ছোট থেকেই তুখর মেধার অধিকারী ছিলেন রফিকুল ইসলাম। এলাকার স্কুল-কলেজ থেকে পড়াশোনার পাঠ চুকিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে ভর্তি হয়েছিলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় (রাবি) ফলিত গণিত বিভাগে। ২০০৮ সালে প্রথম বর্ষের পরীক্ষায় ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট হয়ে উত্তীর্ণ হোন রফিক; কিন্তু এই প্রথম হওয়াটাই কাল হয়ে দাঁড়ালো রফিকের জীবনে। ভালো ফলাফল করায় শিবির সন্দেহে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা ফলিত গণিত বিভাগ থেকে তুলে নিয়ে পুলিশের হাতে সোপর্দ করেন তাকে। ফলে ৪ মাস ৭ দিন কারাবরণ করতে হয়েছে তাকে।
জেলখানায় থেকে দ্বিতীয় বর্ষের পরীক্ষায় অংশ নিয়ে সেখানেও প্রথম হোন রফিকুল। এভাবেই নানা প্রতিকুলতা অতিক্রম করে অনার্সে ৩.৮০ পেয়ে বিভাগে প্রথম স্থান অর্জন করেন তিনি। রফিকুলের স্বপ্ন ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হবেন; কিন্তু সেই স্বপ্ন পূরণ হতে দিলেন না বিভাগের তিন শিক্ষক। মাস্টার্সের থিসিস জালিয়াতির অভিযোগ এনে তার ছাত্রত্ব বাতিল করে দেওয়া হয়; ফলে প্রায় ১০ বছরেও প্রকাশ করা হয়নি রফিকুলের মাস্টার্সের ফলাফল।
কিন্তু রফিকুল থেমে নেই। ২০১৬ সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগ থেকে সিজিপিএ ৪.০০ পেয়ে মাস্টার্স সম্পন্ন করেন। পরবর্তীতে, রফিকুল ২০২৪ সালে চীনের ডালিয়ান ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজি থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং মেকানিক্স বিভাগে মাস্টার্স ডিগ্রি সম্পন্ন করেন। কিন্তু ভাগ্যের কি পরিহাস থিসিস জালিয়াতির অভিযোগ মাথায় নিয়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়তে হয়েছিল তাকে।
রফিকুল ইসলামের সাথে কথা বলে জানা যায়, অনার্সে প্রথম স্থান অর্জন করে ২০১৪ সালে বিভাগের তৎকালীন সভাপতি বর্তমান অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ড. শামসুল আলম সরকারের অধীনে মাস্টার্সের থিসিস নেন তিনি। এদিকে, ২০১৪ সালের ১১ আগস্ট ফলিত গণিত বিভাগে ২জন প্রভাষক চেয়ে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। মাস্টার্সের ফলাফল প্রকাশ না হওয়ায় পরীক্ষায় অংশগ্রহণের সার্টিফিকেট দেখিয়ে রফিকুলও এ নিয়োগে আবেদন করেন। কিন্তু নিয়োগ বোর্ডে মাস্টার্সের সনদ দেখাতে হবে বলে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করা হয়। এসময় রফিকুলের থিসিস সুপারভাইজার অধ্যাপক ড. মো. শামসুল আলম সরকারের বিরুদ্ধে সিলগালা প্যাকেট খুলে নম্বরপত্র টেম্পারিংয়ের অভিযোগ এনে পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকের কাছে লিখিত অভিযোগ দেন বিভাগের শিক্ষক ড. আব্দুল হক। এর পরিপ্রেক্ষিতে ফলাফল প্রকাশ স্থগিত ঘোষণা করা হয়। এদিকে ২৮ জুন এমএসসি পরীক্ষা শেষ হলেও ৮ মাসেও প্রকাশ করা হয়নি ফলাফল।
বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক দপ্তর এর কারণ জানতে চাইলে জানায়, বিভাগের ৮জন শিক্ষক ফলাফল প্রকাশের পক্ষে ছিলেন কিন্তু বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক ড. আলি আকবর ও অধ্যাপক ড. মো. আশরাফুজ্জামান খান চায়নি ফলাফল প্রকাশ হোক। ফলে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয় এবং সেখানে বলা হয় তদন্ত প্রতিবেদন না হওয়া পর্যন্ত ফলাফল ঘোষণা স্থগিত থাকবে।
