সাংবিধানিক ও রাষ্ট্রীয় সংকট চায় না বিএনপি

রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের অপসারণের দাবিকে সন্দেহের চোখে দেখছে বিএনপি। দলের নীতিনির্ধারকরা মনে করছেন, রাষ্ট্রপতি পদত্যাগ করলে কিংবা তিনি অপসারিত হলে সাংবিধানিক শূন্যতা তৈরি হতে পারে। ফলে কোনোভাবেই দেশে যাতে নতুন করে কোনো সাংবিধানিক কিংবা রাজনৈতিক সংকট সৃষ্টি না হয় সে বিষয়ের ওপর গুরুত্ব দিচ্ছে দলটি। এদিকে গতকাল প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে দেখা করে রাষ্ট্রপতির পদত্যাগ ইস্যুতে নিজেদের অবস্থান তুলে ধরেছে বিএনপি।

গত মঙ্গলবার রাতে বিএনপির জ্যেষ্ঠ নেতাদের ভার্চুয়াল বৈঠকে এই অভিমত উঠে আসে। এরপর গতকাল বুধবার স্পর্শকাতর এই বিষয়টিকে নিয়ে দলটি তাদের অবস্থান পরিষ্কার করেছে। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে গতকাল সন্ধ্যায় বিএনপি চেয়ারপারসনের গুলশান কার্যালয়ে দলের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরামের স্থায়ী কমিটির বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।

সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগপত্র ইস্যুতে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের মন্তব্য ঘিরে পরিস্থিতি নতুন মোড় নেয়।

রাষ্ট্রপতির মন্তব্যের পর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্বদানকারীদের অনেকেই তাঁর বিদায় চাইলেও আইন ও সংবিধান অনুযায়ী তাঁকে পদ থেকে সরিয়ে দেওয়ার সুযোগ আছে কি না, সেই প্রশ্ন উঠেছে। একই প্রশ্ন তুলেছে বিএনপি।

এমন প্রেক্ষাপটে গতকাল সকালে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় গিয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির তিনজন সদস্য প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। তাঁরা দলের অবস্থান প্রধান উপদেষ্টাকে অবহিত করেন।রাষ্ট্রপতির অপসারণ নিয়ে বিএনপির অবস্থান স্পষ্ট হওয়ার পর এখন এই প্রক্রিয়া কত দূর এগোয় তা পর্যবেক্ষণ করবে দলটি।

অবশ্য বিএনপির সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে জামায়াত বলেছে, অসত্য বক্তব্য দেওয়ার কারণে রাষ্ট্রপতি পদে থাকার আইনগত অধিকার হারিয়েছেন মো. সাহাবুদ্দিন। ইসলামী আন্দোলনও তাঁর পদত্যাগ দাবি করেছে। হেফাজতে ইসলাম মঙ্গলবার এক বিবৃতিতে রাষ্ট্রপতির পদত্যাগ চেয়েছে। তবে বিএনপির সঙ্গে একমত পোষণ করে তাদের আন্দোলনের শরিকরা মনে করছে, দেশের সংকটময় পরিস্থিতিতে নতুন সংকট কাম্য নয়।

বিএনপির বৈঠক সূত্রে জানা গেছে, গত কয়েক দিনের ঘটনাক্রম বিশ্লেষণ করেছে দলটি। দলের নেতারা মনে করেন, যেভাবে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে সেটি নিয়েই সন্দেহ তৈরি হয়েছে। এর পরপরই রাষ্ট্রপতির পদত্যাগের দাবি, বঙ্গভবন ঘেরাওসহ হঠাৎ ঘটে যাওয়া কয়েকটি ঘটনায় সেই সন্দেহ আরো বাড়িয়েছে। দলের নেতারা মনে করছেন, পুরো প্রক্রিয়া নিয়েই দুরভিসন্ধি আছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দলের একাধিক নেতা বলেন, রাষ্ট্রপতিকে সরানোর পেছনের কারণটি অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদ দীর্ঘায়িত করার প্রক্রিয়া কি না তা নিয়ে ভাবছেন তাঁরা। কারণ সরকারের বক্তব্যে সংসদ নির্বাচনের কথা স্পষ্ট না হওয়ায় নানা ধরনের আলোচনা আছে।

বিএনপি নেতারা বলছেন, গণ-অভ্যুত্থানের পর সরকার পরিবর্তনের পর দেশের সংবিধান স্থগিত করা হয়নি। রাষ্ট্রপতির কাছে শপথ নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। ফলে এখন সংবিধানের বাইরে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই।

দলটির বিভিন্ন পর্যায়ের আরো কয়েকজন নেতার সঙ্গে আলোচনা করে যে ধারণা পাওয়া গেছে, তাতে রাষ্ট্রপতি কোন প্রেক্ষাপটে কতটা সিরিয়াসলি এ কথা বলেছেন তা-ও বোঝার চেষ্টা করছেন তাঁরা। তবে দলের নেতাদের প্রায় সবাই একমত যে এখন রাষ্ট্রপতিকে অপসারণ করা ঠিক হবে না।

