রাজশাহীর দানব হয়ে উঠেছিলেন ডাবলু

রাজশাহীতে বেপরোয়া হয়ে উঠা আওয়ামী লীগ নেতা ডাবলু সরকারের গ্রেফতারের পর মুখ খুলতে শুরু করেছেন ভুক্তভোগীরা। রাজনীতিতে ডাবলুর দ্রুত উত্থান নিয়ে বিভিন্ন মহলে চলছে নানা আলোচনা। চাঁদাবাজি থেকে শুরু করে টেন্ডারবাজিসহ নানা অপকর্ম করে ডাবলু মাত্র ১০ বছরে কোটি কোটি টাকার সম্পদ গড়েছেন। নগরীজুড়ে দাপিয়ে বেড়াত তার সশস্ত্র ক্যাডাররা। ভাইদের নিয়ে সিন্ডিকেট গড়ে নিজ এলাকা নগরীর কুমারপাড়া ও আলুপট্টিতে কয়েকজন সংখ্যালঘুর জমি-বাড়ি পানির দামে কিনে নেন ডাবলু। সেখানেই গড়ে তুলেছেন সরকার টাওয়ার। আশপাশের এলাকাতেও ডাবলুর দখল করা জমিতে বাড়ি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন। তবে তার পৈতৃক বাড়ি কুমারপাড়ায়।

স্থানীয়রা জানান, বাবা আব্দুর রশিদ সরকার রাজাকার হলেও ছাত্রলীগের রাজনীতিতে হাতেখড়ি হয় ডাবলু সরকারের। এক সময় আলুপট্টি কুমারপাড়া মোড়ে একটা ছোট চেয়ার টেবিল পেতে বিআরটিসি বাসের টিকিট বিক্রি করতেন। পরে তিনি মহানগর আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক হন। পর্যায়ক্রমে হন মহানগর স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদক। কেন্দ্রীয় নেতাদের আশীর্বাদে তাবৎ বড় বড় নেতাদের টেক্কা দিয়ে ২০১৪ সালের ২৩ অক্টোবর প্রথমবার মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হন ডাবলু। একইভাবে ২০২০ সালের ১ মার্চ ডাবলু সরকার পুনরায় মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হন।

মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হয়ে বেপরোয়া দখলবাজি শুরু করেন ডাবলু ও তার ভাইয়েরা। কুমারপাড়া মোড়ে আট কাঠা জমির ওপর সখিনা বোডিং নামের একটি পুরোনো হোটেল ছিল। ডাবলু সরকার ও তার ভাইয়েরা মিলে বোর্ডিংটি প্রথমে কব্জা করেন। এর মালিক ভয়ে কম দামে বিক্রি করেন ডাবলুর কাছে। আলুপট্টিতে থাকা বিআরটিসির একটি জায়গাও দখল করেন বলে এলাকাবাসী জানিয়েছেন। এলাকার বাসিন্দা মুকুল জানান কুমারপাড়া বরোদা মন্দিরের সামনের একটি জায়গা দখল করে ডাবলু তৈরি করেছেন গ্যারেজ।

অভিযোগে জানা গেছে, নগরীর ভেতরে যেখানেই জমি নিয়ে দুই পক্ষের দ্বন্দ্ব বিবাদ হতো ডাবলু সরকার সেখানেই মাথা ঢুকাতেন। এমন শতাধিক অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। সাহেব বাজার জিরো পয়েন্টে গড়ে উঠা জলিল মার্কেট নিয়ে বিবাদ তৈরি হলে মীমাংসার নামে ডাবলু সরকার সেখানে ভাগ বসান। পরে নাম মাত্র মূল্যে মার্কেটের অংশীদার হয়ে যান। তার ক্ষমতার দাপটে মালিকরা তাকে অংশীদার বানাতে বাধ্য হন। এভাবে নগরীর ছোট বনগ্রামসহ বিভিন্ন এলাকায় বিপুল জমির মালিক হয়েছেন ডাবলু সরকার।

জানা যায়, ২০১৯ সালে ডাবলু সরকারের বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) অভিযোগ করা হয়। ওই সময় দুদক ডাবলু সরকারের বিরুদ্ধে অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে অনুসন্ধান কার্যক্রম বন্ধ রাখতে কমিশনকে বাধ্য করা হয়। জানা যায়, ডাবলু সরকারের দখলবাজি ও চাঁদাবাজির প্রতিকার চেয়ে নগরীর কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা ওই সময় তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর কাছেও লিখিত অভিযোগ করেছিলেন। কিন্তু আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের হস্তক্ষেপে ডাবলুর বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া থেকে বিরত থাকে দল। এতে আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠেন ডাবলু সরকার।

