জামায়াতের সঙ্গে দূরত্ব রেখে চলবে বিএনপি

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর বিএনপি ও বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর মধ্যে সম্পর্কের অবনতি ঘটেছে। ‘আওয়ামী লীগশূন্য’ রাজনীতির মাঠে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে মুক্ত জামায়াতের ভূমিকায় এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে বলে বিএনপি মনে করে। এ অবস্থায় জামায়াতের সঙ্গে দূরত্ব বজায় রাখার নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে দলটি। বিএনপির নীতিনির্ধারণী সূত্রে এ কথা জানা গেছে। এ প্রসঙ্গে বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ^র চন্দ্র রায় আমাদের সময়কে বলেন, ‘বিএনপি দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় রাজনৈতিক দল। এখানে তো জামায়াতের চিন্তা আর বিএনপির চিন্তা এক নয়। তারা তাদের রাজনীতি করছে, আমরা আমাদের রাজনীতি করছি— এটা তো স্বাভাবিক।’ বিএনপির গুরুত্বর্পূর্ণ নেতারা বলেন, গত ৫ আগস্টের পর গুম, খুন, দুর্নীতি ও টাকা পাচারসহ পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের নানা অপকর্ম নিয়ে জামায়াতে ইসলামী যতটা না সোচ্চার, তার চেয়ে বিএনপিকে ইঙ্গিত করে সমালোচনা করা, নির্বাচন ইস্যুতে ভিন্নমত প্রকাশ করা নিয়ে ব্যস্ত তারা। মনে হচ্ছে, দেশের প্রধান রাজনৈতিক দল জামায়াত, বিএনপি সেখানে কিছুই নয়। হঠাৎ করে জামায়াতের কার্যক্রম নিয়ে বেশ সন্দেহ ও অস্বস্তি বাড়ছে বিএনপিতে। এই অবস্থায় জামায়াতের সঙ্গে দূরত্ব রেখে চলার নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে দলটি। শুধু তাই নয়, জামায়াতকে ছেড়েও কথা বলবে না দলটি। বুধবার দলটির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভীর বক্তব্যে তা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। গত মঙ্গলবার জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময়কালে বলেছিলেন, রাজনৈতিকভাবে আমাদের ওপর যারা জুুলুম-নির্যাতন করেছে আমরা তাদের ক্ষমা করে দিয়েছি। এর জবাবে গতকাল রুহুল কবির রিজভী বলেন, ‘তারা (জামায়াত) বলছেন আওয়ামী লীগকে ক্ষমা করে দিয়েছেন। গণহত্যাকারীদের কীসের ক্ষমা করতে বলেছেন তারা? ছাত্র-জনতার আন্দোলনে শেখ হাসিনার নির্দেশে যাদের গুলি করে হত্যা করা হয়েছে, তাদের হত্যাকারীদের ক্ষমা করলে নিহতদের আত্মার সঙ্গে বেইমানি করা হবে। ট্রাইব্যুনাল করে প্রতিটি হত্যার বিচার করতে হবে, প্রতিটি অপরাধের বিচার করতে হবে। যদি শেখ হাসিনাসহ অপরাধীদের বিচার করা না হয়, তাহলে বাংলাদেশ কবরস্থানে পরিণত হবে।’ বিএনপি সূত্রে জানা যায়, কেবল বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করতে ২০২২ সালের ৯ ডিসেম্বর ২০ দলীয় জোট ভেঙে দিয়ে যুগপৎ আন্দোলন শুরু করেছিল বিএনপি। তবে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের লক্ষ্যে প্রথম দিকে না থাকলেও এক দফা দাবিতে আন্দোলনের স্বার্থে উভয় দলের র্শীর্ষ পর্যায়ে যোগাযোগের ভিত্তিতে সম্পর্ক নিবিড় হয়। এই আন্দোলনকে কেন্দ্র করে জামায়াত ও বিএনপি একত্রে প্রকাশ্যে না এলেও ভেতরে ভেতরে কাছাকাছি ছিল। সম্প্রতি দলীয় ফোরামের