ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে হাসিনার পতন

অবশেষে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে পতন হয়েছে শেখ হাসিনা সরকারের। জনবিস্ফোরণের মুখে গতকাল সোমবার দুপুরে পদত্যাগের পর গণভবন থেকে দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন তিনি। কোটা সংস্কারের দাবিতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন শেষ পর্যন্ত ছাত্র-জনতার এক দফার বিস্ফোরক আন্দোলনে রূপ নেওয়ার পর পতদ্যাগে বাধ্য হলেন তিনি। চার শতাধিক মানুষের জীবনের বিনিময়ে অর্জন হয়েছে এই বিজয়। ছাত্র-জনতার এই বিজয় নিশ্চিত হওয়ার পর পরই রাজপথে নেমে আসে লাখ লাখ মানুষ। গতকাল কার্যত পুরো দেশ চলে আসে জনতার দখলে। তারা নানা স্লোগানে, উল্লাসধ্বনিতে বিজয় উদযাপন করেছেন। উল্লসিত জনতা দখলে নিয়ে নেয় প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসবভন গণভবনও। উচ্ছ্বসিত জনতার মিছিল এসে মেলে শাহবাগ, টিএসসি আর শহীদ মিনারের। শুধু এ তিনটি স্থান নয়, গোটা রাজধানীই রূপ নেয় বিজয়ের নগরে। লাল-সবুজের পতাকা মাথায় বেঁধে রাস্তায় নামে শিশু থেকে বয়স্ক- সব শ্রেণি-পেশার মানুষ। এই আনন্দ ভয়কে জয় করার। এই উচ্ছ্বাস মুক্তির।

কোটা সংস্কার আন্দোলনের একপর্যায়ে পুলিশ ও আওয়ামী লীগের দমন-পীড়নে ক্ষোভে ফেটে পড়ে শিক্ষার্থীরা। বিশেষ করে কোটা আন্দোলনের প্রশ্নে ১৪ জুলাই শেখ হাসিনা বলেন, ‘চাকরি মুক্তিযোদ্ধাদের নাতি-পুতিরা পাবে না, তা হলে কি রাজাকারের নাতি-পুতিরা পাবে?’ তার এই বক্তব্যে ছাত্র-জনতা বিক্ষোভে ফেটে পড়েন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ সারাদেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা যোগ দেয় বিক্ষোভে। ক্যাম্পাসে ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীরা স্লোগান তোলে, ‘তুমি কে, আমি কে, রাজাকার, রাজাকার/কে বলেছে, কে বলেছে, স্বৈরাচার, স্বৈরাচার।’ ১৬ জুলাই ক্যাম্পাস ছাড়াও রাজপথ, প্রধান সড়ক ও জেলায় জেলায় আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পক্ষ থেকে গতকাল ‘লংমার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচি ঘিরে উত্তেজনার মধ্যেই গতকাল প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে ইস্তফা দিয়ে ভারতের উদ্দেশে দেশ ছাড়েন শেখ হাসিনা। এ পরিস্থিতিতে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাদের সঙ্গে আলোচনার পর বিকাল চারটায় জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেন সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান। সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান বলেন, প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করেছেন। একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করা হবে। এই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধীন দেশের সব কার্যক্রম চলবে। সব হত্যা ও অন্যায়ের বিচার হবে। সেনাবাহিনী, পুলিশ কোনো গুলি চালাবে না। আশা করছি, এই বক্তব্যের পর পরিস্থিতির উন্নতি হবে।

ছাত্রদের এই আন্দোলন এবং শেখ হাসিনা সরকারের পতন ত্বরান্বিত করে মূলত রংপুর বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবু সাঈদের বুকে পুলিশ গুলি চালানোর ঘটনাটি। এই মর্মান্তিক ঘটনার ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ার পর ছাত্র-জনতার রক্তে রীতিমতো আগুন ধরে যায়। মানুষের প্রতিবাদ বাড়তে থাকে। দমন-পীড়নও বাড়তে থাকে। তবে দমন-পীড়ন যত বাড়তে থাকে, জনতার ক্ষোভ আরও ছড়াতে থাকে। জনতার স্রোতে উবে যায় মানুষের মনের ভয়। শিক্ষার্থীদের সঙ্গে একে একে রাস্তায় নেমে আসেন অভিভাবক থেকে শুরু করে সব শ্রেণি-পেশার মানুষ। গুলির মুখে সন্তানদের জন্য ঢাল হয়ে রাস্তায় নামেন মা-বাবা আর শিক্ষকরা। মোবাইল নেটওয়ার্ক বন্ধ করলে ওয়াইফাই উন্মুক্ত করে দেয় সাধারণ মানুষ। ‘পানি লাগবে, পানি’ চিৎকার করে তৃষ্ণার্তদের মুখে পানি তুলে দেয় মুগ্ধের (পরে গুলিতে মারা যাওয়া) মতো অসংখ্য স্বেচ্ছাসেবী তরুণ। রক্ত, ত্যাগ আর জীবনের বিনিময়ে ছাত্র-জনতার বিজয় আসে।