এদিকে নগরীর কুমারপাড়া এলাকার বাসিন্দা আসগর আলী বলেন, কিছুদিন আগেও কুমারপাড়া এলাকার রঘু সাহা ৫ কাঠা জমির বাড়িতে বসবাস করতেন। কিন্তু তাদের উচ্ছেদ করে জমিটি দখল করে নেন ডাবলু সরকার। এর বাইরেও তিনি কুমারপাড়া ও আলুপট্টি এলাকায় বেশকিছু জমি দখল করেছেন বলে শুনেছি। পরিবারটি এখন কোথায় গেছে এলাকার মানুষ বলতে পারেননি। নগরীর সাহেব বাজার এলাকার মাজদার হোসেন নামের একজন ব্যবসায়ী বলেন, মার্কেট জমি কোনো কিছুই বাদ যায়নি ডাবলুর রাহু গ্রাস থেকে।

জানা গেছে, ডাবলু সরকার পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়েতে একচেটিয়া টেন্ডারবাজি করেছেন। এছাড়া শিক্ষা প্রকৌশলী, গণপূর্ত, ওয়াসা, হাসপাতাল, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, রুয়েট, স্বাস্থ্য প্রকৌশল দপ্তরে দলীয় প্রভাব খাটিয়ে কাজ নিয়ে বেশি দামে অন্য ঠিকাদারদের কাছে বিক্রি করে দিতেন। ডাবলুর নিজের অহনা ট্রেডার্স নামের একটি ঠিকাদারি লাইসেন্স থাকলেও তা দেখিয়ে কাজে নিতেন ঠিকই কিন্তু কাজ বিক্রি করে দিতেন। মোমিনুল নামের একজন ঠিকাদার বলেন, গত কয়েক বছরে কোনো ঠিকাদার কাজ পেতেন না ডাবলুকে না বললে। ডাবলু নগরীতে পুকুর ভরাট ও দখল সিন্ডিকেটেরও হোতা ছিলেন। মহানগর যুবলীগের সাবেক সভাপতি রমজান আলীর সঙ্গে জোট করে পানির দামে পুকুর কিনে নিতেন। অবৈধভাবে এসব পুকুর ভরাটের পর প্লট করে বিক্রি করেছেন চড়া দামে। নগরীর সপুরা এলাকার সুখানদিঘি নামের একটি বড় পুকুর ভরাটের চুক্তিতে বিনা টাকায় অংশীদার হন ডাবলু। এই পুকুরটি একজন অংশীদার করার শর্তে বলেন, পুকুরটিতে পাওয়া ভাগের অংশ বিক্রি করে মোটা টাকা নিয়ে কেটে পড়েন।

এদিকে নগরীর পবা এলাকার মাটি ব্যবসায়ী খাইরুল বাসার বলেন, নগরীতে ডাবলুর ক্যাডার বাহিনীর নজর ছিল সর্বত্র। কে কোথায় জমির মাটি বাড়ি বিক্রি করছেন তা তাৎক্ষণিক জানতে পেরে সেখানে গিয়ে বাগড়া দিতেন। ক্ষমতার প্রভাব খাটিয়ে ক্রেতা-বিক্রেতা উভয়ের কাছ থেকেই নিতেন মোটা অঙ্কের চাঁদা। ডাবলুকে না জানিয়ে নগরীতে কোনো জমি বাড়ি বিক্রি করতে পারেনি কোনো মালিক। এভাবেই সে কোটি কোটি টাকা অবৈধভাবে কামিয়েছেন। ৪ অক্টোবর রাতে ডাবলুর গ্রেফতারের খবর ছড়িয়ে পড়লে সামাজিক মাধ্যমে শোরগোল পড়ে যায়। তার শাস্তির দাবিতে বিভিন্নজন সামাজিক মাধ্যমে পোস্ট দিয়েছেন। বর্তমানে তিনি রিমান্ডে রয়েছে।

অন্যদিকে নগরীর আলুপট্টি থেকে সোনাদিঘি মোড় গণকপাড়াসহ আশপাশের এলাকার ফুটপাতের দোকানিদের কাছ থেকে নিয়মিত চাঁদা তুলতেন ডাবলুর ছত্রছায়ায় থাকা দলীয় ক্যাডাররা। এসব ক্যাডার পরিচালনা করতেন ডাবলুর দুই ভাই নগর স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদক জেডু সরকার ও ২২নং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শেডু সরকার। আমান উল্লাহ নামের একজন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী বলেন, ডাবলু ও তার ভাইয়েরা ছোট-বড় বিভিন্ন দোকান থেকে চাঁদা নিতেন। কেউ চাঁদা দিতে রাজি না হলে পুলিশ দিয়ে হয়রানি করতেন।

৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার আন্দোলন চলাকালে ডাবলুর নেতৃত্বে ছাত্র-জনতার ওপর সশস্ত্র হামলা ও গুলিবর্ষণ করা হয়। গুলিতে নিহত শিবির নেতা রায়হান আলী হত্যা মামলায় মহানগর পুলিশ তাকে ৫ দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করছে।

আরএমপির গণমাধ্যম শাখার মুখপাত্র অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার (এডিসি) সাবিনা ইয়াসমিন জানান, দুটি হত্যাসহ ডাবলু সরকারের বিরুদ্ধে মোট ৮টি মামলার তথ্য রয়েছে। শনিবার তাকে সব মামলাতেই গ্রেফতার দেখানো হয়েছে।