জামায়াতের আমিরের এক বক্তব্য ফাঁস হলে তা নিয়ে চরম ক্ষুব্ধ হয় বিএনপি। বিএনপির এক নেতা বলেন, বিগত দিনে বিএনপি সরকারের বিরুদ্ধে তত্ত্বাবধায়ক সরকার দাবিতে আওয়ামী লীগের সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলন করেছিল জামায়াত। ভবিষ্যতে জামায়াতের সঙ্গে আওয়ামী লীগের সম্পর্ক হবে না, তা বিশ^াস করা কঠিন। জামায়াতকে নিয়ে সন্দেহ থেকেই যায়। শুধু তাই নয়, অন্তবর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণ নিয়েও বিএনপির সঙ্গে তাদের রাজনৈতিক মিত্র জামায়াতে ইসলামের মতপার্থক্য দেখা দেয়। রাষ্ট্র সংস্কার নিয়ে দুই দলের মধ্যে মতের মিল থাকলেও জাতীয় নির্বাচনের রোডম্যাপ নিয়ে তাদের দুধরনের বক্তব্য উঠে এসেছে। প্রধান উপদেষ্টার ভাষণে নির্বাচনের রোডম্যাপ না থাকায় বিএনপির পক্ষ থেকে এক ধরনের আক্ষেপ করে দলটি। এ বিষয়ে সমালোচনামুখর না হলেও তাদের যে প্রত্যাশা পূরণ হয়নি, তা নেতাদের বক্তব্যে স্পষ্ট ছিল। বিপরীতে জামায়াত প্রধান উপদেষ্টার ভাষণকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছে। সরকারকে সময় দিতে চায় দলটি। এই অবস্থায় দুদলের সম্পর্কে এক ধরনের টানাপোড়েন তৈরি হয়। তখন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছিলেন, তাদের প্রত্যাশা ছিল ড. ইউনূস নির্বাচন নিয়ে একটি রোডম্যাপ ঘোষণা করবেন। নির্বাচন নিয়ে বিএনপির এমন অবস্থান প্রসঙ্গে জামায়াতের আমির ডা. শফিকুর রহমান বলেছিলেন, বিএনপি নির্বাচনের জন্য তোড়জোড় করছে। তারা এ মুহূর্তে নির্বাচনকে প্রাধান্য দিচ্ছন না। জামায়াতে ইসলামীর এমন অবস্থানের সমালোচনা করে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান দুদু সম্প্রতি জাতীয় প্রেস?ক্লাবের সামনে এক সমাবেশে বলেন, ‘কেউ কেউ বলছেন বন্যায় ভাসছি, আবার এখন নির্বাচনের দরকার কী? যারা যেমন, তারা তেমনই কথা বলবেন। কিছু মানুষ আছে, কিছু দল আছে আমাদের সঙ্গে থাকলেও ১৯টা সিট পায়, আমাদের থেকে বেরিয়ে আওয়ামী লীগের সঙ্গে থাকলে তিনটা সিট পায়, তারা তো ভোটকে ভয় পাবেই। এটা অস্বাভাবিক কিছু না।’ বিএনপি সূত্রে জানা যায়, নির্বাচনের বিষয়ে বিএনপি সরকারের ওপর এক ধরনের মানসিক চাপ তৈরি করতে চাইলেও জামায়াতের মধ্যে সেই ধরনের তাড়না দেখা যায়নি। দৃশ্যত, দুদলের মধ্যে যোগাযোগ অনেকটা সীমিত হয়ে আসছে বলেও ধারণা দিয়েছেন অনেকে। বিএনপি চেয়ারপারসনের এক উপদেষ্টা আমাদের সময়কে বলেন, বিএনপি হচ্ছে উদার মধ্যপন্থি ধর্মীয় মূল্যবোধে বিশ^াসী একটি গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল। আর অন্যদিকে জামায়াতে ইসলামী একটি ইসলামপন্থি রাজনৈতিক দল। দুই দলের নীতি আদর্শও ভিন্ন। জনসমর্থনের দিক দিয়েও বিএনপির আশপাশে নেই জামায়াতে ইসলামী। অতএব জামায়াতের তির্যকপূর্ণ কথা শুনে তাদের সঙ্গে সম্পর্ক রাখা সম্ভব নয়। সম্প্রতি মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘আমাদের যে জোট ছিল, আন্দোলনের জন্য জোট, সেটা অনেক আগেই অকার্যকর হয়ে গেছে। অনেক আগেই আমরা যুগপৎ আন্দোলন শুরু করেছি, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনা করে প্রোগ্রাম ঠিক করে যুগপৎ আন্দোলন করেছি সরকার পতন অবধি। এটা এখন বলবৎ নেই।’