১৯৯৯ সালের ঘটনা। টেক্সাসের এক জুরি অস্পষ্ট অক্ষরে প্রেসক্রিপশন লেখার কারণে এক রোগীর মৃত্যুর ঘটনায় এক চিকিৎসককে দোষী সাব্যস্ত করে রোগীর পরিবারকে ২ লাখ ২৫ হাজার মার্কিন ডলার জরিমানা প্রদান করার হুকুম দেন। প্রেসক্রিপশন পড়তে ভুল করে ভুল ওষুধ ডিসপেন্স করার জন্য ফার্মাসিস্টকেও একই পরিমাণ জরিমানা পরিশোধের আদেশ দেন। হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ড. রামচন্দ্র কল্লুরু এনজাইনার জন্য রেমন ভেসকুয়েজ নামের এক রোগীকে ৬ ঘণ্টা অন্তর অন্তর ২০ মি. গ্রাম সরডিল (আইজোসরবিড ডাইনাইট্রেট) গ্রহণের পরামর্শ দিয়ে প্রেসক্রিপশন প্রদান করেন। কিন্তু প্রেসক্রিপশন পড়তে না পারার কারণে ফার্মাসিস্ট রোগীকে একই মাত্রার অর্থাৎ ২০ মি. গ্রামের উচ্চরক্তচাপের ক্যালসিয়াম চ্যানেল ব্লকার গ্রুপের ওষুধ প্লেন্ডিল (জেনেরিক ফেলোডিপিন) প্রদান করেন। কিন্তু উচ্চরক্তচাপের ক্যালসিয়াম চ্যানেল ব্লকার গ্রুপের এ ওষুধ প্লেন্ডিলের সর্বোচ্চ গ্রহণযোগ্য মাত্রা হলো ১০ মি. গ্রাম। অত্যধিক মাত্রার এ ওষুধ সেবন করার একদিন পর রেমন ভেসকুয়েজ হার্ট অ্যাটাকে আক্রান্ত হন এবং এর কিছুদিন পর তিনি মারা যান। চিকিৎসকের সার্বিক স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে আদালত কোনো প্রশ্ন তোলেননি। রোগীর মৃত্যুর জন্য অস্পষ্ট অক্ষরে লেখা তার প্রেসক্রিপশনকে দায়ী করে তাকে দোষী সাব্যস্ত করা হয় এবং জরিমানা করা হয়। রেমন ভেসকুজের আইনজীবী মি. বাকিংহাম প্রশ্ন তুলে বলে, প্রেসক্রিপশন লেখার আগে চিকিৎসকদের কি ভাবা উচিত নয় যে, তার অস্পষ্ট হাতের লেখার কারণে রোগী বিভিন্নভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে? এর পরিপ্রেক্ষিতে আমেরিকান মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন পরবর্তী কয়েক বছরে প্রেসক্রিপশন লেখার ব্যাপারে বেশ কয়েকটি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। আমেরিকান মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন চিকিৎসকদের স্পষ্ট অক্ষরে প্রেসক্রিপশন লেখার আহ্বান জানিয়েছেন। প্রেসক্রিপশন লেখার পর তাতে কোনো ভুল-ত্রুটি আছে কিনা বা তা পাঠযোগ্য কিনা তা পুনর্বার পরীক্ষা করে দেখার জন্য বলা হয়। যেসব চিকিৎসকের হাতের লেখা খারাপ তাদের কম্পিউটার ব্যবহারের অনুরোধ জানানো হয় অথবা অন্তত ব্লক লেটার ব্যবহার করতে আহ্বান জানানো হয়। বেশ কিছুদিন আগে জাতীয় একটি দৈনিক পত্রিকা অস্পষ্ট