ভালোবাসা যত পুরানো হয়, উচ্ছ্বাস তত কমে, অভিজ্ঞতার ভারে তার ভিত মজবুত ও পাকাপোক্ত হয় আরো বেশি। সম্পর্কের সমীকরণ ঠিক কতটা মজবুত হবে, তা শুধু একে অপরের প্রতি ভালোবাসার ওপরই নির্ভর করে না। ভালোবাসা ছাড়াও সম্পর্ক দীর্ঘস্থায়ী করতে আরও কয়েকটি বিষয় মাথায় রাখতে হয়। দীর্ঘদিন প্রেমের সম্পর্ক টিকিয়ে রাখতে দুই পক্ষেরই তাই কিছু বিষয়ে যত্নবান হওয়া উচিত। বাঁধাহীন আবেগ, সঙ্গীর জন্য অন্তহীন অপেক্ষা, দুচোখ ভরা স্বপ্ন, সবকিছুই ঠিকঠাক চলছে। মাঝে মাঝে নতুন নতুন উপহার দিয়ে চমকে দিতেও ভালো লাগে। তবে হঠাৎ হতে পারে ছন্দপতনও।
ভালোবাসা মানুষের মনের আবেগ ও অনুভূতিকে বুঝায়। যা দেখা যায় না, ধরাও যায় না কিন্তু অনুভব করা যায়। মানুষ সেই ভালোবাসাকে তার মুখের কথা, চোখের ইশারা, বা তার বিভিন্ন অঙ্গ প্রত্যঙ্গ দিয়ে বিভিন্ন অঙ্গভঙ্গির মাধ্যমে প্রকাশ করে। ভালোবাসা হচ্ছে কারো প্রতি অতিরিক্ত স্নেহের বহিঃপ্রকাশ। সেটা হতে দুজন দুজনের প্রতি অথবা একজন অন্যজনের প্রতি। তবে সাধারণত একতরফা ভালোবাসাকে পূর্ণাঙ্গ ভালবাসা বলা হয় না, ভালোবাসা হচ্ছে দুটি হৃদয়ের মিলন যেখানে একজন অন্যজনের প্রতি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এটি হতে পারে শারীরিক বা মানবীয়। তবে যে সম্পর্ক শুধু শরীর নির্ভর সেটাকে ভালোবাসা বলে না, সেটাকে বলে জৈবিক চাহিদা।
প্রেমে পরা যত সহজ, সম্পর্ক টিকিয়ে রাখা তত কঠিন। এক দেখায় প্রেমে পরে যাওয়া যায়, কিন্তু এক ইচ্ছাতেই সারাজীবন এক ছাদের নিচে থাকতে পারা এত সহজ না। সম্পর্ক টিকিয়ে রাখার মতো ধৈর্য কয়জনের মধ্যে থাকে? সম্পর্কের শুরুতে দুজনেরই সমস্ত হৃদয় জুড়ে শুধু ভালোবাসা, কেয়ারিং, যত্ন, সংবেদনশীলতা, শ্রদ্ধায় পূর্ণ থাকে। আস্তে আসতে তা তিক্ততা, অসহ্য, বিরক্তিতে রূপ নেয়। বদলে যায় সবকিছু। শুরু হয় বোঝাপড়ার অভাব, কখনো-বা মনের মিলের ফারাক হয়ে থাকে প্রকট। যা মেনে এবং মানিয়ে নেওয়ার মানসিক শক্তি পর্যন্ত থাকে না সবসময়।
কোনো একটা সম্পর্ক টিকবে কিনা তা বলে দেওয়া অসম্ভব। কিন্তু তা কোনদিকে এগোচ্ছে তা বলে দেওয়া যায় কিছু লক্ষণের উপর ভিত্তি করে। এই লক্ষণগুলো যদি কোনো সম্পর্কের মধ্যে থেকে থাকে তাহলে হয় সংশোধন বা সরে আশাই একমাত্র সমাধান।
যে ভালোবাসার মধ্যে স্বার্থ চলে আসবে তা বেশি দিন টিকে না। কারণ সে ভালোবাসার মধ্যে থাকে লোভ লালসা। বিয়ের আগে শারীরিক সম্পর্ক একটি ভালোবাসা ভেঙ্গে যাওয়ার মূল হাতিয়ার হিসেবে ধরে নেওয়া হয়। আসলে ভালোবাসা হচ্ছে এক ধরণের আকর্ষণ যা নেশার মতো কাজ করে। কিন্তু পারিবারিক বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার আগে দৈহিক বন্ধন হয়ে গেলে সেই আকর্ষণ আর থাকে না। তাই বর্তমান সময়ের বেশিরভাগ সম্পর্কই ভেঙ্গে যাচ্ছে।
গবেষণায় দেখা গেছে প্রেমে পড়লে মানুষের শরীরে টেস্টোস্টেরন হরমোন বেড়ে যায়, ফলে এক সঙ্গী অন্য সঙ্গীর প্রতি আকৃষ্ট হতে থাকে। প্রেমের সর্বোচ্চ পর্যায়ে প্রেমিক-প্রেমিকার দেহে ডোপামিন নামে এক ধরনের হরমোন বেড়ে যায় যাকে সুখের হরমোন বলা হয়ে থাকে। আর এই সুখের হরমোন মানুষের মনের অনুভূতি সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌছে দেয়। ডোপাটিন হরমোনের ফলে আবেগ নিয়ন্ত্রণের হরমোন সেরোটোনিন কমে যায় ফলে দুজন মানুষ দুজনকে ছাড়া থাকতে পারে না বা কল্পনাও করতে পারে না।
