মৃত্যুর আগেও আহতদের পানি খাওয়াচ্ছিলেন মুগ্ধ

গত ১৮ই জুলাই সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলন করতে গিয়ে গুলিবিদ্ধ হয়ে রাজধানীর উত্তরায় মারা যান মীর মাহফুজুর রহমান মুগ্ধ। তিনি বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালসের (বিইউপি) শিক্ষার্থী। মুগ্ধর পরিবার ও বন্ধুদের অভিযোগ পুলিশের গুলিতে মৃত্যু হয়েছে তার।

গুলিতে মুগ্ধের যখন মৃত্যু হয় তার কিছুক্ষণ আগেও তাকে হাশিমুখে আন্দোলনকারী সহপাঠীদের হাতে পানি তুলে দিতে দেখা যায়। বিক্ষোভ মিছিলের উত্তাল সেই সময়েও তার মুখ থেকে হাশি আড়াল হয়নি। মীর মাহবুবুর রহমান স্নিগ্ধ, যিনি মুগ্ধর জমজ ভাই। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে স্নিগ্ধ ৩৮ সেকেন্ডের একটা ভিডিও শেয়ার দেন। ভিডিওতে দেখা যায়, মৃত্যুর আগে শেষ মিছিলেও মুগ্ধ আন্দোলনকারীদের হাতে ওয়াটারকেস থেকে পানি তুলে দিচ্ছেন। তাকে বারবার বলতে শোনা যায়, ‘এই পানি লাগবে পানি’। এ সময় সবুজ ফিতায় বুকে ঝুলছিল তার প্রিয় বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচয়পত্র।

স্নিগ্ধ ফেসবুকে লিখেন, আমার সহোদর মুগ্ধ গুলিবিদ্ধ হয়। তার কপালে গুলি ছোট গর্ত করে ডান কানের নিচে বড় গর্ত করে বেরিয়ে গিয়েছিল। নিহত হওয়ার আগেও মুগ্ধ বিস্কুট ও পানি দিয়ে আন্দোলনে সহযোগিতা করছিল। সে সবসময় রাজনীতির বিপক্ষে থাকলেও মানুষের অধিকারের পক্ষে ছিল। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনের নেতৃত্ব দিয়েছিল।

সে সময়ের পরিস্থিতি বর্ণনা করতে গিয়ে স্নিগ্ধ বলেন, মাথায় গুলিবিদ্ধ হওয়ার সময়ও মুগ্ধ উত্তরার আজমপুরে রোড ডিভাইডারের মাঝামাঝিতে হাতে ওয়াটারকেসটি ধরে রেখেছিল। তার বন্ধু আশিক তাকে তাৎক্ষণিক নিকটবর্তী হাসপাতালে নিয়ে যায়, এ সময় সেখানে অনেক পুলিশ ভিড় করেছিল।

আমার ভাই কখনো পুলিশের বিপক্ষে ছিল না, সে বলতো তারা কেবল আদেশ অনুসরণ করছে। তবে তাদের ব্যক্তিগত নৈতিকতা অনুসরণ করা উচিত এবং কোনো অনৈতিক আদেশ অনুসরণ করা উচিত নয়।