অক্ষরে প্রেসক্রিপশন লেখা নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল। সেই প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, স্পষ্ট অক্ষরে পাঠ উপযোগী করে প্রেসক্রিপশন লেখার হাইকোর্টের নির্দেশ অমান্য করায় সুপ্রিমকোর্টের একজন আইনজীবী দিনাজপুরের একটি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের দুজন ডেন্টাল সার্জনকে আইনি নোটিশ পাঠিয়েছিলেন। নোটিশে সাত দিনের মধ্যে বিষয়টির ব্যাখ্যা চাওয়া হয়েছিল। নোটিশ সূত্রে জানা যায়, ৫ সেপ্টেম্বর ২০১৮ দিনাজপুরের উক্ত মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে বেসরকারি টেলিভিশন এটিএন বাংলার একজন স্পেশাল রিপোর্টারের মা চিকিৎসার জন্য যান। এসময় ডেন্টাল সার্জন তার চিকিৎসা শেষে প্রেসক্রিপশন দেন। লেখা স্পষ্ট না হওয়ায় রোগীর স্বজনদের প্রেসক্রিপশনে উল্লেখিত ওষুধ কিনতে বিড়ম্বনায় পড়তে হয়। সব ওষুধের দোকানি প্রেসক্রিপশনে কী লেখা রয়েছে তা উদ্ধার করতে ব্যর্থ হন।
আমি প্রায়ই অপাঠযোগ্য প্রেসক্রিপশন হাতে পাই। তার মধ্যে বেশিরভাগই পড়তে পারি না। কিছুদিন আগে এক রোগীর জন্য অর্ধডজন ডিগ্রিধারী একজন চিকিৎসক একটি প্রেসক্রিপশন দিয়েছেন। দোকানদার/ফার্মাসিস্ট দুয়েকটি ছাড়া বাকি সব ওষুধের নাম পড়তে পারেননি। পরিচিত রোগী প্রেসক্রিপশনটি আমার হাতে দিয়ে বললেন, দেখুন তো স্যার প্রেসক্রিপশনের ওষুধগুলোর নাম পড়তে পারেন কিনা। উৎসুক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, প্রেসক্রিপশন নিয়ে আমার কাছে কেন এসেছেন? ভদ্রলোক বললেন, দোকানদার কয়েকটি ওষুধের নাম পড়তে পারেনি বলে ওষুধ দেয়নি। ভাবলাম আপনি হয়তো পড়তে পারবেন। আর কিছু না বলে প্রেসক্রিপশনে প্রদত্ত ওষুধগুলোর নাম উদ্ধার করতে চেষ্টা করলাম। কিন্তু রীতিমতো দুঃসাধ্য কর্ম বলে মনে হলো। সেই সনাতনী ও চিরাচরিত প্রক্রিয়ার বাজে ও অপাঠ্য হাতের লেখা। প্রেসক্রিপশনটি হাতে নিয়ে ভাবছিলাম, স্পষ্ট অক্ষরে পাঠ উপযোগী করে প্রেসক্রিপশন লেখার হাইকোর্টের নির্দেশ থাকা সত্ত্বেও আমাদের চিকিৎসকরা স্পষ্ট অক্ষরে পাঠ উপযোগী করে প্রেসক্রিপশন কেন লেখেন না। সুপ্রিমকোর্টের জেনেরিক নামে ব্লক লেটার বা প্রিন্ট করার মাধ্যমে প্রেসক্রিপশন লেখার আদালতের আদেশটি আমাদের চিকিৎসকরা মেনে চলছেন না-এটি এক ধরনের ধৃষ্টতার বহিঃপ্রকাশ নয় কি! অনেকদিন আগ থেকে ওষুধের দোকানে খোঁজ নিয়ে আমি জানতে পেরেছিলাম-আনুমানিক ১০ শতাংশের বেশি চিকিৎসক আদালতের নির্দেশ মেনে প্রেসক্রিপশন লিখছেন না। আর সেই কারণে রোগী ও ওষুধ বিক্রেতাদের ভোগান্তিও কমছে না।
