ট্রপতি চাইলে স্পিকারের কাছে পদত্যাগ করতে পারেন।
কিন্তু স্পিকার পদত্যাগ করেছেন এবং ডেপুটি স্পিকার কারাগারে থাকায় সেটিও সম্ভব হচ্ছে না। এমন পরিস্থিতিতে শেখ হাসিনার পদত্যাগ ইস্যুতে রাষ্ট্রপতির পদত্যাগ বা অপসারণের দাবি উঠলেও সেটি সংবিধান অনুযায়ী হওয়া সম্ভব নয় বলেই মনে করেন সিনিয়র আইনজীবী শাহদীন মালিক।
তিনি বলেন, রাষ্ট্রপতিকে অপসারণ করতে পারে সংসদ। কিন্তু সেটি বাতিল করা হয়েছে। আবার তার পদত্যাগেরও সুযোগ নেই । সে কারণে সংবিধান ও আইনগতভাবে তাকে সরিয়ে দেয়া সম্ভব নয়। তবে স্বৈরাচারী সরকারের বিদায়ের পর সবকিছু তো সংবিধান অনুযায়ী হচ্ছে না। তাই নিয়ম বা সংবিধানের প্রশ্ন অবান্তর। বরং জনআকাঙ্ক্ষার আলোকে তাকে সরিয়ে দেয়ার ব্যবস্থা সরকার চাইলে করতেই পারে।
এখানে বলে রাখা ভালো যে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসার পর সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ, নির্বাচন কমিশন ও পাবলিক সার্ভিস কমিশন থেকে অনেকেই পদত্যাগ করেছেন।
শাহদীন মালিক বলেন, আন্দোলনের সঙ্গে ছিলেন না কিংবা বিদায়ী সরকারের ঘনিষ্ঠ হিসেবে অনেককেই তো সরকার সরে যেতে বলেছে। সেসব ক্ষেত্রে তো সংবিধান দেখা হয়নি। সুতরাং রাষ্ট্রপতির ক্ষেত্রেও তা হতে পারে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের অধ্যাপক শেখ হাফিজুর রহমান কার্জন বলছেন, গণঅভ্যুত্থানের পর সবকিছুই বাতিল করা যেতো কিন্তু তা না করে কোনটি বাদ দেওয়া হয়েছে- আবার কোনটি রাখা হয়েছে বলেই এই জটিল পরিস্থিতি সামনে এসেছে।
তিনি বলেন, সংবিধান স্থগিত করা হয়নি। কিন্তু আবার সেটি পুরোপুরি অনুসরণও করা হচ্ছে না। সব মিলিয়ে একটি লিগ্যাল অ্যানার্কি বা আইনি নৈরাজ্য তৈরি হয়েছে। এর ফলে হয়তো অনেক কিছুই করতে হচ্ছে, যা নিয়ম মেনে হবে না।
প্রেসিডেন্ট নিজেই বর্তমান সরকারকে শপথ করিয়েছেন। সরকার তাকে সংসদ ছাড়া অভিশংসন করলে বা বাদ দিলে এখন হয়তো কেউ কিছু বলবে না কিন্তু ভবিষ্যতে তো আইনি প্রক্রিয়া নিয়ে কথা উঠতে পারে।
অভ্যুত্থানের পরপরই আন্দোলনকারী সব দল, শ্রেণি ও পেশার প্রতিনিধি নিয়ে আলোচনার ভিত্তিতে আগের সব বাতিল করলে এখনকার সংকটের তৈরি হতো না। তখন রাষ্ট্রপতিকে পরিবর্তন করলেও বলা যেতো যে জরুরি পরিস্থিতিতে জনগণের ম্যান্ডেট অনুযায়ী পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে।
এই বিষয়ে ‘রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলন’ নামে একটি সংগঠনের প্রধান সমন্বয়ক ও সিনিয়র আইনজীবী হাসনাত কাইয়ুম বলেছিলেন, এখন অস্বাভাবিক সরকার কাজ করছে, তাই সংবিধানের মাঝ দিয়ে বৈধতা অবৈধতা সাংবিধানিক পদ্ধতিতে খুঁজে পাওয়া কঠিন। তবে সেটাও তারা কাভার করার জন্য আপিল বিভাগ থেকে একটি রেফারেন্স(প্রাসঙ্গিক মতামত বা সুপারিশ) করে নিয়ে আসছে। এখন পর্যন্ত তারা সংবিধানের সাথে সঙ্গতিপূর্ণভাবে চলার চেষ্টা করছেন। যা সঙ্গতিপূর্ণ না, সেগুলো রেফারেন্সের মাধ্যমে। তাই, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের এই রাষ্ট্রপতিকে অপসারণের পদ্ধতি কী হবে, সেটার জন্য তাদেরকে এখন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ থেকে রেফারেন্স নিতে হবে।