মুগ্ধর যেদিন গুলিতে নিহত হয় সেদিনের ঘটনার বর্ণনা দিয়ে ফেসবুকে দীর্ঘ একটা পোস্ট করেছেন বন্ধু নাইমুর রহমান আশিক। তিনি বলেন, ‘এক পর্যায়ে আমরা ইষ্টি কুটুমের মুখোমুখি হয়ে রোড ডিভাইডারের ওপর বসলাম একটু বিশ্রামের জন্য। প্রথমে জাকির এরপর মুগ্ধ আর সবশেষে আমি। তখন পর্যন্ত পুলিশ কাউকে গুলি করে নাই! শুধুমাত্র টিয়ার শেল, স্প্রিন্টার আর রাবার বুলেটেই সীমাবদ্ধ ছিলো! হঠাৎ সবাই আমির কমপ্লেক্স আর রাজউক কমার্শিয়ালের দিক থেকে দৌড়ায় আসতেসে! ২/৩ সেকেন্ড পর মুগ্ধর পায়ের উপরে হাত রেখে বললাম, চল দৌড় দেই। আমার বন্ধু শেষবারের মতো আমাকে বলল চল। জাকির উঠে দৌড় দিল আগে তারপর আমিও উঠে দৌড় দিলাম ৩ থেকে ৪ কদম যাওয়ার পর আমার সামনেই জাকিরকে দেখতেছি দোড়াইতেছে কিন্তু আমার পাশে মুগ্ধ নাই! পেছন ঘুরে তাকাতেই দেখি আমার বন্ধু ওই বসা অবস্থা থেকেই মাটিতে পড়ছে, চোখ ২ টা বড় করে আমার দিকে তাকায় আছে, হাতে সেই অবশিষ্ট বিস্কুট আর পানির বোতলের পলিথিন, কপালে গুলির স্পষ্ট চিহ্ন।

নাইমুর রহমান আশিক বলেন, আমি চিৎকার করলাম, ‘জাকির মুগ্ধ গুলি খাইসে’। সামনের দিকে একবার তাকাইয়া দেখলাম অসংখ্য পুলিশ অস্ত্র হাতে এদিকে আসতেছে! কেমন জানি গোলমাল লাইগা গেল! মাথা কাজ করতেছে না! শরীর নিস্তেজ হয়ে যাইতেসিল! একবার ভাবলাম মুগ্ধর পর্যন্ত যাওয়ার আগেই আমাকেও গুলি করবে! তবুও আমি দৌঁড়ায়ে মুগ্ধর কাছে গিয়ে ওরে ধইরা তোলার চেষ্টা করলাম পারতেছি না একা, পাশেই একজন সাহস করে আসল চেহারা মনে নাই! দুইজনে মিলে কোলে তুললাম মুগ্ধকে! পরক্ষণেই বেশ কয়েকজন মিলে ধরল! আমি রিক্সায় আবারও আগের মতোই কোলে নিয়ে হাসপাতালের দিকে যাচ্ছি আর মুগ্ধর কপালে চাপ দিয়ে ধরে আছি যাতে রক্ত না বের হয়’!

বন্ধু হয়ে কলিজার বন্ধুর মাথায় গুলি লাগা অবস্থায় কোলে নিয়ে অসহায়ের মতো লাগছিল জানিয়ে আশিক লিখেন, ‘আমার কাছে সবকিছু কেমন স্লো মোশন মনে হচ্ছিল! কিছুক্ষণ পর ঝাপসা চোখে দেখলাম মুগ্ধর আইডি কার্ড হাতে ডাক্তার আমাকে বলতেছে, আপনার কি হয়, বললাম আমার ভাই! বলল আপনার কোথায় লাগছে? পানি খান, বেডে শুয়ে পড়েন! বললাম আমার কিছুই হয় নাই! ওর কি হইছে, বাইচা আছে? আমাকে বলল পালস খুঁজে পাচ্ছি না আপনি একটু রিল্যাক্স হয়ে বাসায় ফোন দেন! তখনও ক্লিয়ারলি কিছুই বুঝে উঠতে পারছি না! আমি স্নিগ্ধকে কল করলাম সাথে সাথে! বললাম মুগ্ধ গুলি খাইসে তাড়াতাড়ি ক্রিসেন্টে আয় ভাই! স্নিগ্ধ আসল, দেখল! ডাক্তার জানাইলো পালস পায় না! স্নিগ্ধ আমাকে ধরে কানতেসে আর অসহায়ের মতো ডাক্তারকে বলতেসে ভাই প্লিজ, প্লিজ ভাই আরেকবার দেখেন না!