পাঠকদের অবগতির জন্য জানাচ্ছি, ২০১৭ সালের ৯ জানুয়ারি উচ্চ আদালত চিকিৎসকদের ব্লক লেটার বা প্রিন্ট করে জেনেরিক নামে প্রেসক্রিপশনে ওষুধ লিখতে বিজ্ঞপ্তি প্রচারের জন্য স্বাস্থ্য সচিবের কাছে নির্দেশ পাঠিয়েছিলেন। নির্দেশে ছয় মাস তদারকির পর আদালতের নির্দেশ মেনে চিকিৎসকরা প্রেসক্রিপশন লিখছেন কিনা তা আদালতকে জানাতে বলা হয়েছিল। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, চিকিৎসকসমাজ আদালতের উল্লেখিত নির্দেশ পুরোপুরি মেনে প্রেসক্রিপশন লিখছেন না। এরই মধ্যে প্রায় কয়েক বছর অতিবাহিত হতে চলেছে। ইতোমধ্যে স্বাস্থ্য সচিব আদালতের কাছে কোনো রিপোর্ট আদৌ পাঠিয়েছেন কিনা বা পাঠালে কী রিপোর্ট পাঠিয়েছেন, তা এখনো জানা যায়নি। একজন ফার্মাসিস্ট হিসাবে চিকিৎসকসমাজের কাছে আমি আহ্বান জানাই, অনুগ্রহ করে আপনারা আপনাদের চিরাচরিত আচরণ পরিবর্তন করে আদালতের নীতিমালা অনুসরণ করে পরিপূর্ণ তথ্য ও পরামর্শ প্রদানপূর্বক স্পষ্ট ও ঝকঝকে পাঠযোগ্য অক্ষরে জেনেরিক নামে প্রেসক্রিপশন লিখুন। চিকিৎসা পেশার নীতিশাস্ত্রেও এ একই নির্দেশনা দেওয়া আছে। সুন্দর ও পাঠযোগ্য প্রেসক্রিপশন লিখলে আপনাদের মান-মর্যাদা ও ভাবমূর্তি বৃদ্ধি পাবে, মানুষও উপকৃত হবে, অপাঠ্য প্রেসক্রিপশনের ভুল ওষুধ সেবন বা গ্রহণ করে মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হবে না বা মৃত্যুবরণ করবে না।
ওষুধের অযৌক্তিক প্রয়োগের বড় উৎস হলো চিকিৎসকের রোগ নির্ণয় ও প্রেসক্রিপশন। চিকিৎসক ঠিকমতো রোগ নির্ণয় করে যুক্তিসংগতভাবে ওষুধ প্রদান না করলে রোগী ওষুধের অপব্যবহারজনিত সমস্যার শিকার হবে। চিকিৎসক তার দায়িত্ব সঠিক ও নির্ভুলভাবে পালন করলেও ওষুধের ডিসপেন্সিং যুক্তিসংগত বা সঠিক না হলে রোগী ক্ষতিগ্রস্ত হবে। অন্যদিকে প্রেসক্রিপশনে প্রদত্ত ওষুধ সম্পর্কে রোগীকে পর্যাপ্ত ও প্রকৃত তথ্য, পরামর্শ বা উপদেশ প্রদান করা না হলে, যুক্তিহীন ব্যবহারের কারণে রোগী ক্ষতিগ্রস্ত হবে। রোগীর জন্য প্রেসক্রিপশনে ওষুধ প্রদানে চিকিৎসক যত সতর্কতা, জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা প্রয়োগ করবেন, রোগী তত বেশি উপকৃত হবে। রোগ প্রতিকার ও প্রতিরোধে চিকিৎসকদের ভূমিকাকে কোনোভাবেই খাটো করে দেখার অবকাশ নেই। আমাদের দেশে একটি ধারণা প্রচলিত রয়েছে-চিকিৎসক