কায়সার হামিদ মানিক,কক্সবাজারের উখিয়া পালংখালীতে সরকারি নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে দুইটি খাল থেকে ইজারাবিহীন বালি উত্তোলন করছে প্রভাবশালী একাধিক শক্তিশালী সিন্ডিকেট। মামলা জরিমানা কিছুই দমাতে পারছে না এসব প্রভাবশালীদের। ফলে সরকার হারাচ্ছে কোটি টাকার রাজস্ব।
অবৈধভাবে বালি উত্তোলনের ফলে খালের তীব্র ভাঙনের পাশাপাশি পরিবেশ ধ্বংস হচ্ছে প্রতিনিয়ত। অবৈধভাবে বালি উত্তোলনে জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানিয়েছে স্থানীয় সচেতন মহল।
সরজমিন গিয়ে দেখা যায়, উখিয়া উপজেলার পালংখালী ইউনিয়নে ২টি বৃহৎ বালি মহাল রয়েছে। তারমধ্যে পালংখালী খালের বালুমহাল ও বালুখালী খালের বালি মহাল অন্যতম।
উখিয়া উপজেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, আইনি জটিলতার কারণে পালংখালী ইউনিয়নের খালের বালি মহালটি সরকারিভাবে নিলাম বা ইজারা বন্ধ রয়েছে। ইজারা বন্ধ থাকার কারণে বেআইনিভাবে কোন খাল থেকে বালি উত্তোলনের কোন সুযোগ নেই।
সূত্র বলছে, গেল মৌসুমে পালংখালী খালের বালি মহালটি ইজারা নেয় স্থানীয় আলী আহমদ নামের জনৈক এক ব্যক্তি। নিয়ম অনুযায়ী গত জুলাই মাসে তার ইজারার মেয়াদ শেষ হয়।
এরই মধ্যে ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর খাল দুইটি দখলে নেয় স্থানীয় একটি শক্তিশালী বালি সিন্ডিকেট। সরকারি নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে বালি উত্তোলনের প্রতিযোগিতায় নেমেছে তারা।
স্থানীয় সূত্র মতে ইউনিয়ন বিএনপির সাধারণ সম্পাদক সাহাব উদ্দিন চৌধুরী, যুবদল নেতা শাহ আলম ও হেলাল উদ্দিনের নেতৃত্বে খালের মধ্যে ড্রেজার মেশিন বসিয়ে বালি উত্তোলন করছে। যা জীববৈচিত্র্য ও পরিবেশের জন্য মারাত্মক হুমকি স্বরূপ। বালি সিন্ডিকেটটি পালংখালী খালের বিভিন্ন পয়েন্টে চারটি ড্রেজার মেশিন বসিয়ে রাত-দিন অবৈধভাবে বালি উত্তোলন করে যাচ্ছে।
বিষয়টি নিয়ে সম্প্রতি বিভিন্ন সমাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আলোচনায় আসার পর প্রশাসনের পক্ষ থেকে নামে মাত্র অভিযান অভিযান পরিচালনা করা হয়। এসময় একটি অবৈধ ড্রেজার মেশিন জব্দ করে উপজেলা প্রশাসন ও বনবিভাগ।
উখিয়ার পালংখালী ও বালুখালী খাল এবং বনবিভাগের পাহাড়ে চলছে আরও ৫ টিরও অধিক ড্রেজার মেশিন। রাতের বেলায় ড্রেজার মেশিনের শব্দে মাতোয়ারা হয়ে পড়ে স্থানীয়রা। এককথায় অবৈধ ড্রেজার মেশিনের শব্দে আশেপাশের ঘর-বাড়িতে ঘুমাতে পারে না নারী পুরুষ ও শিশুরা।
অবৈধভাবে বালি উত্তোলন ও পরিবেশ বিধ্বংসী কার্যক্রমের সাথে জড়িত সাহাব উদ্দিন চৌধুরীর সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, চলতি মৌসুমে সরকার পালংখালী খালের বালি মহাল ইজারা দেয়নি। তবে আমরা খালটি পুনরায় ইজারা নিতে উপরের মহল থেকে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। তবে তিনি অবৈধভাবে বালি উত্তোলনের কথা স্বীকার করেন।
