দেশজুড়ে ক্রমেই বাড়ছে ডেঙ্গুর প্রকোপ। গত ২৪ ঘণ্টায় সারাদেশে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে আরও ৮৪৩ জন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এতে ডেঙ্গুতে আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২৩ হাজার ১০৮ জনে। একই সময় নতুন করে আরও একজনের মৃত্যু হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, গত আগস্টে পুরো মাসে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন ৬ হাজার ৫২১ জন। আগস্টে মারা গেছেন ২৭ জন। সব মিলিয়ে এ বছর দেশে এ পর্যন্ত ডেঙ্গুতে মারা গেছেন ১২৫ জন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চলতি সেপ্টেম্বরের মধ্যে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে অক্টোবরে ভয়াবহ হয়ে উঠতে পারে ডেঙ্গুর প্রকোপ। বিশেষ করে ঢাকা ও ঢাকার বাইরে ১৮টি জেলার পরিস্থিতি খারাপ হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
এবার ডেঙ্গুর সংক্রমণ বৃদ্ধির পেছনে কয়েকটি বিষয়কে দায়ী করছেন বিশেষজ্ঞরা। এগুলো হলো স্থানীয় পর্যায়ে ঠিকমতো মশকনিধন না করা, গণ-আন্দোলনে সময় সিটি করপোরেশনের বিভিন্ন আঞ্চলিক অফিসে হামলায় মশা মারার মেশিন নষ্ট হওয়া, পরিবর্তিত অবস্থায় প্রশাসনের ঠিকমতো গুছিয়ে না উঠতে পারা। এদিকে মেয়র না থাকায় নতুন করে দায়িত্ব নিয়েছেন প্রশাসকরা। অল্প সময়ের মধ্যে তাদের প্রস্তুতি নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, ২০২৩ সালে ডেঙ্গুতে মৃত্যুর সংখ্যা অতীতের সব রেকর্ড ভেঙে দিয়েছিলো। ১ হাজার ৭০৫ জনের মৃত্যু হয়েছে ওই বছর। তার আগের বছর ২০২২ সালে ডেঙ্গুতে মৃত্যুর সংখ্যা ছিলো ৮৬৮ জন। চলতি বছর মৃত্যু ও আক্রান্তের হার এখন পর্যন্ত কম। তবে কিছুদিন ধরে হাসপাতালে বাড়ছে রোগীর সংখ্যা।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে ডেঙ্গুতে ৩৯৬ জন মৃত্যুবরণ করে। অক্টোবরে এই সংখ্যা ছিল ৩৫৯ জন। তবে চলতি বছর এই সংখ্যা অনেক কম। বর্তমানে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ৫৩ শতাংশ ঢাকা মহানগরে এবং ৪৭ শতাংশ ঢাকার বাইরে। মৃতদের মধ্যে ৬৭ শতাংশ ঢাকার এবং ৩৩ শতাংশ ঢাকার বাইরের।
চলতি বছর ডেঙ্গুতে এপ্রিলে ২ জনের, মে মাসে ১২ জনের, জুনে ৮ জনের ও জুলাই মাসে ১২ জনের মৃত্যু হয়। এবার ডেঙ্গুতে সবচেয়ে বেশি মৃত্যু হয়েছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে। এ এলাকায় ৫৯ জনের মৃত্যু হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র বলেছে, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) পক্ষ হতে মশকনিধন কার্যক্রম তদারকি করার জন্য কমিটি করা হয়েছে। তদারকির জন্য বিভিন্ন বিভাগের কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে ১০টি অঞ্চলে ১০টি দল গঠন করা হয়েছে।
দুই সিটি করপোরেশন সূত্র জানিয়েছে, জুলাই-আগস্ট মাসের সহিংসতায় ঢাকা দক্ষিণ সিটির ২৫টি ওয়ার্ডের মশকনিধনের যন্ত্র ক্ষতিগ্রস্ত বা চুরি হয়েছে। উত্তর সিটিতে ১৫টি ওয়ার্ডের মশকনিধনের সরঞ্জাম কমবেশি নষ্ট হয়েছে। তারপরও নগর কর্তৃপক্ষ দাবি করেছে, তাদের কাজ চলছে।
আর ডিএসসিসির প্রশাসক ড. মহা. শের আলী বলেন, দক্ষিণ সিটির আওতায় হাসপাতালে যেসব রোগী মারা যাচ্ছেন, এগুলো এই করপোরেশনের বলা হচ্ছে। তবে হাসপাতাল ঘুরে দেখা গেছে, এসব রোগীদের অনেকে ঢাকারে বাইরে থেকে এসেছেন।
ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ নিয়ে তিনি বলেন, মশা নিধনসহ ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে। তিনি আশা করছেন, ডেঙ্গুর যে ভয়াবহতার কথা বলা হচ্ছে, তেমনটি নয়।
রাজধানীর রামপুরা, মগবাজার, মালিবাগ, কাকরাইল, তেজগাঁও, বাড্ডা, ফার্মগেট, মিরপুর এলাকা ঘুরে স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এসব এলাকায় মশকনিধন কার্যক্রম গত দুই মাসে খুব বেশি চোখে পড়েনি।
পূর্ব রামপুরা এলাকার মুদি দোকানি আসলাম বলেন, শেষ কবে রামপুরা টিভি রোডে মশা মারতে লোক আসছে, মনে নাই। গত ১০-১৫ দিন ধরে মশার উৎপাত বাড়ছে।
মালিবাগ রেলগেট এলাকার বাসিন্দা সাহাদাত হোসেনের ছেলে ১০ দিন আগে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন। এখন অনেকটা সুস্থ আছেন জানিয়ে সাহাদাত অভিযোগ করেন, তার এলাকায় মশার মারার কোনো কার্যক্রম নেই।
এদিকে বর্ষা মৌসুম শেষ হলেই ডেঙ্গু ভয়ংকর রূপ নিতে পারে-এমন আগাম সতর্কবার্তা আগেই জানিয়েছেন কীটতত্ত্ববিদেরা। এ ব্যাপারে কীটতত্ত্ববিদ ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের শিক্ষক ড. কবিরুল বাশার বলেন, দুই মাস আগে থেকেই তিনি ফরকাস্টিং মডেল করে জানিয়েছেন যে সেপ্টেম্বর মাস থেকে ডেঙ্গু পরিস্থিতি খারাপ হবে। তবে গবেষকদের কথা কেউ আমলে নেয় না বলেও জানান তিনি।
ঢাকার বাইরে ডেঙ্গু সংক্রমণ বাড়বে জানিয়ে এই কীটতত্ত্ববিদ বলেন, অক্টোবরে ডেঙ্গু পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে। বান্দরবান, কক্সবাজার, চট্টগ্রাম, চাঁদপুর, লক্ষ্মীপুর, বরিশাল, বরগুনা, পিরোজপুর, পটুয়াখালী, ভোলা, খুলনা, যশোর, নড়াইল, মেহেরপুর, ঢাকার পাশের ময়মনসিংহ, মাদারীপুর, মানিকগঞ্জে পরিস্থিতি খারাপ হবে।
কক্সবাজারে রোহিঙ্গা ক্যাম্পের কারণে ওই এলাকায় সংক্রমণের হার অনেক বেশি। যা কক্সবাজার, বান্দরবান ছাড়িয়ে পুরো চট্টগ্রামে ছড়িয়ে পড়ছে বলেও জানান এই কীটতত্ত্ববিদ।