এলে ওষুধ ছাড়াই রোগীর অর্ধেক রোগ ভালো হয়ে যায়। এর পেছনে বৈজ্ঞানিক সত্য রয়েছে। কারণ, রোগের ক্ষেত্রে অনেক সময় শরীর ও মনের যোগসূত্র অভিন্ন। উন্নত বিশ্বে প্রকৃত চিকিৎসা শুরুর আগেই চিকিৎসকরা প্রায়ই রোগীকে মনস্তাত্ত্বিকভাবে চাঙা করার উদ্যোগ নেন। রোগীকে তার রোগ সম্পর্কে প্রকৃত তথ্য প্রদান এবং চিকিৎসা সম্পর্কে অবহিত করতে চিকিৎসকরা সদা সচেষ্ট থাকেন। এতে রোগীর আস্থা ও আত্মবিশ্বাস বেড়ে যায়। রোগী সন্তুষ্ট না হওয়া পর্যন্ত ন্যায়সংগত তথ্য জানার জন্য চিকিৎসককে প্রশ্ন করার অধিকার রাখেন। ফলশ্রুতিতে রোগ নির্ণয় ও ওষুধ প্রয়োগে ভুল কম হয় বলে ওষুধের অপব্যবহারও কমে আসে। কিন্তু আমাদের দেশে চিকিৎসককে একটির বেশি দুটি প্রশ্ন করলেই চিকিৎসক বিরক্ত হন ও খেপে যান। কারণ, বেশি প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার সময় তাদের নেই। এ আচরণ প্রশংসনীয় নয়। রোগীর প্রতি একটু সদয় ও সহানুভূতিশীল হলে রোগীর আস্থা অনেক বেড়ে যায়, রোগী খুশিও হয়। বিশ্বজুড়ে চিকিৎসকরা তাদের প্রেসক্রিপশনে যেসব ওষুধ লিখে থাকেন তার সব যুক্তিসংগতভাবে লেখেন না। ওষুধের এ অযৌক্তিক প্রয়োগের পেছনে বহুবিধ কারণ কাজ করে। বহু চিকিৎসক পেশাগত জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার অভাবে রোগীকে সঠিক ওষুধ প্রদানে সক্ষম হন না। জ্ঞান-বিজ্ঞানের অগ্রগতি ও পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে এসব চিকিৎসক নিজেদের যুগোপযোগী করে গড়ে তুলতে সচেষ্ট হন না। এসব চিকিৎসক সাধারণত সনাতনী পদ্ধতিতে যুগ যুগ ধরে সেকেলে মানসিকতা নিয়ে চিকিৎসা চালিয়ে যান বলে রোগ নির্ণয় বা ওষুধ প্রদানে প্রায়ই ভুল হয়। আমাদের মতো দেশে অতিমাত্রায় ব্যবসায়িক মনোবৃত্তির কারণে রোগীর প্রচণ্ড চাপ সহ্য করতে না পেরে চিকিৎসকরা অসতর্কতা ও অবহেলার কারণে রোগীকে সঠিক চিকিৎসা প্রদানে ব্যর্থ হন। অন্যদিকে বহু চিকিৎসক ওষুধ কোম্পানি কর্তৃক প্রভাবান্বিত ও প্রলুব্ধ হয়ে গুণগত মানসম্পন্ন এবং সস্তা ওষুধের পরিবর্তে দামি ওষুধ প্রেসক্রিপশনে লিখে থাকেন। আবার অনেক চিকিৎসক দেশে উৎপাদিত মানসম্পন্ন ওষুধ বাদ দিয়ে বিদেশি নামিদামি ওষুধ প্রেসক্রাইব করে থাকেন। এতে রোগীর আর্থিক ক্ষতি হয়। এ আচরণ বদলানো উচিত। ওষুধ কোম্পানিগুলো ওষুধ বাজারজাত করার পর ওষুধ প্রমোশনে সর্বশক্তি নিয়োগ করে থাকে তাদের ওষুধের কাটতি বাড়ানোর জন্য। ওষুধের কাটতি বাড়ানোর জন্য ওষুধ কোম্পানিগুলোর মূল টার্গেট থাকে চিকিৎসক। কারণ চিকিৎসকরা প্রেসক্রিপশনে যে ওষুধ লিখেন, রোগী মূলত সেই ওষুধই কিনে থাকে। অধিক হারে মুনাফা অর্জনের উদ্দেশ্যে ওষুধ কোম্পানিগুলো সাধারণত টনিক, ভিটামিন, হজমিকারক, বলবৃদ্ধিকারক, এনজাইম, কফমিকচার, অ্যালকালাইজারজাতীয় অপ্রয়োজনীয় এবং ক্ষতিকর ওষুধ উৎপাদনে বেশি তৎপর থাকে। কারণ অত্যাবশ্যকীয় ওষুধের চেয়ে এসব তথাকথিত ওষুধের ওপর মুনাফার হার বহুগুণ বেশি। এ মুনাফার হার আরও অধিকগুণে বেড়ে যায় যখন চিকিৎসকরা তাদের প্রেসক্রিপশনে এসব ওষুধ নামধারী পণ্য নির্বিচারে প্রেসক্রাইব করে থাকেন। ওষুধ কোম্পানির সঙ্গে এসব ওষুধ প্রেসক্রাইবারদের সম্পর্ক যতটা না পেশাগত তার চেয়ে বেশি ব্যবসায়িক। ব্রিটেনে চিকিৎসক পিছু ওষুধ কোম্পানিগুলো প্রতিবছর দুই লাখ টাকা ব্যয় করে। বাংলাদেশে এ ব্যয়ের প্রকৃত পরিমাণ কতো তা কে জানে! এ দেশে এসব বিষয়ে কোনো জরিপ হয় না। ওষুধ প্রশাসনের এক সাবেক পরিচালকের তথ্য মোতাবেক, বাংলাদেশের ওষুধ কোম্পানিগুলো তাদের মোট বিক্রির দশ শতাংশ অর্থ (এখন মনে হয় আরও বেশি) চিকিৎসকদের কমিশন দেওয়া বাবদ ব্যয় করে। চিকিৎসকরা শুধু ওষুধ কোম্পানি থেকেই কমিশন নেন না। তারা ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলো থেকেও মোটা অঙ্কের কমিশন পেয়ে থাকেন। আর এ কারণেই প্রায় সব চিকিৎসক রোগীকে অসংখ্য অপ্রয়োজনীয় ডায়াগনস্টিক টেস্টের পরামর্শ দিয়ে থাকেন। কোনো কোনো ডায়াগনস্টিক টেস্টের পেছনে অসহায় দরিদ্র রোগীদের হাজার হাজার টাকা ব্যয় করতে হয়। চিকিৎসকদের এ ধরনের অনৈতিক কমিশন বাণিজ্যের কারণে মানুষের চিকিৎসা ব্যয় দিন দিন বেড়েই চলেছে। তবে ঢালাওভাবে সব চিকিৎসকের প্রতি এ ধরনের অভিযোগ প্রযোজ্য নয়। দেশে অনেক চিকিৎসক আছেন, যারা এ কমিশন বাণিজ্যকে সম্পূর্ণ অনৈতিক হিসাবে আখ্যায়িত করেন।
অর্থ ছাড়াও ওষুধ কোম্পানিগুলো চিকিৎসকদের প্রচুর পরিমাণে ওষুধ ফ্রি স্যাম্পল হিসাবে উপহার দিয়ে থাকে। অভিজ্ঞ মহল মনে করে, এ ফ্রি স্যাম্পল আর ঘুসের মধ্যে পার্থক্য অতি নগণ্য। স্বভাবতই প্রশ্ন আসে, চিকিৎসকরা এ ফ্রি স্যাম্পল কেন গ্রহণ করেন বা এ ওষুধ নিয়েই বা তারা কী করেন? এভাবে ফ্রি স্যাম্পল নেওয়া বা দেওয়া নীতিগতভাবে বৈধ হতে পারে না। আমি অসংখ্য ওষুধের দোকানকে জানি, যেখানে হাজার হাজার টাকার ফ্রি স্যাম্পল হিসাবে পাওয়া ওষুধ বিক্রি হয়। এসব ফ্রি স্যাম্পল না নিলে চিকিৎসকদের কী এমন ক্ষতি হয়?