গতকাল দুপুরে শাহবাগে বিজয় উল্লাসে তৃষ্ণার্ত মানুষকে পানির বোতল দিচ্ছিলেন ষাটোর্ধ্ব বিল্লাল হোসেন। উল্লসিত জনতার হাতে হাতে তুলে দিচ্ছিলেন ফুল। বিল্লাল হোসেন বলেন, তার ভাতিজা আন্দোলন করতে গিয়ে নিহত হয়েছেন। বিশ^বিদ্যালয়ের ছাত্র মুগ্ধকে সেই ‘পানি খাবেন, পানি’ তার সব সময় কানে বাজে। আমার তো সামর্থ্য কম। তাই তৃষ্ণার্ত মানুষকে পানি খাওয়াচ্ছি, যাতে আমার ভাতিজা এবং মুগ্ধদের আত্মা শান্তি পায়। তিন বলেন, আমি ত্রিশ হাজার টাকার পানি বিতরণ করেছি। আমার কষ্টের টাকা আমি দেশের মানুষের জন্য, জুলুম থেকে দেশকে বাঁচানের জন্য বিলিয়ে দিয়েছি।

গতকাল দিনের শুরু থেকেই সড়কে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কঠোর অবস্থান নেয়। তবে বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে কারফিউ উপেক্ষা করে রাজপথে অবস্থান নেয় মানুষ। কয়েকটি জায়গায় পুলিশ গুলিও চালায়। তার পরও গুলি আর মৃত্যু উপেক্ষা করে জনতার ঢল নামে রাজধানীর প্রবেশপথগুলোতে। যাত্রাবাড়ী, উত্তরা ও গাবতলীতে কয়েক লাখ লোক অবস্থান নেয়। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক দিয়েও কয়েক হাজার শিক্ষার্থী-জনতা ঢাকায় প্রবেশ করে। শনিরআখড়ায় দুপুর দেড়টার দিকে কয়েক হাজার আন্দোলনকারী অবস্থান নেয়। একই সময়ে উত্তরা থেকে বনানী অভিমুখে এগিয়ে আসে আন্দোলনকারীদের একটি দল। শিক্ষার্থী-অভিভাবক ছাড়াও সেই মিছিলে যোগ দেয় স্থানীয় মানুষ। তারা খ- খ- মিছিল নিয়ে বেলা দেড়টার দিকে বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনাল পার হয়ে সামনের দিকে যায়।

দুপুরের আগে প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগের গুঞ্জন ওঠে। এর মধ্যেই সেনাবাহিনীর প্রধান জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেবেন বলে ঘোষণা দেওয়া হয়। এ ঘোষণার পর দুপুর ১২টার দিকে রাস্তা ছেড়ে চলে যায় পুলিশ। এর পর ব্যারিকেড তুলে নেয় সেনাবাহিনীও। রাজপথে নেমে আসতে থাকে মানুষ। দুপুর ১টার পরই রাজপথে ঢল নামে মানুষের। মাথায় লাল-সবুজের পতাকা আর মুখে বিজয়ের সেøাগান।

দুপুর পৌনে ১টার দিকে সায়েন্সল্যাব এলাকায় জড়ো হওয়া হাজারো মানুষকে বিজয় উল্লাস করতে দেখা গেছে। মানুষের চোখে-মুখে দেখা গেছে মুক্তির আনন্দ। রাস্তায় কান পাতলেই জনতাকে বলতে শোনা গেছে- ‘আজ থেকে দেশ স্বাধীন’। এ যেন এক মুক্তির আনন্দ! হাসপাতালের কর্মীদের রাস্তায় এসে নাচতে দেখা গেছে। অসুস্থ নারীরাও হুইলচেয়ারে বেরিয়ে পড়েন। এ সময় কল্যাণপুরের বাসিন্দা ফজলে রাব্বি বলেন, ‘বিশ্বাস করতে কয়েক দিন সময় লাগবে।’ ধানমন্ডির বাসিন্দা মো. সুমন বলেন, ‘কী যে আনন্দ লাগছে, বোঝাতে পারব না।’