সাংবিধানিক ও রাষ্ট্রীয় সংকট দেখতে চাই না : সালাহউদ্দিন

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ বলেছেন, রাষ্ট্রপতির পদ নিয়ে এ মুহূর্তে দেশে সাংবিধানিক, রাষ্ট্রীয় ও রাজনৈতিক সংকট তৈরি হোক, সেটা তাঁদের কাছে কাম্য নয়।

গতকাল বিকেলে গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি এ কথা বলেন।

রাষ্ট্রপতির পদে শূন্যতা সৃষ্টি করতে ফ্যাসিবাদের দোসররা নানা চক্রান্ত করছে—এই অভিযোগ করে এ ব্যাপারে সবাইকে সজাগ থাকার আহ্বানও জানান তিনি।

সালাহউদ্দিন বলেন, রাষ্ট্রপতির পদটা সর্বোচ্চ সাংবিধানিক পদ। পদত্যাগের মাধ্যমে এই পদে শূন্যতা সৃষ্টি হলে সাংবিধানিক শূন্যতা সৃষ্টি হবে, রাষ্ট্রীয় সংকট তৈরি হবে।

এই বিএনপি নেতা বলেন, ‘রাষ্ট্রীয় সংকট সৃষ্টির মাধ্যমে যদি গণতন্ত্রে উত্তরণের পথটা বিলম্বিত হয়, বাধাগ্রস্ত হয় বা কণ্টকাকীর্ণ হয় তা জাতির কাম্য নয়। সুতরাং পতিত ফ্যাসিবাদের এবং তাদের দোসররা যাতে কোনো রকমের ষড়যন্ত্র বা এখানে অন্য কিছুর পাঁয়তারা না করতে পারে সে জন্য আমরা সবাইকে সজাগ থাকার জন্য আহ্বান জানাচ্ছি এবং আমরা ঐক্যবদ্ধ আছি। আমরা ঐক্যবদ্ধভাবেই এসব ষড়যন্ত্রের মোকাবেলা করব।’

আপনারা রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের পদত্যাগ বা অপসারণ চান কি না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, রাষ্ট্রপতির পদে শূন্যতা এই মুহূর্তে রাষ্ট্রীয় ও সাংবিধানিক সংকট সৃষ্টি করবে যেটা জাতির কাম্য নয়।

প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে অবস্থান জানাল বিএনপি

রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে দেশজুড়ে নানা আলোচনার মধ্যে সকালে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বৈঠক করেছেন বিএনপির তিন নেতা।

দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খানের নেতৃত্বে প্রতিনিধিদলে ছিলেন স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী ও সালাহউদ্দিন আহমদ। রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় সকাল সাড়ে ১০টা থেকে ঘণ্টাখানেক বৈঠকটি হয়।

পরে সাংবাদিকদের নজরুল ইসলাম খান বলেন, ‘পতিত ফ্যাসিবাদ এবং তাদের দোসররা নানা কৌশলে নানাভাবে দেশে রাজনৈতিক ও সাংবিধানিক সংকট সৃষ্টির চেষ্টা করছে। দীর্ঘদিন লড়াই করে বহু সাথীর রক্তের বিনিময়ে আমরা যে পরিবর্তন অর্জন করেছি, এই পরিবর্তন সুরক্ষা এবং গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য আমাদের জাতীয় ঐক্য আরো সুদৃঢ় করা দরকার। এখানে সব রাজনৈতিক দল, শ্রেণি-পেশাসহ ছাত্রদের সংগঠনের সবার একটা দৃঢ়তর ঐক্য গড়ে তোলা দরকার, যাতে কেউ কোনোভাবে দেশে নতুন করে কোনো সাংবিধানিক কিংবা রাজনৈতিক সংকট সৃষ্টি করতে না পারে। এ ব্যাপারে আমাদের সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে। কারণ ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মূল আকাঙ্ক্ষা গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা।’

রাষ্ট্রপতির অপসারণ নিয়ে আলোচনা হয়েছে কি না প্রশ্ন করা হলে নজরুল ইসলাম খান বলেন, ‘দেশে যাতে কোনো রাজনৈতিক ও সাংবিধানিক সংকট সৃষ্টি না হয় সে বিষয়ে সবার খেয়াল রাখার কথা হয়েছে এবং সেটা যদি কেউ করতে চায় তাহলে আমরা সবাই মিলে সেটা মোকাবেলা করব।’

রাষ্ট্রপতির অপসারণ চায় জামায়াত

জামায়াতের মুখপাত্র দলের কেন্দ্রীয় প্রচার বিভাগের সেক্রেটারি মতিউর রহমান আকন্দ বলেন, ৫ আগস্ট রাষ্ট্রপতি তাঁর ভাষণে বলেছিলেন, শেখ হাসিনা পদত্যাগপত্র দিয়েছেন, তিনি গ্রহণ করেছেন। ৭৮ দিন পর এসে তিনি ভিন্ন কথা বলছেন। এখন অসত্য বক্তব্য দিয়ে তিনি শপথ ভঙ্গ করেছেন, বিশ্বাস ভঙ্গ করেছেন। এ কারণে আইনগত ও নৈতিক কারণে তাঁর রাষ্ট্রপতির পদে থাকার অধিকার নেই।