আমাদের দেশে সবচেয়ে বেশি অপব্যবহৃত ওষুধগুলোর মধ্যে রয়েছে-অ্যান্টিবায়োটিক, সিডেটিভ, অ্যান্টিডায়ারিয়াল, ভিটামিন, টনিক, এনজাইম, কফমিকচার, স্টেরয়েড, অ্যান্টিহিস্টামিন, অ্যান্টিকোলেস্টেরল, অ্যান্টাসিডজাতীয় ওষুধ। টনিক ভিটামিনের প্রতি মানুষের অকৃত্রিম দুর্বলতা রয়েছে। এ দুর্বলতার কারণ ওষুধ কোম্পানিগুলোর অনৈতিক ড্রাগ প্রমোশন এবং চিকিৎসক কর্তৃক এসব ওষুধের ঢালাও প্রয়োগ। টনিক ও ভিটামিন সম্পর্কে ওষুধ কোম্পানিগুলো যেসব ভ্রান্ত ধারণা চিকিৎসক ও জনসমক্ষে তুলে ধরে তার মধ্যে রয়েছে, টনিক ও ভিটামিন সেবনে ভগ্নস্বাস্থ্য উদ্ধার, বয়স্কদের যৌবনপ্রাপ্তি, শিশুদের মেধা ও বয়ঃবৃদ্ধি, ত্বকের শ্রীবৃদ্ধি, চুলপড়া বন্ধ হওয়া ইত্যাদি। এসব বক্তব্যের কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি না থাকা সত্ত্বেও বহু চিকিৎসক প্রায়ই এসব বস্তু প্রেসক্রিপশনে লিখে থাকেন। রোগী প্রয়োজনীয় মনে করে প্রচুর অর্থ ব্যয়ের মাধ্যমে এসব ওষুধ কিনে থাকে। এ অপব্যাখ্যা ও অপব্যবহার স্পষ্টতই প্রবঞ্চনার শামিল।
ওষুধের অপপ্রয়োগ ও অপব্যবহারের ফলে রোগী বিভিন্নভাবে ক্ষতিগস্ত হয়। প্রেসক্রিপশনে প্রদত্ত ওষুধের কোনটি প্রয়োজনীয়, কোনটি অপ্রয়োজনীয় বা প্রদত্ত ওষুধের সঙ্গে সৃষ্ট রোগের আদৌ সম্পর্ক রয়েছে কিনা, এসব প্রশ্ন উপস্থাপন করার যোগ্যতা ও ক্ষমতা রোগীরা সচরাচর রাখে না। ফলে রোগী প্রেসক্রিপশন মোতাবেক ওষুধ কিনতে ও গ্রহণ করতে বাধ্য হয়। প্রেসক্রিপশন মোতাবেক অপ্রয়োজনীয় ওষুধ কিনলে রোগী আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। অপ্রাসঙ্গিক বা ক্ষতিকর ওষুধ কিনতে গেলে রোগী মারাত্মক পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায়, বিষক্রিয়া বা বিরূপ প্রতিক্রিয়ার শিকার হয়। এ ক্ষতির দায়দায়িত্ব থেকে চিকিৎসক অব্যাহতি পেতে পারে না। উন্নত বিশ্বে রোগী চিকিৎসকের ভুল সিদ্ধান্তের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হলে আইনের আশ্রয় নিতে পারে। অনুন্নত দেশে রোগী এ সুবিধা বা অধিকার ভোগ করে না। বাংলাদেশে ড্রাগ প্রমোশনে কোম্পানিগুলো মেডিকেল রিপ্রেজেন্টেটিভ বা ড্রাগ প্রমোশন প্রতিনিধি নিয়োগ করে থাকে। এ রিপ্রেজেনটেটিভরা অধিকাংশ ক্ষেত্রে ওষুধ বিশেষজ্ঞ নয় এবং কোনো কোনো সময় ওষুধের ওপর এদের পর্যাপ্ত জ্ঞান থাকে না। তাদের কোনো কোনো সময় ড্রাগ প্রমোশনের ওপর প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়ে থাকে। কিন্তু ড্রাগ প্রমোশনের জন্য ওষুধ কোম্পানি কর্তৃক পরিচালিত এ প্রশিক্ষণ কতটুকু নিরপেক্ষ এবং প্রকৃত তথ্যসাপেক্ষ, তা মূল্যায়নের প্রয়োজন রয়েছে। এরা সাধারণত কোম্পানির ব্যবসায়িক স্বার্থটাকে বড় করে দেখে এবং সে মোতাবেক চিকিৎসককে