সা‌বেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নি‌য়োগ-বদ‌লি বা‌ণিজ‌্য, অনুসন্ধানে দুদক

সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও তার ঘ‌নিষ্ট ক‌য়েকজন সহযোগীদের বিরুদ্ধে ঘু‌ষের বি‌নিম‌য়ে নি‌য়োগ ও বদ‌লি বা‌ণিজ্যের অভিযোগ ওঠেছে। অভিযোগের মধ্যে রয়েছে-মন্ত্রী হওয়ার পর থে‌কেই পু‌লিশ, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর ও ফায়ার সার্ভিসসহ তার অধীন মন্ত্রণাল‌য়, দপ্তরে মোটা অং‌কের ঘুষ নি‌য়ে নি‌য়োগ দি‌তেন। নি‌য়োগ ও বদ‌লি বাণিজ‌্য ক‌রে বিপুল পরিমাণ অবৈধ টাকা অর্জন ক‌রে তা নিরাপ‌দে বি‌দে‌শে পাচার ক‌রে‌ছেন তারা।

অভি‌যোগ র‌য়ে‌ছে, সা‌বেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ঘুষ-বা‌ণি‌জ্যের নেতৃ‌ত্ব দি‌তেন। তার ইশারায় তা‌কে সহ‌যে‌াগিতা কর‌তেন মন্ত্রণাল‌য়ের সা‌বেক অতিরিক্ত সচিব ড. হারুন অর রশীদ বিশ্বাস। তা‌দের সা‌থে এই অপক‌র্মে লিপ্ত ছি‌লেন যুগ্ম সচিব ধনঞ্জয় কুমার দাস, মন্ত্রীর সহকারী একান্ত সচিব (এপিএস) মনির হোসেন, জনসংযোগ কর্মকর্তা শরীফ মাহমুদ অপু, প্রশাসনিক কর্মকর্তা মোল্লা ইব্রাহিম হোসেন।

পু‌লিশ, ফায়ার সা‌র্ভিস ও মাদকসহ অধীনস্থ দপ্তরগু‌লো‌তে যত নি‌য়োগ ও বদ‌লি হ‌য়ে‌ছে তা‌দের হাত ধ‌রেই হ‌য়ে‌ছে। প্রত্যেক‌টি নি‌য়োগ ও বদ‌লি‌তে বড় ধর‌নের ঘুষ বাণিজ‌্য হ‌য়ে‌ছে।

এদিকে, সা‌বেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামানসহ সহ‌যো‌গী‌দের ঘুষ বা‌ণি‌জ্যের বিরু‌দ্ধে অনুসন্ধা‌নে নে‌মেছে দুর্নী‌তি দমন ক‌মিশন। ইতিম‌ধ্যে এ বিষ‌য়ে অনুসন্ধানের জন্য অনুসন্ধানকারী টিম গঠন করা হ‌য়ে‌ছে। উক্ত টিম অনুসন্ধান কাজও শুরু ক‌রে‌ছে।

বৃহস্প‌তিবার (১৫ আগস্ট) দুদ‌কের ডেপু‌টি ডিরেক্টর আকতারুল ইসলাম রাইজিংবি‌ডি‌কে এ তথ‌্য নি‌শ্চিত ক‌রে‌ছেন।

তি‌নি আরও জানান, সা‌বেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান কামলসহ সহ‌যো‌গী‌দের বিরু‌দ্ধে ঘুষ বাণি‌জ্যের অভিযোগ অনুসন্ধা‌নে কমিশনের উপপরিচালক মো. জাহাঙ্গীর আলমের নেতৃত্বে একটি অনুসন্ধান টিম গঠন করা হয়েছে।

অভিযোগে জানা যায়, প্রতি‌টি নিয়োগের জন্য জনপ্রতি ৮-১২ লাখ টাকা ঘুষ নেওয়া হয়। বড় বড় প‌দে বদ‌লিতে নি‌য়ে‌ছে কোটি টাকার ঘুষ।

সা‌বেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান কামা‌লের নি‌র্দে‌শে তৎকালীন অতিরিক্ত সচিব ড. হারুন অর রশীদ বিশ্বাসের নেতৃত্বে গ‌ড়ে ওঠা সিন্ডিকেট মন্ত্রণাল‌য়ের সব‌কিছু নিয়ন্ত্রণ কর‌তেন। তি‌নি অবস‌রে যাওয়ার পরও সব‌কিছু তার মাধ‌্যমেই হ‌তো। যুগ্ম সচিব ধনঞ্জয় কুমার দাস, মন্ত্রীর সহকারী একান্ত সচিব (এপিএস) মনির হোসেন, জনসংযোগ কর্মকর্তা শরীফ মাহমুদ অপু ঘু‌ষের টাকা নি‌য়ে তা‌লিকা কনফার্ম কর‌তেন। বছ‌রের পর বছর ধ‌রে ঘুষ নি‌য়ে নি‌য়োগ ও বদ‌লি বা‌ণিজ‌্য ক‌রে হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে এই সিন্ডিকেট।

