সাবেক সরকারের আমলে আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্স নেওয়া ব্যক্তিদের অনেকে যথাযথ বিধি অনুসরণ করেননি। এ জন্য আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে গত সাড়ে ১৫ বছরে দেওয়া সব আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্স স্থগিত করা হয়েছে। অনেক অস্ত্রের মালিকের টিআইএন (করদাতা শনাক্তকরণ নম্বর) নেই, রিটার্নের তথ্যেও রয়েছে গরমিল। এ ক্ষেত্রে আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্সের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে। বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দেওয়ায় অন্তর্বর্তী সরকার এসব লাইসেন্স স্থগিত করে ৩ সেপ্টেম্বরের মধ্যে সব অস্ত্র জমা দিতে নির্দেশ দেয়। বাংলাদেশ পুলিশ সদর দপ্তর সূত্র জানায়, সব আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্স স্থগিত করার পর অস্ত্র জমা পড়েছে ১৩ হাজার ৩৪৯টি। তবে দেশের বিভিন্ন স্থানে অনেক অস্ত্র জমা দেওয়া হয়নি।এ ব্যাপারে পুলিশ সদর দপ্তরের গণমাধ্যম ও জনসংযোগ বিভাগের সহকারী মহাপরিদর্শক (এআইজি) ইনামুল হক সাগর কালের কণ্ঠকে বলেন, মোট কত অস্ত্রের লাইসেন্স দেওয়া হয়েছে, সেই সংখ্যাটা আমার জানা নেই। কত অস্ত্র জমা পড়েছে, সেই তথ্যটা আমি জানি। তার মানে এটা নয়, কর্তৃপক্ষও জানে না বিষয়টা। কর্তৃপক্ষ অবশ্যই সংখ্যাটা জানে।এই সংখ্যাটা অজানা নয়।
দেশের বিভিন্ন কর অঞ্চলের যাচাই-বাছাইয়ে দেখা গেছে, অনেক আগ্নেয়াস্ত্রধারীর টিআইএন নেই। অথচ আগ্নেয়াস্ত্র কেনার ক্ষেত্রে শুধু টিআইএন নয়, দুই লাখ টাকার বেশি রিটার্ন জমা দেওয়া বাধ্যতামূলক ছিল। দুই লাখ টাকা রিটার্ন দিতে হলে সেই স্বাভাবিক ব্যক্তি করদাতাকে কমপক্ষে ১৭ লাখ ৫০ হাজার টাকা বৈধভাবে আয় করতে হবে।
গত বৃহস্পতিবার এনবিআর চেয়ারম্যান আবদুর রহমান খান কোন কোন ক্ষেত্র থেকে আয়কর আদায় বাড়ানো যায়—এ বিষয়ে অনলাইন প্ল্যাটফরম জুমে একটি সভা করেন।
সেখানে এনবিআরের আয়কর অনুবিভাগের সব সদস্য, সব কর অঞ্চলের কমিশনারসহ সংস্থার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। বিভিন্ন আলোচনার পাশাপাশি লাইসেন্স স্থগিত করা অস্ত্রের মালিকরা আয়কর রিটার্ন দিয়েছেন কি না—এ বিষয়টি উঠে আসে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এনবিআরের একজন শীর্ষ কর্মকর্তা বলেন, বিভিন্ন কর অঞ্চলের কমিশনাররা বিষয়টি নিয়ে কাজ করছেন। দেখা যাচ্ছে, টিআইএন নেই এমন মানুষও অস্ত্রের লাইসেন্স পেয়েছেন। অনেকে কায়দা করে কয়েক বছর বেশি আয় দেখিয়ে বেশি রিটার্ন দিয়ে লাইসেন্স নিয়েছেন। লাইসেন্স পাওয়ার পর আর কর দেন না।
তিনি বলেন, সিলেট কর অঞ্চলের কমিশনার এ বিষয়ে কাজের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি এগিয়েছেন। তিনি বিভিন্ন সমস্যার কথা জানিয়েছেন। তথ্যের জন্য সিলেটের জেলা প্রশাসকের সঙ্গে যোগাযোগ করলেও তাঁকে কোনো তথ্য দেওয়া হচ্ছে না। আমরা জেনেছি, পুলিশের কাছে বা প্রশাসনের কাছে গত সাড়ে ১৫ বছরে দেওয়া লাইসেন্সের সঠিক তথ্য নেই। নীতিমালা লঙ্ঘন করে যাঁরা অস্ত্র কিনেছেন, তাঁদের প্রকৃত উদ্দেশ্যও একটা ভয়ের কারণ। চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন কর অঞ্চলের কমিশনারদের সিলেট কর অঞ্চলের আদলে কাজ করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