আজকাল ভালোবাসার বাণী নিভৃতে কাঁদে। একটি সম্পর্ক হতেও দেরি লাগে না আবার ভাঙতেও দেরি লাগে না। এগুলো আসলে ভালোবাসার গল্প না, একগুলো হলো দৈনন্দিন চাহিদার কথা। একজন মানুষকে দেখে আপনার ভালো লাগতেই পারে, কিন্তু এই নয় যে সাথে সাথেই তাকে ভালোবাসতে হবে। আগে একসাথে চলতে হবে, একজন আরেকজনকে বুঝতে হবে, জানতে হবে। আসলে একশ বছর একসাথে চলেও অনেক সময় মানুষের মন বুঝা যায় না। তারপরেও একজন অন্যজনের সাথে কিছু সময় চললে একজন অন্যজন সম্পর্কে অনেকটা ধারণা নিতে পারে। আগে বন্ধুর মতো চলে সম্পর্কের শুরুটা হওয়া উচিত তারপর যদি মনে হয় এখানে একটি ভালোবাসা হতে পারে তবেই দুজন প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হওয়া উচিত।
আজকাল একজন নারী বা একজন পুরুষ একজন আরেকজনকে সহযোগী মনে করে না। দুজন দুজনের প্রতিযোগী ভাবে। তাই দিন দিন পারিবারিক কলহ মারাত্মক আঁকার ধারণ করছে। আরেকটি বিষয় দেখা যাচ্ছে আজকাল বিয়ে হচ্ছে সৌন্দর্যের সাথে ক্যারিয়ারের। একটা সময় ছিল যখন মানুষ ছেলেমেয়েদের বিয়ে দিতো বংশ দেখে। কিন্তু সেই প্রথা আজ বিলুপ্তের পথে। ছেলে বড় চাকরি করে আর মেয়ে সুন্দরী এটাই এই যুগে ছেলে মেয়েদের বিয়ের ক্ষেত্রে বড় যোগ্যতা। একটা পরিবারের সাথে আরেকটা পরিবারের বা একটা ছেলের সাথে আরেকটা মেয়ের মনের মিল হলো সংসার টেকার পুর্বশর্ত। টাকা পয়সা, ক্যারিয়ার বা সৌন্দর্য মুখ্য বিষয় হতে পারে না। যেখানে এগুলো মুখ্য হয়ে যায় সেখানে আর ভালোবাসা থাকে না।
একসাথে চলতে গেলে ভুল বোঝাবুঝি হবে এটা একদমই স্বাভাবিক। তবে তা অতি দ্রুত সময়ের মধ্যে মিটিয়ে নিতে হবে। তবেই সম্পর্ক থাকবে মজবুত এবং ভালোবাসাময়। কিন্তু ভুল বোঝাবুঝি ঝুলিয়ে রাখছেন তো আপনার সম্পর্কের বিচ্ছেদ আপনি নিজেই ডেকে আনছেন। ভুল বোঝাবুঝি গতিশীল সম্পর্ককে গতিহীন করে দেয়। আর এর পরিমাণ বারতে থাকলে একদমই বিচ্ছেদের সামনে এনে দিবে আপনার তিলে তিলে গড়া সম্পর্ককে।
একে অপরকে ভালোবাসেন। কিন্তু একজন অন্যজনকে কোনো বিষয়ে বিশ্বাস করতে পারছেন না। সম্পর্কের মূল ভিত্তি হলো আস্থা বা বিশ্বাস। সঙ্গীর কাছে বিশ্বস্ত না হলে যতই তাকে ভালোবাসুন না কেন, সম্পর্ক টিকবে না। সম্পর্কে অনাস্থার বিষয়টি স্পষ্ট হলে পারস্পরিক ভালোবাসা গভীর হতে পারে না।
দুই মেরুর মানুষের মধ্যে যত ভালোবাসার আদান-প্রদান হোক, যদি ভবিষ্যত নিয়ে পরিকল্পনা সামঞ্জস্যপূর্ণ না হয় তাহলে সম্পর্ক স্থায়ী হয় না। একজন চাইছেন বিদেশে উচ্চশিক্ষা নিতে, অন্যজন চাইছেন দেশে থেকে মানুষের সেবা করতে। দুজন মানুষের মনের মিল না হলে সম্পর্কের রসায়ন যতই ভালো থাকুক, ভালোবাসা এগোবে না। তাই ভবিষ্যত নিয়ে একা একা পরিকল্পনা না করে সঙ্গীর সঙ্গে পরামর্শ নিন এবং তার পছন্দ-অপছন্দ খেয়াল করুন।
ভালোবাসার সম্পর্কে পরিবার খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সঙ্গী আপনাকে ভালোবাসলেও শুধু পরিবারের পছন্দ না থাকার কারণে সম্পর্ক ত্যাগ করতে হয় অনেক সময়। সঙ্গীকে কাছে পেতে তার পরিবারের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক রাখতে হবে। কিন্তু তারা যদি আপনাকে অপছন্দ করেন, তবে বুঝে নিতে হবে যে সম্পর্কটি এগোবে না।
মনের ভেতরে ভালোবাসা পুষে রাখলেই চলে না। সেটি বিভিন্নভাবে প্রকাশ করাও দরকার। দুজন মানুষের মধ্যে বোঝাপড়া ভালো হওয়া খুব জরুরি। কিন্তু এই বোঝাপড়া ভালোমতো না থাকলে ভালোবাসা যতই থাক, সম্পর্ক এগোবে না। একে অপরের পাশে থাকুন। পরিস্থিতি যতই জটিল হোক, যতই বাধাবিপত্তি আসুক, পরস্পরের হাত শক্ত করে ধরে রাখুন। একে অপরের খারাপ সময়ে মানসিক সাপোর্ট দিন। সম্পর্ক ভালো রাখতে মানবিক স্পর্শ জরুরি।