সেই রেফারেন্স অনুয়ায়ী তারা একজনকে বাদ বা নতুন একজনকে নিয়োগ দিতে পারেন। বিদ্যমান আইনি কাঠামোয় এছাড়া আর কোনও ব্যবস্থা নাই।
রাষ্ট্রপতি বিষয়ে দলগুলোর ভাবনা
শেখ হাসিনার পদত্যাগ নিয়ে রাষ্ট্রপতির বক্তব্য প্রকাশের পরপরই তীব্র শোরগোল ও আইন উপদেষ্টার কঠোর সমালোচনার পরেও রাজনৈতিক দলগুলো- বিশেষ করে বিএনপি ও জামায়াত সতর্ক অবস্থান নিয়েছে।
গতকালই এক অনুষ্ঠানে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেছেন, শিক্ষাজীবনে ছাত্রলীগ করা রাষ্ট্রপতি পলাতক শেখ হাসিনাকে পুনর্বাসিত করার চেষ্টা করছেন।
তবে এ বিষয়ে মঙ্গলবার বিবিসির পক্ষ থেকে বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির দুই জন সদস্যের মতামত নেয়া হলেও পরে তারা দুজনই ফোন করে জানান যে, তাদের এ বিষয়ে কোন মন্তব্য না করার জন্য দলীয় হাইকমান্ড থেকে পরামর্শ দেয়া হয়েছে।
তবে দলটির বিভিন্ন পর্যায়ে আরও কয়েকজন নেতার সাথে আলোচনা করে যে ধারণা পাওয়া গেছে, তাতে বিএনপি আসলে বোঝার চেষ্টা করছে যে রাষ্ট্রপতি এ মন্তব্যের ক্ষেত্রে ‘কতটা সিরিয়াস’ ছিলেন। অর্থাৎ তিনি কী তথ্য হিসেবে উল্লেখ করেছেন নাকি সরকারকে কোন ধরনের সংকটে ফেলার চিন্তা থেকে এমন মন্তব্য করেছেন।
আবার দলের একটি অংশ বোঝার চেষ্টা করছে রাষ্ট্রপতির ওই মন্তব্য ‘অন্য কারও প্ররোচনায় হয়েছে কি না’। তবে ‘অন্য কারও’ বলতে কাদের বোঝানো হচ্ছে এমন প্রশ্নের কোন সরাসরি উত্তর মেলেনি।
যদিও দলটির কোন কোন নেতা মনে করেন সরকারের মধ্যেই একটি অংশ আছে যারা ‘দ্রুত গণতন্ত্রে উত্তরণ বা রাজনৈতিক সরকার আসার পথ সুগম’ করতে অনুৎসাহী। রাষ্ট্রপতির মন্তব্যের ক্ষেত্রে তাদের কোন ভূমিকা আছে কি-না তা নিয়েও আলোচনা আছে দলের মধ্যে।
“চাইলে তো রাষ্ট্রপতিকে সরিয়ে যে কাউকে রাষ্ট্রপতি পদে বসিয়ে দিতে পারে। কিন্তু সেটি গণতন্ত্রে উত্তরণে কোন ভূমিকা রাখবে কি-না সেদিকে আমাদের দৃষ্টি থাকবে। এমন কিছু করতে দেয়া যাবে না যেটি দেশকে বিরাজনীতিকরণের দিকে নিয়ে যেতে পারে,” বলছিলেন দলটির একজন সহ-সভাপতি। তিনি তার নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ করেছেন।
স্থায়ী কমিটির একজন সদস্য বিবিসি বাংলাকে বলেছেন অভ্যুত্থানের পর বিদায়ী সরকারের কারোরই বহাল থাকা উচিত নয় বলে তিনি মনে করেন। কিন্তু দলের দিক থেকে নিষেধাজ্ঞা থাকায় তিনি আনুষ্ঠানিক কোন মন্তব্য করতে রাজী হননি।
অন্যদিকে জামায়াতে ইসলামীর মুখপাত্র মতিউর রহমান আকন্দ বলছেন রাষ্ট্রপতি নিজেই বলেছিলেন যে প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগপত্র তিনি পেয়েছেন আর পরে সাংবাদিকদের বলছেন পাননি। এর অর্থ হলো এখন তিনি মিথ্যা বলছেন, যা শপথ ভঙ্গের নামান্তর। এর মাধ্যমে তিনি ওই পদে থাকার অধিকার হারিয়েছেন।
তবে জামায়াতে ইসলামী বর্তমান রাষ্ট্রপতির পদত্যাগ কিংবা অপসারণ চায় কি-না এমন প্রশ্নের সরাসরি জবাব দেননি তিনি।