পালংখালী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এম গফুর উদ্দিন চৌধুরী জানান, ইউনিয়নে চলতি মৌসুমের জন্য সরকার কোন খাল ইজারা দেয়নি। তাই যে বা যারা অবৈধভাবে বালি উত্তোলন ও পরিবেশ বিধ্বংসী কার্যক্রমের সাথে জড়িত এবং জীববৈচিত্র ধ্বংস করছে তাদের শাস্তির আওতায় আনতে হবে।
তিনি বলেন, পালংখালী ইউনিয়নের দুইটি খালে ড্রেজার মেশিন বসিয়ে ও পাহাড় কেটে প্রতিদিন ডাম্পার যোগে মাটি ও বালি উত্তোলন করা হচ্ছে। পরে তা রোহিঙ্গা ক্যাম্পসহ বিভিন্ন স্থানে সরবরাহ করছে। পরিবেশ মারাত্মক হুমকির মুখে পড়েছে। তাই এখনই এসব অবৈধ কার্যক্রম বন্ধ করার জন্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও দপ্তরের প্রতি অনুরোধ করেন।
উখিয়া উপজেলা নির্বাহী অফিসার তানভীর হোসেনের সাথে বিষয়টি নিয়ে কথা হয় প্রতিবেদকের। তিনি জানান, চলতি বছরের জন্য পালংখালী ইউনিয়নের কোন খাল বা বালি মহাল সরকারের পক্ষ থেকে ইজারা দেয়া হয়নি। তাই বালি উত্তোলনের কোন সুযোগ নেই। যারা ইজারাবিহীন বালি উত্তোলন ও পাহাড় কাঁটার সাথে জড়িত রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থাগ্রহণ করা হবে।
অপরদিকে ইজারার মেয়াদ শেষ হওয়ার পর কোন ধরনের ইজারা বিজ্ঞপ্তি ছাড়া এবং নিলাম ডাকের আয়োজন ছাড়া বালি উত্তোলনের নিয়ম আছে কিনা জানতে চাইলে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) বিভীষণ কান্তি দাশ বলেন, ইজারা বিধি অনুযায়ী মেয়াদ শেষ হওয়ার পর দৈনিক পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দিয়ে ইজারার আয়োজন করতে হয়। উন্মুক্ত ডাকে যিনি সর্বোচ্চ ডাককারী হবেন তাকে নির্দিষ্ট শর্তে ইজারা দেওয়া হয়।
তিনি বলেন, একাধিকবার দৈনিক পত্রিকায় খালের ইজারা বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের পরও যেহেতু সরকারি মূল্যের কাছাকাছি কোন ব্যক্তি খাল ইজারা নিতে পারেনি তাই সংশ্লিষ্ট খাল গুলো থেকে কেউ বালি উত্তোলন করলে তা সম্পূর্ণ অবৈধ। চলতি বছরের জন্য সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তর থেকে আর খাল বা বালি মহাল ইজারা দেওয়ার সুযোগ নেই।
তিনি আরও বলেন, জেলা প্রশাসকের রাজস্ব শাখা থেকে কাউকে ইজারার মেয়াদ বৃদ্ধি করা হয়নি। এ ব্যাপারে খোঁজ খবর নিয়ে অনিয়ম পেলে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
রাতের আঁধারে ড্রেজার মেশিন ও ডাম্পার লাগিয়ে অবৈধভাবে বালি উত্তোলন করার ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে খালের উভয় পাড়ের রক্ষা বাধ। চলতি বছরে মারাত্মকভাবে এর প্রভাব পড়েছে আশেপাশের গ্রামগুলোতে। খালের তীর ভেঙে পানি লোকালয়ে প্রবেশ করে বন্যা দেখা দেয়। তলিয়ে যায় অসংখ্য ঘর-বাড়ি।
সরকারি রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে নির্বিচারে বালি উত্তোলন করে পরিবেশ বিপর্যয়কারীদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া জরুরি বলে মনে করছেন স্থানীয় সচেতন মহল।