রাজধানীর মিরপুর ১০ নম্বর গোলচত্বর থেকে হাজার হাজার মানুষ ফার্মগেটের দিকে এগিয়ে আসে। দুপুর পৌনে ২টার দিকে হাজার হাজার আন্দোলনকারী আগারগাঁওয়ে মেট্রোরেল স্টেশনের নিচে অবস্থান করে উল্লাস করতে থাকে। মিরপুরের পল্লবী, সাড়ে ১০ ও ১১ নম্বর থেকে মিছিল নিয়ে মানুষ ১০ নম্বর সেকশন হয়ে আগারগাঁও হয়ে গণভবন ও শাহবাগে এসে বিজয় উল্লাস করে।

গতকাল সরেজমিনে রাজধানীর শাহবাগ ঘুরে দেখা যায়, সেখানে হাজার হাজার ছাত্র-জনতার ভিড়। প্রত্যেকের চোখে মুক্তির আনন্দ, মুখে তৃপ্তির ছাপ। মুখে মুখে সেøাগান ‘বাংলাদেশ স্বাধীন’। এ সময় এলিফ্যান্ট রোড, প্রেসক্লাব এলাকা থেকে গণমিছিল শাহবাগের দিকে আসতে থাকে। লাখ লাখ লোককে এ সময় মিছিলে দেখা যায়। পরিবারসহ মিছিলে অংশ নিতে দেখা যায় অনেককে।

উচ্ছ্বাসের মিছিলে অংশ নিতে মিরপুর থেকে মায়ের হাত ধরে এসেছিল চার বছরের জুনাইরাহ। দীর্ঘ পথ গণভবন পর্যন্ত হেঁটে আসার পরও ক্লান্তি নেই। মা-মেয়ের মুখে বিজয়ের হাসি। জুনাইরাহর মা বলেন, আমার কোনো দল-মত নেই; কিন্তু এতগুলো শিক্ষার্থী, শিশু-কিশোরের মৃত্যুর দৃশ্য দেখে প্রতিরাতই নির্ঘুম কেটেছে। চোখ বন্ধ করলেই আবু সাঈদ, মুগ্ধ আর নিহত শিশু-কিশোরদের মুখ ভেসে উঠত। বিশেষ করে হাসপাতালের বিছানায় রক্তাক্ত স্কুলশিক্ষার্থীর সেই কণ্ঠ কানে বাজে। তিনি বলেন, দেশই আমাদের মা। এই মা যেন সব সময় ভালো থাকে। আর অধিকার চেয়ে আর যেন কারও রক্ত না ঝরে।

উচ্ছ্বাসের বাঁধ ভাঙে সামাজিক মাধ্যম ফেসবুকেও। আন্দোলনে অংশ নেওয়া আজাদুল তার ফেসবুক পোস্টে লেখেন- ‘আজ জনগণের বিজয় হয়েছে। মাথা উঁচু করে থাকুক লাল-সবুজের পতাকা।’

গতকাল কোটা সংস্কার আন্দোলনের সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম বলেন, ছাত্র-শিক্ষক-সুশীল সমাজসহ অন্যদের অংশগ্রহণে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার চান তারা। এই অন্তর্বর্তীকালীন সরকার নির্বাচনের মাধ্যমে জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করবে। দেশটা আমাদের। রাষ্ট্রীয় সব সম্পদও আমাদের। আমাদের রাষ্ট্রীয় সম্পদ যেন কেউ লুটপাট, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের সুযোগ না পায়।

জনতার দখলে গণভবন : সরকার পতনের ‘এক দফা’ দাবিতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ডাকে সর্বাত্মক অসহযোগের দ্বিতীয় দিন ঢাকামুখী জনস্রোতের মধ্যে প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন গণভবন চলে গেছে জনতার দখলে। ‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচির মধ্যে নিরাপত্তা বাহিনীর ব্যারিকেড ভেঙে মিছিল নিয়ে বিকাল ৩টার দিকে তারা গণভবনে ঢুকে পড়ে তারা। এর পর থেকেই গণভবন শিক্ষার্থীসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের দখলে।

সংসদ ভবনে জনতার উল্লাস : প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করে শেখ হাসিনার দেশ ছাড়ার খবরে উল্লসিত জনতা গণভবন ছাড়াও ঢুকে পড়েছেন সংসদ ভবনে। পতাকা হাতে ভবনের ছাদে উঠে পড়েন অনেকে, সংসদ অধিবেশন কক্ষে এমপিদের আসনে বসে উল্লাস করছেন, কেউ গোসলে নেমে পড়েছেন সংসদের লেকে। সংসদ ভবনের বিভিন্ন কক্ষে প্রবেশ করেন তারা। চেয়ারে বসে ছবি তোলেন। কেউ নাচানাচি আর হৈ-হুল্লোড় করছিলেন, যেন বিজয়ের আনন্দ।