হামলা-মামলার বিপর্যয় কাটিয়ে ঘুরে দাঁড়িয়েছে বিএনপি

হামলা-মামলা ও নির্যাতনে বিপর্যস্ত বিএনপি এখন বেশ ঘুরে দাঁড়িয়েছে। ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মধ্য দিয়ে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর দলের নেতাকর্মীরা এখন অনেকটা নির্ভার। প্রায় দেড় যুগ ধরে হামলা-মামলা ও জেল-নির্যাতনের ক্লান্তি ভুলে এখন সংগঠন গোছানোর দিকে মনোযোগ দিয়েছেন দলের নীতিনির্ধারকরা।

দলের একাধিক নির্ভরযোগ্য সূত্র জানায়, আগামী নভেম্বর মাস থেকে বিএনপি দলের বিভিন্ন পর্যায়ের কমিটি পুনর্গঠনে হাত দেবে।ডিসেম্বর পর্যন্ত এই কার্যক্রম চলবে। মূলত দলকে নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত করতেই বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান এই উদ্যোগ নিচ্ছেন।

জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট সময়সীমা সরকারের পক্ষ থেকে এখনো ঘোষণা করা হয়নি। আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল একটি বেসরকারি টেলিভিশনে আগামী বছর নাগাদ নির্বাচন হতে পারে বলে নিজের ব্যক্তিগত ধারণা থেকে জানিয়েছেন।সরকারের দিক থেকে আনুষ্ঠানিক ঘোষণা ছাড়া উপদেষ্টার ব্যক্তিগত ধারণাকে নির্বাচনের রোডম্যাপ হিসেবে ধরতে চায় না বিএনপি। ফলে বিএনপির ভেতরে নির্বাচন নিয়ে এক ধরনের অস্থিরতা রয়েছে। পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে অন্তর্বর্তী সরকারের কাছ থেকে সংসদ নির্বাচন আদায় তাঁদের প্রধান চ্যালেঞ্জ বলে মনে করছেন দলের উচ্চ পর্যায়ের নেতারা। তাই সরকারকে চাপে রাখতে নানা কর্মসূচি পালনের আগে দলকে গোছাতে চাইছেন বিএনপির শীর্ষ নেতা।

দলের একজন নীতিনির্ধারক বলেন, বিএনপির একটি দুঃসহ অধ্যায়ের সমাপ্তি হয়েছে ঠিক, কিন্তু নির্বাচন কবে হবে সেই সংশয় রয়ে গেছে। ফলে বিএনপিকে চূড়ান্ত সফলতার জন্য আরেকটি অধ্যায়ের পরিসমাপ্তি ঘটাতে হবে। সেই কাজটি করতে গেলে নানা বাধা আসবে। এই প্রতিকূলতা অতিক্রম করে কিভাবে একটি সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন আদায় করা হবে, সেটি নিয়ে তাদের পরিকল্পনা সাজানো হচ্ছে।

খালেদা জিয়ার ৪৫, তারেক রহমানের ৮০ মামলা
বিএনপির কেন্দ্রীয় দপ্তর সূত্র জানায়, ২০০৯ সাল থেকে হাসিনা সরকারের পতনের আগ পর্যন্ত সারা দেশে দলের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে এক লাখ ৪১ হাজারের মতো মামলা হয়েছে।আসামি করা হয়েছে প্রায় ৫০ লাখ নেতাকর্মীকে। গত নির্বাচনের আগে বেশ কিছু মামলায় বিএনপির কয়েক শ নেতাকর্মীকে সাজা দেওয়া হয়েছে। ওই সব মামলায় নেতাকর্মীরা দীর্ঘদিন কারাগারেও ছিলেন।

তথ্য-উপাত্ত বলছে, আওয়ামী লীগ সরকারের প্রবণতাই ছিল মামলা দিয়ে নেতাকর্মীদের জেলে রাখা। দলের জ্যেষ্ঠ নেতাদের অনেকের বিরুদ্ধে শতাধিক মামলাও ছিল। দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে ৩৭টি মামলা ছিল। ৫ আগস্টের পর দুই মামলায় সাজা মওকুফ করে মুক্তি দিয়েছেন রাষ্ট্রপতি। এখনো তাঁর বিরুদ্ধে ৩৫টি মামলা আছে।

বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বিরুদ্ধে এখনো ৮০টি মামলা রয়েছে বলে জানিয়েছেন তাঁর আইনজীবী বিএনপির আইন সম্পাদক ব্যারিস্টার কায়সার কামাল। তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘তারেক রহমানের বিরুদ্ধে মামলার কয়েকজন বাদী মারাও গেছেন। অনেক বাদীকে বারবার সমন করেও আদালতে হাজির করা যায়নি। ফলে আইনি প্রক্রিয়া অনুযায়ী আটটি মামলা আদালত খারিজ করে দিয়েছেন।’

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু বলেন, ‘আওয়ামী লীগ ছিল মামলাবাজ সরকার। বাংলাদেশে গায়েবি মামলার নজির স্থাপন করেছে তারা। শুধু মিথ্যা মামলা দায়েরই নয়, কিভাবে ওই সব মামলায় আদালতকে ব্যবহার করে সাজা দিতে হয়, সে বিষয়েও কালো অধ্যায় সৃষ্টি হয়েছে আওয়ামী লীগের আমলে।’

দল গোছাতে নজর, নির্বাচনের প্রস্তুতি
বিএনপির দায়িত্বশীল নেতারা জানিয়েছেন, ৭ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে সরকারবিরোধী আন্দোলনে দলের বিভিন্ন পর্যায়ের দুর্বলতা চিহ্নিত করা হয়েছিল। সে অনুযায়ী নির্বাচনের পর নতুন কমিটি গঠনের প্রক্রিয়াও শুরু হয়। কিন্তু ছাত্র-জনতার আন্দোলনের কারণে সেই প্রক্রিয়ায় কিছুটা ছেদ পড়ে। এখন আবার নতুন করে দল গোছানোর কাজে হাত দেওয়া হয়েছে।

দলের দায়িত্বশীল নেতাদের মতে, বিএনপির ৮২ সাংগঠনিক জেলার মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটি বিলুপ্ত করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এরই মধ্যে বেশ কয়েকটি ভেঙে দেওয়া হয়েছে।

বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবীর রিজভী বলেন, ‘সংগঠন পুনর্গঠন একটি দলের চলমান প্রক্রিয়ার অংশ। এরই ধারাবাহিকতায় সাংগঠনিক কার্যক্রম চলছে। আগামী মাসে পুনর্গঠনের কাজ আরো জোরদার হবে।’

নেতাকর্মীরাও উদ্দীপ্ত
দলের নেতাকর্মীরা মনে করেন, তাঁরা এখন ডরভয়হীন। মিথ্যা মামলা কিংবা রাষ্ট্রশক্তির নির্যাতনের ভয় নেই। দলীয় চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া স্থায়ী মুক্তি পেয়েছেন। যুক্তরাজ্যে অবস্থানরত দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানেরও দেশে ফেরার প্রক্রিয়া চলছে। নেতাকর্মীরাও ‘মিথ্যা’ মামলা থেকে নিষ্কৃতি পাচ্ছেন, কারাগার থেকে বের হয়েছেন নেতাকর্মীরা। সব মিলিয়ে সারা দেশের নেতাকর্মীদের মধ্যে একটি উদ্দীপ্ত ও চাঙ্গাভাব বিরাজ করছে।

বেড়েছে কূটনীতিক তৎপরতাও
বিএনপির দায়িত্বশীল নেতারা বলেন, বহির্বিশ্বের সঙ্গে কূটনীতিক সম্পর্ক জোরদার করাটাও তাঁদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে বিএনপির দায়িত্বশীল নেতারা ঢাকায় নিযুক্ত বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূতদের সঙ্গে বৈঠক করছেন। এরই মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ প্রায় সব দেশের সঙ্গে দলের জ্যেষ্ঠ নেতাদের বৈঠক হয়েছে। এসব বৈঠকে বিএনপি নির্বাচন এবং দলটির বর্তমান করণীয় নিয়ে বিদেশিদের বার্তা দিচ্ছে।