২০১৫ সালের ২০ আগষ্ট তদন্ত কমিটির আহ্বায়ক অধ্যাপক ড. মোহা. রেজাউল করিম থিসিস পেপার জালিয়াতি ও হাতে নকল নম্বর আনার অভিযোগে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেন রফিকুলকে। ১৪ সেপ্টেম্বর ২০১৫ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪৬১তম সিন্ডিকেটে ১৩৭ নং সিদ্ধান্তে মাস্টার্সের রেজিষ্ট্রেশন বাতিলের মাধ্যমে রফিকুলের ছাত্রত্ব বাতিল করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন প্রশাসন।
এদিকে, দেশের ক্ষমতা পরিবর্তন হওয়ায় বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান উপাচার্য অধ্যাপক ড. সালেহ হাসান নকীবের কাছে রেজিষ্ট্রেশন পূনর্বহাল ও ফলাফল প্রকাশের দাবি জানিয়ে গত ৩ অক্টোবর লিখিত অভিযোগ দেন রফিকুল ইসলাম।
রফিকুলের ছাত্রত্ব বাতিলের নীল নকশায় যুক্ত তিন শিক্ষক হলেন বিভাগের বর্তমান সভাপতি অধ্যাপক ড. মো. আলি আকবর, অধ্যাপক ড. মো. আব্দুল হক ও
অধ্যাপক ড. মো. আশরাফুজ্জামান খান।
উপাচার্য বরাবর রফিকুলের লিখিত অভিযোগ থেকে জানা যায়, প্রভাষক নিয়োগকে কেন্দ্র করে আওয়ামী ফ্যাসিবাদি গোষ্ঠী পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী রফিকুলের বিরুদ্ধে এসব করেন। এভাবেই পরিকল্পনা অনুযায়ী প্রভাষক নিয়োগ প্রক্রিয়া থেকে রফিকুলকে বঞ্চিত করা হয়। এছাড়াও মাস্টার্সের সব পরীক্ষা শেষ করেও থিসিস জালিয়াতির অভিযোগে এনে তার ছাত্রত্ব বাতিল করা হয়।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ভুক্তভোগী রফিকুল ইসলাম বলেন, আমি ন্যায্য বিচারের দাবিতে বর্তমান প্রশাসনের কাছে লিখিত অভিযোগ জমা দিয়েছি।বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের কাছে আমার একটাই দাবি, ন্যায় বিচার নিশ্চিতের মাধ্যমে মাস্টার্সের রেজিষ্ট্রেশন পুনর্বহাল করে আমার ফলাফল প্রকাশ করা হোক।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে অভিযুক্ত শিক্ষক অধ্যাপক ড. মো. আশরাফুজ্জামান খান বলেন, আমার নামে উপাচার্য বরাবর লিখিত অভিযোগ কে দিয়েছে সেটি আমার জানা নেই। আর নকল করার কারণে রফিকুল ইসলামের ছাতত্ব বাতিল হয়েছে এটি সত্য। একজন ছাত্র যদি নকল করে আর সে বিষয়ে অভিযোগ করলে যদি দোষ হয়, তাহলে আমার বলার কিছু নেই।
এ বিষয়ে অধ্যাপক ড. মো. আলি আকবর বলেন, রফিকুল ইসলামের মাস্টার্সের পরীক্ষা কমিটিতে আমি কোন পদেই ছিলাম না; তবুও কেন আমার নামে অভিযোগ করা হয়েছে সে বিষয়ে আমার জানা নেই।
রফিকুলের প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তার থিসিস সুপারভাইজার অধ্যাপক ড. শামসুল আলম সরকার বলেন, রফিক তার সুবিচার পাওয়ার অধিকার রাখে। মাস্টার্সের সবকিছু শেষ করেও অন্যায়ভাবে তার ফলাফল বাতিল করা হয়েছে। রফিকের অন্যায় ছিল সে ভিন্নমত পোষণ করতেন। এছাড়াও থিসিস সুপার ভাইজার হিসেবে আমাকেও পরীক্ষা সংক্রান্ত কাজ থেকে আজীবন বিরত রাখার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। আমি চাই রফিক তার অধিকার ফিরে পাক এবং বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন তদন্ত করে দ্রুত সময়ের মধ্যে তার মাস্টার্সের ফলাফল প্রকাশ করুক।
এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. সালেহ হাসান নকীব বলেন, ‘আমরা রফিকুল ইসলামের কাছ থেকে একটি লিখিত অভিযোগ পেয়েছি। অভিযোগ পাওয়া মাত্রই সেটি বিশ্ববিদ্যালয়ের লিগ্যাল সেলে পাঠানো হয়।সেখান থেকে কিছু পরামর্শ আসছে আমাদের কাছে, যার ফলশ্রুতিতে আমরা একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছি। তদন্ত কমিটির সদস্যরা এ নিয়ে কাজ করছেন।’