একটা সময় মানুষের কাছে তথ্য পাঠানোর অন্যতম মাধ্যম ছিল হাতে লেখা চিঠি। পোস্ট অফিসের লাল টুকটুকে বাক্সে চিঠি ফেলে ফিরতি চিঠির অপেক্ষায় ডাকপিয়নের জন্য বসে থাকতেন প্রিয়জনেরা। বর্তমান প্রজন্মের কাছে রূপকথার গল্পের মতো মনে হবে সেই সময়টিকে।
প্রযুক্তির উৎকর্ষতার যুগে এখন আর কেউ চিঠি লেখেন না। আধুনিকতার ছোঁয়ায় এখন যে কোনো বার্তা প্রেরণে ব্যবহার হচ্ছে মোবাইল ফোন, ই-মেইল, হোয়াটসঅ্যাপ, মেসেঞ্জারসহ আরও কত কী! ডাকবাক্সে চিঠি ফেলে কবে তার প্রিয়জন সেই চিঠি পাবেন এই অপেক্ষাও এখন আর কেউ করেন না। ফলে কদর কমেছে ডাকবাক্সের।
ডাকবাক্সগুলো এখন বার্ধক্যের ছাপ নিয়ে লজ্জায় মুখ লুকিয়ে কোনোমতে টিকে আছে ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে। সরকারি চিঠিপত্র আর সঞ্চয়পত্র সেবা দিয়ে নিজেদের অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে দেশের ডাক ঘরগুলো। ফেনীর জেলা-উপজেলায় অবস্থিত ডাকঘরগুলোর চিত্রও এমনই।
জানা যায়, ফেনী জেলার প্রধান ডাকঘরের অধীনে ছয় উপজেলায় ছয়টি উপজেলা ডাকঘর, উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে ৩৭টি শাখা ডাকঘর ও ১৯টি উপ-ডাকঘর রয়েছে। যেগুলো অধিকাংশ কার্যত ঝিমিয়ে চলছে।
মঙ্গলবার (৮ অক্টোবর) ফেনীর প্রধান ডাকঘরে সঞ্চয়পত্রের টাকা উত্তোলন করতে আসেন মো. হামিদুল্লাহ নামে সাবেক এক কৃষি কর্মকর্তা। তিনি বলেন, ‘এ প্রজন্ম চিঠি কী, ডাকবাক্স কী তা ঠিতমতো চেনে না। আমারা ছাত্র ও চাকরি জীবনে কতো চিঠি লিখেছি। যোগাযোগ, গুরুত্বপূর্ণ নথি ও টাকা আদান-প্রদানের একমাত্র মাধ্যম ছিল পোস্ট অফিস। ছাত্র জীবনে নোয়াখালীতে পড়ালেখার সময় চট্টগ্রাম থেকে পোস্ট অফিসের মাধ্যমে বাবা খরচের টাকা মানি অর্ডার করতেন। পোস্ট অফিসে গিয়ে বসে থাকতাম সেই টাকার জন্য। মানি অর্ডারের খামের ওপর বাবা ছোট করে কোনো বার্তা লিখে দিতেন। সেই অনূভুতি এখনকার প্রজন্ম বুঝবে না। এখনতো চিঠিই লেখে না কেউ। সবাই প্রযুক্তি নির্ভর।’
দাগনভূঞা এলাকার বাসিন্দা মজিবুল হক বলেন, ‘গত ১৫-২০ বছর আগেও মানুষ চিঠি লিখতো। দেশে কিংবা প্রবাসে প্রিয়জনদের খবরা জানার মাধ্যম ছিল এই চিঠি। মানুষের হাতে মোবাইল ইন্টারনেট আসার পর চিঠির কদর কমে গেছে। মনে হয়না কেউ কাউকে এখন আর চিঠি পাঠান।’
আরিফুল ইসলাম নামে এক শিক্ষক বলেন, ‘এখন চিঠির জায়গা দখল করেছে এসএমএস, ফেসবুক, টুইটার, হোয়াটসঅ্যাপ, ই-মেইলসহ আরও অনেক প্রযুক্তি। জীবনযাপন প্রযুক্তিনির্ভর হওয়ায় চিঠির মাধ্যমে যোগাযোগের বিষয়টির নির্ভরশীলতা কমে গেছে। এখন ডাকবাক্সে কেউ চিঠি খুব একটা ফেলেন না।’
ফেনী পৌরসভার ডাক্তার পাড়া এলাকার শামীম আহমদ বলেন, ‘ডাকবাক্সে চিঠি ছাড়া হোক বা না হোক, ডাকবাক্সগুলো যদি সংরক্ষণে রাখা যায় তাহলে আমরা আমাদের ঐতিহ্যকে টিকিয়ে রাখতে পারবো। ভুলে গেলে চলবে না, ডাক বিভাগ আমাদের ইতিহাসের অংশ।’
ফেনীর প্রধান ডাকঘরের পোস্ট মাস্টার মো. তাজুল ইসলাম বলেন, ‘আগে পোস্ট অফিসের মাধ্যমে ব্যক্তিগত চিঠির আদান-প্রদান হলেও এখন কেবল সরকারি-বেসরকারি দপ্তরের চিঠি আসে। মানুষ আধুনিক হতে হতে চিঠি-ডাকবাক্সের থেকে দূর সরে গেছেন। এজন্য অযত্ন ও অবহেলায় ডাকবাক্সগুলো হারিয়ে যাচ্ছে। অনেক জায়গায় ডাকবাক্সগুলো ভঙ্গুর হয়ে পড়ে আছে। সরকার বিভিন্ন সময় ডাক বিভাগকে আধুনিক করার উদ্যোগ নিলেও জনবল সংকটের কারণে যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এগোতে পারিনি আমরা।’
তিনি আরও বলেন, ‘বর্তমানে আমাদের পোস্ট অফিসে সরকারি চিঠিপত্র, পার্সেল, মানিঅর্ডার, ইলেকট্রনিক মানি ট্রান্সফার, পোস্টাল ক্যাশ কার্ড, ডাক জীবন বীমা, সঞ্চয় ব্যাংক, পোস্টেজ ও রাজস্ব স্ট্যাম্প বিক্রিসহ বহুমুখী সেবা প্রদান করা হচ্ছে। জনবল সংকট থাকায় কিছু সেবা দিতে বিঘ্ন ঘটে। আমরা আমাদের সামর্থ্যের সবটুকু দিয়ে চেষ্টা করে যাচ্ছি।’
জনবল সংকটের বিষয়ে এই কর্মকর্তা বলেন, ‘ফেনীর প্রধান ডাকঘরে সৃষ্ট পদ ৮১টির বিপরীতে জনবল আছে ৩৪ জন। ৯ জন ডাকপিয়ন থাকার কথা থাকলেও আছে তিন জন। লোকজন কম থাকায় চাইলেও কাঙ্খিত সেবা দেওয়া যায় না।
ডাকবাক্স সংরক্ষণের বিষয়ে তাজুল ইসলাম বলেন, ‘ব্যবহার না থাকায় অনেক ডাকবাক্স ইতোমধ্যে নষ্ট হয়ে গেছে। এরপরও যেগুলো আছে, সেগুলো সংরক্ষণের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।’