এ ব্যাপারে সিলেট কর অঞ্চলের কমিশনার সৈয়দ জাকির হোসেন বলেন, ‘আমরা নিবন্ধিত বৈধ অস্ত্রের তালিকা সংগ্রহ করেছি। তালিকার মধ্যে টিআইএন লেখা নেই। আমরা এখনো যাচাই করতে পারিনি, যাচাই করা হলে বলতে পারব প্রকৃতপক্ষে কার কার টিআইএন নেই। সিলেট জেলার তালিকা এখনো সংগ্রহ করা হয়নি। সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার ও হবিগঞ্জের আছে। সেখানে দুই হাজার ৮৬০ জনের তালিকা আছে। আমরা রিটার্ন যাচাই নিয়ে কাজ করছি।’
তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে সিলেট কর অঞ্চলের একটি সূত্র জানায়, এ পর্যন্ত ৭০০ জনের তালিকা যাচাই করা হয়েছে। এর মধ্যে ৫০০ জনের নামে কোনো টিআইএন পাওয়া যায়নি।
এ প্রসঙ্গে সিলেটের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ শের মাহবুব মুরাদ বলেন, ‘আমি জেলা প্রশাসক হিসেবে নতুন জয়েন করেছি। বিষয়টি নিয়ে যখন কাজ করব, তখন বলতে পারব।’
নিয়ম অনুযায়ী, বৈধভাবে অস্ত্র কিনতে হলে ১৮৭৮ সালের আর্মস অ্যাক্ট এবং ১৯২৪ সালের আর্মস রুলস আইনের আওতায় সামরিক বা বেসামরিক কোনো নাগরিককে বৈধ আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্স দেওয়া হয়। তবে অস্ত্র কিনতে হলে কিছু মানদণ্ড পূরণ করতে হয়। এর মধ্যে রয়েছে ২৫ থেকে ৭০ বছর বয়সী বাংলাদেশের বৈধ নাগরিক হওয়া, জীবনের ঝুঁকি থাকলে, বছরে ন্যূনতম দুই লাখ টাকা আয়কর রিটার্ন জমা দেওয়া, অনুমতি পেলে আমদানি অথবা কোনো ডিলারের কাছ থেকে সর্বোচ্চ দুটি আগ্নেয়াস্ত্র সংগ্রহ করতে পারবেন।
আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্স পাওয়ার জন্য একজন নাগরিককে তাঁর স্থায়ী ঠিকানা যে জেলায়, সেখানকার জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে লাইসেন্স ও আগ্নেয়াস্ত্র বিভাগ থেকে আবেদনপত্র সংগ্রহ করতে হবে। এ ক্ষেত্রে পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চ (বিশেষ শাখা) তদন্ত করে আবেদনকারীর তথ্য মিলিয়ে দেখে একটি প্রতিবেদন দেয়। এরপর জেলা প্রশাসকের অনুমোদনের পর সেটি পাঠানো হয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে। মন্ত্রণালয় অনাপত্তিপত্র দিলে জেলা প্রশাসক ওই আবেদনকারীর বরাবরে আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্স ইস্যু করেন।
এ ক্ষেত্রে আবেদনপত্রের সঙ্গে বৈধ নাগরিকত্বের সনদপত্র, জাতীয় পরিচয়পত্রের ফটোকপি, আয়কর সনদের ফটোকপি, ছয় কপি পাসপোর্ট সাইজের ছবি এবং লাইসেন্স ফি জমা দিতে হবে।
সাড়ে ১৩ হাজার অস্ত্র জমা পড়লেও সঠিক তথ্য না থাকায় বোঝা সম্ভব হচ্ছে না প্রকৃতপক্ষে কত অস্ত্র এখনো মানুষের হাতে রয়ে গেছে। তবে নির্ধারিত সময় পেরিয়ে যাওয়ার পর যাঁরা অস্ত্র জমা দেননি, তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা জানিয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
সার্বিক বিষয়ে মাওলানা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্সের অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ উমর ফারুক বলেন, অস্ত্রের বিষয়টা খুব সংবেদনশীল। যাচাই-বাছাই না করে কোনো ব্যক্তিকে যদি সরকার লাইসেন্স দিয়ে থাকে, এটা খুবই বাজে কাজ হয়েছে। অনেক মানুষ এখন এগুলো দিয়ে নানা অপকর্ম করছে। তিনি বলেন, যাঁর আত্মরক্ষার জন্য অস্ত্র লাগবে, এ জন্য নীতিমালা আছে। যত্রতত্র লাইসেন্স দেওয়া রাষ্ট্র ও নাগরিক জীবনের জন্য হুমকি।