গত ৫ আগস্ট ছাত্র জনতার গণঅভ্যুত্থানে সরকার থেকে পদত্যাগ করে ভারতে পালিয়ে যান সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এরপরই স্বামীকে নিয়ে থাইল্যান্ডে পাড়ি জমান রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় (রাবি) চিকিৎসা কেন্দ্রের সাধারণ চিকিৎসক আনিকা ফারিহা জামান অর্ণা। গত ফেব্রুয়ারি থেকে এ পর্যন্ত প্রায় নয় মাস অফিস করতে দেখা না গেলেও তিনি নিয়মিত বেতন-ভাতা পাচ্ছেন বলে জানা গেছে। চিকিৎসক আনিক ফারিহা জামান অর্ণা হলেন, রাজশাহী সিটি করপোরেশনের সদ্য সাবেক মেয়র খায়রুজ্জামান লিটনের বড় মেয়ে। তিনি একইসঙ্গে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের স্বাস্থ্য ও জনসংখ্যা বিষয়ক উপ-কমিটির সদস্য, রাজশাহী জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য ও যুব মহিলা লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ছিলেন। এছাড়া স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদ (স্বাচিপ) রাজশাহী জেলার সাধারণ সম্পাদকও ছিলেন। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ২০১৯ সালে ১ জুলাই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. এম আব্দুস সোবহানের সময়ে বাবার রাজনৈতিক ক্ষমতাবলে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিক্যালে সেন্টারে অস্থায়ীভাবে নিয়োগ পান। অস্থায়ী নিয়োগ পাওয়ায় ছয় মাস পরপর নবায়ন করে গত সাড়ে পাঁচ বছর ধরে রাবির মেডিক্যাল সেন্টারে কর্মরত তিনি। তার সর্বশেষ ছয় মাসের জন্য নবায়নকৃত চাকরির মেয়াদ আগামী ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত। যদি নতুন করে চাকরি নবায়ন করা না হয়, তাহলে সয়ংক্রিয়ভাবে চাকরি হারাবেন তিনি। এদিকে, চাকরিতে প্রবেশের সাড়ে পাঁচ বছর অতিবাহিত হলেও তাকে রাবির চিকিৎসক হিসেবে চেনেন না বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকাংশ শিক্ষক-শিক্ষার্থী। মাসে দু’একদিন অফিস করেই পুরো মাসের বেতন হাতিয়ে নিতেন তিনি। এছাড়াও কর্মক্ষেত্রে ক্ষমতার অপব্যবহারসহ বিভিন্ন অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। আরও জানা গেছে, সর্বশেষ গত ফেব্রুয়ারি মাসের ১১ তারিখ অফিস করেছিলেন আনিকা ফারিহা জামান অর্ণা। এরপর আর তাকে অফিস করতে দেখা যায়নি। অফিস না করেও গত ৯ মাস তিনি বেতন-ভাতা হিসেবে প্রায় ৪ লক্ষ ৩০ হাজার টাকা পেয়েছেন। অষ্টম গ্রেডের বেতন পেতেন এ নেত্রী। মেডিক্যালের অন্যান্য চিকিৎসকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, নিয়োগ পাওয়ার পর থেকে নিয়মিত কখনোই অফিস করতে দেখা যায়নি অর্ণা জামানকে। মাসে দু’একদিন অফিস করতেন তিনি। সকাল ৯টা থেকে ৪টা পর্যন্ত তার ডিউটি থাকলেও মেয়র কন্যা অর্ণা অফিস করতেন দুপুর ১২টা থেকে ২টা পর্যন্ত। অফিস চলাকালে তার সঙ্গে থাকতেন একাধিক অস্ত্রধারী বডিগার্ড। ফলে মেডিক্যালের অন্যান্য চিকিৎসক ও চিকিৎসা নিতে আসা শিক্ষার্থীরা এ নিয়ে খুব আতঙ্কে থাকতেন। মেডিক্যালের অন্যান্য চিকিৎসকরা আরও জানান, তার অফিস টাইমের পুরো সময় জুড়ে চেম্বারের সামনে ভিড় করতেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (রুয়েট) ও রাজশাহী জেলা ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। সেখানেই থেমে থেমে বিভিন্ন স্লোগান দিতেন তারা। এতে রোগ নির্ণয়ের জন্য আসা সাধারণ শিক্ষার্থীরা চিকিৎসা সেবা না নিয়েই ফিরে যেতেন। সাধারণ শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকাংশ শিক্ষার্থী এ চিকিৎসককে কখনোই মেডিক্যাল সেন্টারে দেখেননি। মেডিক্যাল সেন্টারে আনিকা ফারিহা জামান অর্ণা নামে কেউ চাকরি করতেন, এটাই অনেকে জানেন না। কিছু শিক্ষার্থী তার বিষয়ে জানলেও তার চেম্বারের সামনে ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীদের উপস্থিতি ও অর্ণার বডিগার্ডের ভয়ে চিকিৎসা নিতে যেতেন না। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মেডিক্যাল সেন্টারের এক ডাক্তার বলেন, আনিকা ফারিহা জামান অর্ণা তেমন একটা ডিউটি করতেন না। মাসে দু’একদিন হঠাৎ তাকে দেখা যেত। যেদিন অফিসে আসতেন, সেদিন তার সঙ্গে অস্ত্রধারী দুজন বডিগার্ড থাকতেন। ফলে আমিসহ আমার সহকর্মীরা খুব আতঙ্কে থাকতাম। ভয়ে তার চেম্বারের সামনে যেতাম না। এদিকে, যতটুকু সময় অফিস করতেন তিনি, সেই সময়টাতে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা সবসময় তার চেম্বারের সামনে উপস্থিত থাকতেন এবং মাঝেমধ্যে স্লোগান দিতেন। অভিযোগের বিষয়ে জানতে আনিকা ফারিহা জামান অর্ণার ফোনে ও হোয়াটসঅ্যাপে একাধিকবার কল-মেসেজ দিয়েও কোন উত্তর পাওয়া যায়নি। এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসা কেন্দ্রের প্রধান চিকিৎসক ডা. মাফরুহা সিদ্দিকা লিপি বলেন, ডা. আনিকা ফারিহা জামান অর্না বিগত ৮-৯ মাস ধরে ডিউটি করছেন না। তবে তিনি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক বেতন-ভাতা ঠিকই পাচ্ছেন। আমরা অনেক চেষ্টা করেও তাকে এ পর্যন্ত রিচ করতে পারিনি। আমরা এ বিষয়টি অভিযোগের মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রারকে অবগত করেছি। এখন বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন যা ভালো মনে করেন, তাই করবেন। এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. সালেহ হাসান নকীব বলেন, ৫ আগস্টের পর যে সব শিক্ষক-কর্মকর্তা ও কর্মচারী নিজ দপ্তরে উপস্থিত নেই, আমরা তাদের কাছে নোটিশ পাঠিয়েছি। তবে আনিকা ফারিহা জামান অর্ণা যেহেতু নয় মাস ধরে অফিস করছেন না, তার বিষয়টি অবশ্যই ভিন্নভাবে দেখতে হবে। তার বিষয়ে বিস্তারিত জেনে বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে হবে।