অভিযোগ আছে, জেলায় পুলিশ সুপার নিয়োগে সর্বনিম্ন ৮০ লাখ থেকে ২ কোটি টাকা পর্যন্ত নিতো এই চক্র। এই সিন্ডিকেটের আশীর্বাদ ছাড়া পুলিশের কেউ কোনো জেলায় বা গুরুত্বপূর্ণ পদে পদায়ন পেতেন না। জেলা পুলিশ সুপার হিসেবে পদায়নের ক্ষেত্রে ১ থেকে ৩ কোটি টাকা নিতো এই সিন্ডিকেট।

২০২২ সালের ৩০ জুন গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের (জিএমপি) কমিশনার হিসেবে নিয়োগ পান ডিআইজি মোল্ল্যা নজরুল ইসলাম। পাঁচ কোটি টাকার বিনিময়ে মোল্ল্যা নজরুলকে গাজীপুরের কমিশনার হিসেবে পদায়ন করা হয়। এর মাস খানেক আগে হারুন অর রশীদ বিশ্বাসের কাছে ৫ কোটি টাকার একটি চেক দেন মোল্ল্যা নজরুল। পরবর্তীতে গাজীপুরের কমিশনার হিসেবে নিয়োগের পর হোটেল ওয়েস্টিনে হারুন অর রশীদের কাছে নগদ ২ কোটি টাকা দেন তিনি। এ সময় আগের চেকটি ফেরত নিয়ে মোল্ল্যা নজরুল ৩ কোটি টাকার একটি চেক দেন। পরবর্তীতে বাকি টাকাও দেওয়া হয়। এসব টাকা বস্তায় ভরে পৌঁছে দেওয়া হতো আসাদুজ্জামান খান কামালের ফার্মগেটের বাসায়।

মন্ত্রীপুত্র জ্যোতি পুলিশের এক কর্মকর্তাকে বদলি করতে গিয়ে ব্যর্থ হন। কামাল তাকে জানান, হারুন অর রশীদের সঙ্গে কথা বলতে। এ নিয়ে গত জুন মাসে বাসায় কলহ তৈরি হয়। ক্ষুব্ধ হয়ে বাসায় ব্যাপক-ভাঙচুর করেন জ্যোতি।

এনজিওর ‘নো অবজেকশন সার্টিফিকেট’ বা ‘এনওসি’ দিতে গিয়ে প্রতি সংস্থা থেকে ৮০ লাখ থেকে ১ কোটি টাকা দিতে হতো আসাদুজ্জামান খান কামালের দরবারে। এর মধ্যে ২০১৮ সালে রাজধানীর উত্তরা এলাকার একটি উন্নয়ন সংস্থার এনওসি নিতে গেলে বিপত্তি শুরু হয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে। এর আগে পুলিশের বিশেষ শাখা, জেলা প্রশাসক, এনএসআই ইতিবাচক প্রতিবেদন দাখিল করে। তারপরও অদৃশ্য কারণে ফাইলটি মাসের পর মাস আটকে রাখা হয় মন্ত্রণালয়ে। বাধ্য হয়ে ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে নির্বাচনের আগে মন্ত্রীকে ৮৫ লাখ টাকা দেওয়া হয়। ফার্মগেট এলাকায় কামালের বাসার সামনে টাকার ব্যাগটি দেওয়া হয় তার পরিবারের এক সদস্যের কাছে।

ফায়ার সার্ভিস এবং সিভিল ডিফেন্সে কোনো সার্কুলার হলেই মন্ত্রীর দপ্তর থেকে একটি তালিকা পাঠানো হতো। সে অনুযায়ী তাদেরকে নিয়োগ দিতে ফায়ার সার্ভিসকে বাধ্য করতেন সাবেক এই মন্ত্রী। ২০২৩ সালে ২ অক্টোবর ৫৩৫ জনকে নিয়োগ দেয় ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তর। এর মধ্যে ছিলেন ৪৩৬ পুরুষ ফায়ার ফাইটার, ১৫ জন নারী ফায়ার ফাইটার ও ৮৪ জন গাড়িচালক। নিয়োগ কার্যক্রমের শুরুতেই মন্ত্রীর দপ্তর থেকে ২৫০ জনের একটি তালিকা পাঠানো হয় ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের কাছে। সাবেক এই মন্ত্রীর নির্দেশে সেই তালিকা অনুযায়ী নিয়োগ দিতে বাধ্য হয় ফায়ার সার্ভিস। এভা‌বেই নি‌য়োগ ও বদ‌লি বা‌ণিজ‌্য ক‌রে সা‌বেক মন্ত্রীর সি‌ন্ডি‌কেট কোটি কো‌টি টাকা ঘুষ নি‌য়ে বি‌দে‌শে পাচার ক‌রে‌ছে ব‌লে অভিযোগ আছে।-রাইজিংবিডি.কম