পদত্যাগ চাইল ইসলামী আন্দোলনও

ইসলামী আন্দোলনের সিনিয়র নায়েবে আমির মুফতি সৈয়দ মুহাম্মদ ফয়জুল করীম বলেছেন, ‘রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দিন চুপ্পু পুরো দেশবাসীর সঙ্গে প্রকাশ্যে মিথ্যাচার করে শপথ ভঙ্গ করেছেন। রাষ্ট্রের অভিভাবক হিসেবে মিথ্যাচার ও শপথ ভঙ্গ করে তিনি তাঁর পদে থাকার নৈতিকতা হারিয়েছেন। অবিলম্বে আমরা তাঁর পদত্যাগ দাবি করছি।’

গতকাল বুধবার বিকেলে বাকেরগঞ্জ সরকারি কলেজ মাঠে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ বরিশালের বাকেরগঞ্জ উপজেলা শাখা আয়োজিত গণসমাবেশে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এ দাবি জানান।

কৌশলী প্রতিক্রিয়া এবি পার্টির

এবি পার্টির সদস্যসচিব মুজিবুর রহমান মঞ্জু অবশ্য কৌশলী প্রতিক্রিয়া দিয়েছেন। কালের কণ্ঠকে তিনি বলেন, ‘রাষ্ট্রপতি বিভ্রান্তিমূলক দুই ধরনের বক্তব্য দিয়ে নিজেই সমস্যাকে জটিল করে তুলেছেন। আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুলের সঙ্গে আমরা একমত। রাষ্ট্রপতি রাষ্ট্রের গোপনীয়তা ও শপথ ভঙ্গ করেছেন। এ পদে থাকার আর কোনো নৈতিক অধিকার তাঁর নেই। আমরা আশা করব, মো. সাহাবুদ্দিন নিজে থেকে রাষ্ট্রপতি পদ থেকে পদত্যাগ করবেন।’

বিএনপির সঙ্গে একমত জোট শরিকরা

জানতে চাইলে গণতন্ত্র মঞ্চের শীর্ষ নেতা ও বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, ‘রাষ্ট্রপতি পদের যে মর্যাদা ও সম্মান, সেই জায়গা থেকে স্ববিরোধী বক্তব্য দেওয়া তাঁর সমীচীন হয়নি, নৈতিক স্খলনের পর্যায়েও পড়ে। তবে এই মুহূর্তে দেশে বহুমুখী যে সংকট আছে, এর মধ্যে নতুন কোনো সংকটের জায়গাটা আমরা নিশ্চয় তৈরি করতে চাই না। চাই না যে এমন কোনো পরিস্থিতি তৈরি হোক, যেখানে সরকার বিতর্কিত হবে, প্রশ্নবিদ্ধ হবে।’

বিএনপির সঙ্গে একমত পোষণ করে ১২ দলীয় জোট, জাতীয় সমমনা জোটসহ অন্য দলগুলোও। ১২ দলীয় জোটের মুখপাত্র ও বাংলাদেশ এলডিপির মহাসচিব শাহাদাত হোসেন সেলিম বলেন, ‘যা ঘটছে তা একটি অস্বস্তিকর ঘটনা। এ বিষয়ে বিএনপির বক্তব্যের সঙ্গে আমরাও একমত।’

বাংলাদেশ জাতীয় পার্টির (বিজেপি) চেয়ারম্যান আন্দালিব রহমান পার্থও মনে করেন, বিএনপির বক্তব্য সঠিক। এ মুহূর্তে এটি কোনো বড় ইস্যু নয়। যেগুলো ইস্যু সেগুলো দেখা উচিত। যেমন—সংস্কার, নিত্যপণ্যের মূল্য নিয়ন্ত্রণ, এসব মুখ্য হওয়া উচিত।

বিদ্যমান নিয়ম অনুযায়ী, সংসদ রাষ্ট্রপতিকে অভিশংসন করতে পারে। কিন্তু সরকার পরিবর্তনের পর সংসদ বাতিল করে দেওয়ায় সেই সুযোগ আর নেই। আবার রাষ্ট্রপতি চাইলে স্পিকারের কাছে পদত্যাগ করতে পারেন। কিন্তু স্পিকার পদত্যাগ করেছেন এবং ডেপুটি স্পিকার কারাগারে থাকায় সেটিও সম্ভব হচ্ছে না।

এমন পরিস্থিতিতে প্রধান বিচারপতি রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করতে পারেন কি না—এ বিষয়ে পরামর্শ নেয় অন্তর্বর্তী সরকার। প্রধান বিচারপতি আইনের ব্যাখ্যা দিয়ে তাঁর পক্ষে সেই দায়িত্ব পালনের সুযোগ নেই বলে জানান।

বিএনপির আলোচনায় এই বিষয়গুলো উঠে এসেছে। পুরো বিষয় বিশ্লেষণ করে বিএনপির পর্যবেক্ষণ হচ্ছে, রাষ্ট্রপতি পদত্যাগ করলে কিংবা তাঁকে অভিশংসন করতে গেলে সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা থাকবে না।