বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগ নিয়ে রীতিমতো তেলেসমাতি কাণ্ড ঘটিয়েছেন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই উপাচার্য। পরস্পরের কন্যাকে প্রভাষক পদে নিয়োগ দিয়েছেন তাঁরা। আর তা করতে গিয়ে নিয়োগ পরীক্ষায় অংশ নেওয়া একাধিক যোগ্য প্রার্থীকে অবলীলায় বাদ দিয়েছেন। তুলনামূলক কম যোগ্যতার প্রার্থী হলেও দুই কন্যার নিয়োগ নিয়ে চলছে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা।
এ দুই উপাচার্য হলেন– গোপালগঞ্জের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বশেমুরবিপ্রবি) উপাচার্য অধ্যাপক ড. একিউএম মাহবুব এবং বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. ছাদেকুল আরেফিন। এক বছরের কম সময়ের ব্যবধানে তাঁরা এ নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের মেয়ে অহনা আরেফিনকে গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে বশেমুরবিপ্রবির পুরকৌশল বিভাগে প্রভাষক পদে নিয়োগ দেন বশেমুরবিপ্রবির উপাচার্য। এ নিয়োগের বিনিময়ে গত ২২ মার্চ একিউএম মাহবুবের কন্যা ফারজানা মাহবুবকে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের কোস্টাল অ্যান্ড ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট বিভাগে প্রভাষক পদে নিয়োগ দেন ছাদেকুল আরেফিন। প্রশ্নবিদ্ধ নিয়োগ দুটিতে নিয়োগ বোর্ডেরও প্রধান ছিলেন এ দুই উপাচার্য।
তাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে, পরস্পরের কন্যাকে নিয়োগ দিতে গিয়ে তাঁরা নিজ পদের অনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে, অনেক যোগ্য প্রার্থীকে বাদ দিয়ে এ নিয়োগ দিয়েছেন। উপাচার্য ছাদেকুল আরেফিনের মেয়ে নাটোরের একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করেছেন।
অভিযোগ রয়েছে, অহনা আরেফিনের তুলনায় অনেক যোগ্য প্রার্থী থাকলেও বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের মেয়ে বলেই তিনি এ পদে নিয়োগ পান। গত বছরের ৫ ফেব্রুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়ের রিজেন্ট বোর্ডে (সিন্ডিকেট) এ নিয়োগ অনুমোদন করা হয়। রিজেন্ট বোর্ডের সভাপতি পদাধিকার বলে উপাচার্য। এমনকি ওই বোর্ডের কার্যবিবরণী স্বাক্ষর হওয়ার আগেই বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন কর্তৃক তড়িঘড়ি করে নিয়োগপত্র দিয়ে অহনা আরেফিনকে যোগদান করানো হয়। এ ঘটনা দুই উপাচার্যের মধ্যে নিয়োগ নিয়ে যোগসাজশের বিষয়টি আরও স্পষ্ট করে তোলে। রিজেন্ট বোর্ডের কার্যবিবরণী সই হওয়ার আগেই যোগদানের বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন রেজিস্ট্রার মো. মোরাদ হোসেন বলেন, ‘উপাচার্য স্যার এটি আলাদাভাবে অনুমোদন দিয়েছেন।’ তবে নিয়োগ প্রক্রিয়া নিয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি তিনি।
জানা গেছে, তিনজনের পরিবর্তে উপাচার্যকন্যা অহনা আরেফিনসহ মোট দু’জনকে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে প্রভাষক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। অপরজন কুয়েটের গ্র্যাজুয়েট। ওই বিভাগে প্রভাষক পদে আবেদনকারী রুয়েট গ্র্যাজুয়েট মোহাম্মদ আলী বলেন, ‘আমাদের ভাইভা অনেক ভালো হয়েছিল। রুয়েট বাদেও বুয়েটের এক প্রার্থী এখানে ভাইভা দিয়েছিলেন। দেশসেরা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা থাকতেও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নিয়োগ দেওয়া দুঃখজনক। নিয়োগ বোর্ড কীসের ওপর প্রাধান্য দিয়েছে, সেটা তারাই ভালো বলতে পারবে।’
জানা গেছে, প্রশ্নবিদ্ধ এ নিয়োগের পর বশেমুরবিপ্রবিকে চিঠি দিয়ে নিয়োগের বিষয়ে জানতে চেয়েছিল বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি)। চিঠিতে প্রভাষক পদের ওই নিয়োগ বিষয়ে বেশ কিছু তথ্যও তলব করে কমিশন। এর মধ্যে রয়েছে– নিয়োগ বিজ্ঞপ্তির কপি, বিজ্ঞাপিত পদের বিপরীতে আবেদনকারীর সংখ্যা, যোগ্যতার ভিত্তিতে সাক্ষাৎ প্রার্থীর সংখ্যা, তাঁদের শিক্ষকতা ও অভিজ্ঞতার তথ্য ছক এবং সিলেকশন বোর্ডের সুপারিশ।