ওষুধ প্রয়োগ এবং ড্রাগ স্টোরগুলোকে ওষুধ কিনতে প্রলুব্ধ করে। এরা অনেক সময় রোগীর কাছ থেকে প্রেসক্রিপশন অনেকটা ছিনিয়ে নিয়ে ছবি তুলে রাখে চিকিৎসক তার কোম্পানির ওষুধ প্রেসক্রিপশনে লিখেছে কিনা তা দেখার জন্য। প্রকৃত প্রস্তাবে কোনো রোগের ক্ষেত্রে ওষুধ নির্বাচনে প্রকৃত তথ্য না পেলে চিকিৎসক বিভ্রান্ত হয় এবং ফলে ভুল বা ক্ষতিকর ওষুধ প্রয়োগে রোগী ক্ষতিগ্রস্ত হয়। চিকিৎসকদের মেডিকেল রিপ্রেজেনটেটিভ কর্তৃক প্রদত্ত তথ্যের ওপর সম্পূর্ণ নির্ভর না করে নিজেদের জ্ঞান-বুদ্ধির ভিত্তিতে ওষুধ প্রেসক্রাইব করা উচিত। অন্যদিকে ওষুধ কোম্পানিগুলো কর্তৃক চিকিৎসক এবং রোগীর জন্য প্রকৃত ও পর্যাপ্ত তথ্য প্রবাহের নিশ্চয়তা বিধান করার ব্যাপারে সরকারেরও দৃঢ় পদক্ষেপ নেওয়া উচিত।
কোনো দেশে ওষুধের সংখ্যায় সীমাবদ্ধতা না থাকলে এবং বাজার প্রয়োজনীয় বা অপ্রয়োজনীয় ওষুধে প্লাবিত হয়ে গেলে সব ওষুধের ওপর সম্যক ধারণা অর্জন কোনো চিকিৎসকের পক্ষে সম্ভব নয়। সুচিকিৎসার জন্য সীমাবদ্ধ ওষুধের ওপর পর্যাপ্ত জ্ঞান অসংখ্য ওষুধের ওপর অপূর্ণ ও ভাসা ভাসা জ্ঞানের চেয়ে অনেক উপকারী। ওষুধের ফলপ্রসূ ও যুক্তিসংগত প্রয়োগের জন্য কোম্পানি প্রদত্ত নামের পরিবর্তে ওষুধের জেনেরিক নাম ব্যবহার আবশ্যক। এ ব্যাপারেও আদালতের স্পষ্ট নির্দেশ রয়েছে; কিন্তু সেই নির্দেশও বাস্তবায়িত হচ্ছে না। কয়েকটি বেসরকারি হাসপাতালের চিকিৎসক জেনেরিক নামে ওষুধ লিখে থাকেন। প্রেসক্রিপশন লেখার ব্যাপারেও তারা যত্নবান। এসব হাসপাতালে প্রেসক্রিপশন লেখার জন্য কম্পিউটার ব্যবহার করা হয়ে থাকে। তাদের আমি সাধুবাদ জানাই। আরও একটি কথা। প্রতিটি দেশে স্বাস্থ্যব্যবস্থার উন্নতিকল্পে একটি অত্যাবশ্যকীয় ওষুধের তালিকা থাকা প্রয়োজন এবং সুচিকিৎসার স্বার্থে চিকিৎসকদের জন্য থাকা প্রয়োজন একটি স্ট্যান্ডার্ড ট্রিটমেন্ট গাইডলাইন। বাংলাদেশের মতো একটি অনুন্নত দেশের নিরীহ জনসাধারণের সুস্বাস্থ্য নিশ্চিতকরণে এসব ইন্সট্রুমেন্টের কোনো বিকল্প নেই। এটি শুধু আমার কথা নয়। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থাও তাই মনে করে।
পরিশেষে একটি কথা। মানবসেবায় চিকিৎসকদের ভূমিকাকে খাটো করে দেখার কোনো অবকাশ নেই। মানুষ রোগাক্রান্ত হলে চিকিৎসকের কাছে যায়, চিকিৎসক রোগ নির্ণয় করে রোগীকে ওষুধ দেন এবং রোগী সেই ওষুধ খেয়ে সুস্থ হয়ে ওঠে। রোগীর রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসাসেবা প্রদানের জন্য মানুষের কাছে চিকিৎসকদের সম্মান ও মান-মর্যাদা অনেক বেশি। সুতরাং আমাদের মতো গরিব দেশের অসহায় ও দরিদ্র রোগী ও মানুষের দুঃখ-কষ্ট, অসহায়ত্ব, অভাব-অনটন ও দুর্দশার কথা চিকিৎসকরা না ভাবলে বা বুঝলে আর ভালো কে ভাববে বা বুঝবে?