দ্য হিন্দুতে ইউনূসের সাক্ষাৎকার, আন্দোলন ইস্যুতে সরকারের সমালোচনা

কোটা সংস্কার আন্দোলন এবং সহিংসতা নিয়ে ভারতীয় সংবাদমাধ্যম দ্য হিন্দুর সঙ্গে একটি সাক্ষাৎকার দিয়েছেন নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস।

অলিম্পিকের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে অংশ নিতে ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে গেছেন ইউনূস। সেখানে বসেই সাম্প্রতিক বিষয় নিয়ে কথা বলেছেন তিনি। গতকাল শুক্রবার (২৬ জুলাই) দ্য হিন্দু সাক্ষাৎকারটি প্রকাশ করে।

এতে ইউনূস দাবি করেছেন, এটি ছিল শিক্ষার্থীদের একটি আন্দোলন। কিন্তু এই আন্দোলন থামাতে সব বাহিনীকে ব্যবহার করেছে সরকার।

এছাড়া বাংলাদেশে গণতন্ত্র ফেরাতে আরেকটি নির্বাচন প্রয়োজনীয় হয়ে পড়েছে বলেও দাবি করেছেন তিনি।

পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে জাতিসংঘসহ অন্যান্য সংস্থা ও ভারতের ভূমিকা রাখার বিষয়েও কথা বলেছেন ইউনূস। তিনি বলেছেন, তার চাওয়া হলো জাতিসংঘ ও অন্যান্য বিশ্ব নেতারা অনানুষ্ঠানিকভাবে কথা বলুক এবং সমস্যা উত্তরণে চেষ্টা করুক।

সাক্ষাৎকার গ্রহণকারী সাংবাদিক ইউনূসকে বলেন যে— ভারত ইতিমধ্যে জানিয়েছে এটি বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়। এর জবাবে ইউনূস বলেছেন, যদিও ভারত প্রকাশ্যে এই কথা বলেছে। তারা চাইলে অনানুষ্ঠানিকভাবে কথা বলতে পারে। দুই দেশের প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে কথা হতে পারে।

সাক্ষাৎকারে ইউনূস বলেন, গুলি করে সাধারণ মানুষকে হত্যা করা হচ্ছে। সেনাবাহিনী মোতায়েনের বিষয়েও প্রশ্ন তুলেছেন তিনি।

সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে সরকারের শত্রুরা আন্দোলনে ঢুকে গেছে। এই দাবির ব্যাপারে ইউনূস বলেছেন, কারা শত্রু সেটি চিহ্নিত করা হোক এবং তাদের শাস্তি দেওয়া হোক। কিন্তু শিক্ষার্থীদের হত্যা বন্ধ করতে হবে। যেমনটি একটি গণতান্ত্রিক দেশে হয়ে থাকে।

সাক্ষাৎকারী তাকে আরও প্রশ্ন করেন কোটা সংস্কারকারীরা ১৯৭১ সালের মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য নির্ধারিত কোটার বিরোধীতা করছেন। এরসঙ্গে কী ভারত বিরোধীতার কোনো সম্পর্ক আছে কিনা। জবাবে ইউনূস বলেছেন, এটির সঙ্গে কোনো দিক দিয়ে ভারত বিরোধীতার সম্পর্ক নেই।

এরপর সাক্ষাৎকারী তাকে জিজ্ঞেস করেন যে সরকার দাবি করেছে আন্দোলনকারীরাই সহিংস হয়ে উঠেছিল এবং তারা পুলিশের উপর হামলা করছিল। জবাবে ইউনূস বলেন, আইন শৃঙ্খলার অবনতি হলে সেটি থামানোর নির্দিষ্ট প্রক্রিয়া আছে। কোথাও বলা নেই যে এলোমেলোভাবে হত্যা করা যাবে। পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায় এমন আন্দোলন হয়েছে। যেগুলো সরকারকে মোকাবিলা করতে হয়েছে। তিনি দাবি করেছেন, বাংলাদেশে আইনের শাসন এবং গণতন্ত্র চর্চায় মারাত্মক ভুল রয়েছে।

শিক্ষার্থীদের রাজাকার বলায় (প্রধানমন্ত্রী জানিয়েছেন তার বক্তব্য বিকৃত করা হয়েছে) ক্ষমা চাওয়া এবং মন্ত্রীদের পদত্যাগের যে দাবি আন্দোলনকারীরা জানিয়েছে সে ব্যাপারেও প্রশ্ন করা হয় ইউনূসকে। জবাবে তিনি বলেন, এগুলো শিক্ষার্থীদের দাবি। গণতান্ত্রিক যে প্রক্রিয়া রয়েছে সেটি অনুযায়ী নিয়ম হলো সরকার এগুলো নিয়ে নিজেদের জবাব দেবে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মাত্র জানুয়ারি মাসে নির্বাচিত হয়েছেন। এখন তার পদত্যাগ চাওয়া অগণতান্ত্রিক নয়? এমন প্রশ্নের জবাবে ইউনূস বলেন, আমরা গণতন্ত্রের প্রতি এবং গণতন্ত্রে থাকার প্রতিশ্রুতি দিয়েছি। সেখানে আপনি নবনির্বাচিত হন আর না হন। মানুষের সম্মতির বিপক্ষে গিয়ে আপনি আপনার অবস্থানের অপব্যবহার করছেন কিনা সেটি গণতন্ত্রে ব্যপার নয়। যেটি হলো আপনার দায়িত্ব হলো মানুষকে রক্ষা করা। হত্যা করা নয়। বিরোধী দলের লোক হলে আপনি কাউকে তুলে নিয়ে জেলে ভরে রাখতে পারেন না। এটি আইন নয়।

সরকারের পদত্যাগ করা উচিত কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে ইউনূস বলেন, এ ধরনের পরিস্থিতিতে গণতান্ত্রিক যে উপায়ের কথা বলা হয়েছে সেটি করতে হবে। এ ব্যাপারে আমাকে নতুন করে কিছু বলতে হবে না।

এই পরিস্থিতে আপনার ভূমিকা কী? ইউনূস বলেন, আমি এখন যা করছি তাই আমার ভূমিকা। আমি বাংলাদেশে গণতন্ত্রের প্রয়োজনীয়তার কথা বলছি।

এরপর তাকে প্রশ্ন করা হয় বাংলাদেশকে তার সঠিক অবস্থানে ফিরে যেতে হবে কী করতে হবে। জবাবে এই অর্থনীতিবিদ বলেন, সরকারকে মানুষের ম্যানডেট পেতে হবে। কারণ মানুষের নির্দেশনা পেয়ে গণতন্ত্র সমস্যার সমাধান করে। কারণ রাষ্ট্র হলো সাধারণ মানুষের। সরকারে থাকা কয়েকজন মানুষের নয়।

ইউনূসকে সাক্ষাৎকার গ্রহণকারী প্রশ্ন করেন আপনি কী নতুন নির্বাচন চান কিনা। এতে তিনি বলেন, অবশ্যই। রাজনৈতিক সমস্যার প্রধান সমাধান হলো নির্বাচন। যখন কোনো কিছু কাজ করে না তখন আপনি মানুষের নির্দেশনা চান। তারা রাষ্ট্রের মূল মালিক। তবে নিশ্চিত করতে হবে সত্যিকারের নির্বাচন হবে। কোনো জাদুকরের নির্বাচন নয়।

সরকার এখন বলছে পরিস্থিতি স্বাভাবিক এবং নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। এই দাবির ব্যাপারে ইউনূসের কাছে জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, সরকার দাবি করছে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে। যদিও এটি থেমে থাকেও তাহলে এটি কিন্তু সাধারণ রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান করেনি। এটি অস্থায়ীভাবে থামতে পারে। কিন্তু রাজনৈতিক ইঞ্জিন চালু থাকবে।

ইউনূস আরও বলেছেন, বাংলাদেশে আজ যা হচ্ছে তা ভারতেও হতে পারে। যদি আজ আমরা এ নিয়ে কথা না বলি তাহলে এই সমস্যা আপনি সার্কভুক্ত ভারত, পাকিস্তান নেপালসহ অন্যান্য দেশে নিয়ে যাচ্ছেন।