এ নিয়োগের ছয় মাসের মধ্যে গত বছরের ১৭ আগস্ট কোস্টাল অ্যান্ড ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট বিভাগে প্রভাষক পদে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। ভাইভা ও সিলেকশন বোর্ডের সুপারিশের পর গত ২২ মার্চ সিন্ডিকেটে বশেমুরবিপ্রবি উপাচার্য অধ্যাপক ড. একিউএম মাহবুবের কন্যা ফারজানা মাহবুবকে নিয়োগ দেন বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. ছাদেকুল আরেফিন। গত ২৯ মার্চ নিয়োগপত্র দেওয়া হয় এবং সম্প্রতি তাঁর যোগদান কার্যকর করা হয়।
বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে সমকালকে বলেন, দুই উপাচার্যের ‘রফাদফায়’ তাঁদের কন্যাদের একে অপরের বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগ দেওয়া ন্যক্কারজনক ঘটনা। এতে সুস্পষ্ট অনিয়ম ও স্বজনপ্রীতি হয়েছে। তদন্ত করে এ অভিনব অনিয়ম-দুর্নীতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।
জানা গেছে, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের মেয়ে অহনা আরেফিন নাটোরের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশ আর্মি ইউনিভার্সিটি অব ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজি থেকে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে গ্র্যাজুয়েট। যখন নিয়োগ পেয়েছেন, তখন তাঁর মাস্টার্সও সম্পন্ন হয়নি। দিব্যি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতার চাকরি করে এখন মাস্টার্স করছেন! বিশ্ববিদ্যালয় সংশ্লিষ্টরা জানান, বাবা ছাদেকুল আরেফিন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ও মা ড. ইসরাত জাহান কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক হওয়ায় উভয় বিশ্ববিদ্যালয়ে বাবা-মায়ের কোটা থাকার পরও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে পারেননি অহনা আরেফিন। আর সেই তিনিই এখন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী শিক্ষার্থীদের শিক্ষক। শিক্ষক নিয়োগে স্বজনপ্রীতি ও গুরুতর এ অনিয়মের বিষয়টি নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। ববি উপাচার্য ছাদেকুল আরেফিনের মেয়ের এই বিতর্কিত নিয়োগের ঘটনায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সমালোচনার ঝড় তোলেন নেটিজেনরা।
দুই উপাচার্যের বক্তব্য
নিজেদের কন্যাকে নিয়োগের বিষয়ে দুই উপাচার্যের পারস্পরিক ‘সমঝোতা’র বিষয়ে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. ছাদেকুল আরেফিন বলেন, কোনো ধরনের সমঝোতা নয়, আমার বিশ্ববিদ্যালয়ে যথাযথ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে কোস্টাল অ্যান্ড ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট বিভাগে প্রভাষক পদে ফারজানা মাহবুবকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। আমরা লিখিত পরীক্ষা নিয়েছি, ভাইভা নিয়েছি। রাজশাহী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিশেষজ্ঞরা এসেছিলেন, তাঁরাও ছিলেন। আমাদের ট্রেজারার, ডিন এবং বিভাগের চেয়ারম্যান ছিলেন সিলেকশন বোর্ডে। এর পর আমরা তিনজনকে নিয়োগ দিয়েছি।
অভিযোগ উঠেছে, আপনার কন্যা অহনা আরেফিনকে বশেমুরবিপ্রবিতে নিয়োগের বিনিময়ে আপনি এ নিয়োগ দিয়েছেন– এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, এ বিষয়ে আমার কোনো মন্তব্য নেই। আমরা সব প্রক্রিয়া মেনে নিয়োগ দিয়েছি।
বশেমুরবিপ্রবির উপাচার্য ও নিয়োগ কমিটির চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. একিউএম মাহবুবের বক্তব্য জানতে চাইলে তিনি উত্তেজিত কণ্ঠে এ প্রতিবেদককে প্রথমে প্রশ্ন করেন, আপনার সমস্যা কী? কে কোথায় নিয়োগ পেল, এটা কি কোনো নিউজের বিষয়? সাংবাদিকরা কি ভালো কথা লিখতে পারে না?
বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের মেয়ে অহনা আরেফিনের নিয়োগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘যাদের নিয়োগ দিয়েছি তাদের মধ্যে সি ইজ দ্য বেস্ট। সেই এখন ওই ডিপার্টমেন্ট চালাচ্ছে। তার ভোকাল ভালো, উপস্থাপনা ভালো, পারফরম্যান্স ভালো, পড়ায় ভালো। তাহলে নিতে সমস্যা কী? ইন্ডিয়ার ভালো বিশ্ববিদ্যালয়ে সে মাস্টার্স করছে। নিয়োগবিধিতে কোথাও কি লেখা আছে, প্রাইভেট ভার্সিটিতে পড়লে তাকে নেওয়া যাবে না? তার পরও তো একজনকে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নিয়েছি।’ উপাচার্য একিউএম মাহবুব ক্ষুব্ধ কণ্ঠে আরও বলেন, ‘এখন থেকে সাংবাদিক আর ছাত্রলীগ নেতাদের সিলেকশন বোর্ডে রাখতে হবে, যেন তারা দেখতে পারে কে ভালো করেছে আর কে মন্দ করেছে।’
তিনি দাবি করেন, ‘কুয়েটের প্রার্থী ভাইভা বোর্ডে ইংরেজিতে প্রশ্ন করা সত্ত্বেও বাংলায় উত্তর দিয়েছেন, যার থেকে বুঝাই যায় তাঁর স্কিল কতদূর। ভালো ক্যাম্পাসে পড়লেই যে শিক্ষার্থী ভালো হবে এমন তো কোনো কথা নেই, প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী যদি ভাইভা বোর্ডে ভালো করতে পারে তাহলে সে তো নিয়োগ পেতেই পারে। কোনো উপাচার্যের মেয়ে হলেও পারে।’
ইউজিসির বক্তব্য
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় দেখভালের দায়িত্বে থাকা বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) সদস্য অধ্যাপক ড. দিল আফরোজা বেগম বলেন, দুই উপাচার্যের সন্তানকে অভিনব এই নিয়োগের বিষয়টি আমাদের নজরে এসেছে। আমরা ইউজিসি থেকে চিঠি দিয়ে তাঁদের কাছে জবাব চেয়েছিলাম। একটি বিশ্ববিদ্যালয় জবাবে লিখেছে– যাদের নিয়োগ দেওয়া হয়েছে তারাই বেস্ট। তাঁরা যথাযথ পদ্ধতি অনুসরণ করে নিয়োগ দিয়েছে। তিনি আরও বলেন, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো স্বায়ত্তশাসিত। সিলেকশন বোর্ড মনোনয়ন দিয়েছে, সিন্ডিকেট অ্যাপ্রুভ করেছে, সেখানে ইউজিসির খুব বেশি করণীয় কিছু নেই। তবে নৈতিকতার যে প্রশ্ন উঠেছে, শিক্ষা মন্ত্রণালয় চাইলে তা খতিয়ে দেখতে পারে।