ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট হাসিনা সরকারের পতনের পর দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের সীমান্তের অধিকতর জটিল রুট দিয়ে আওয়ামী লীগ নেতাদের দেশ ছাড়ার হিড়িক পড়েছে। এর মধ্যে অন্যতম সিলেট সীমান্তের বেশ কিছু রুট। এসব রুট দিয়ে বৈধ-অবৈধভাবে অনেক নেতা ভারতে পাড়ি দিচ্ছেন। এর মধ্যে সর্বাধিক ভিড় লক্ষ করা গেছে কানাইঘাটের ‘দনা’ এবং গোয়াইনঘাটের ‘তামাবিল’ রুটে।
এই দুই রুট ব্যবহার করে এরই মধ্যে অনেক নেতা সীমান্ত পাড়ি দিয়ে প্রতিবেশী দেশ ভারতে চলে গেছেন। এই নেতাদের সীমান্ত পাড়ি দিতে সহায়তা করছে ‘বুঙ্গাড়ি’ সিন্ডিকেট।
সীমান্তে চোরাকারবারে যারা জড়িত তাদের স্থানীয়ভাবে ‘বুঙ্গাড়ি’ ডাকা হয়। এই ‘বুঙ্গাড়ি’ সিন্ডিকেটের মাধ্যমেই ভারত থেকে চিনি, গরু, মহিষ, ওষুধসহ নানা পণ্য অবৈধ পথে বাংলাদেশে প্রবেশ করে।চোরাই পথের অলিগলি এদের নখদর্পণে। এরাই বর্তমানে অবৈধ পথে আওয়ামী লীগ নেতাদের ভারতে পালিয়ে যেতে সাহায্য করছে। ফলে বর্তমানে সীমান্তের এপার-ওপার দুই পারেই গড়ে উঠেছে ‘বুঙ্গাড়ি’ সিন্ডিকেট। নেতাদের সীমান্ত পার করিয়ে দেওয়ার বিনিময়ে এই সিন্ডিকেট হাতিয়ে নিচ্ছে মোটা অঙ্কের টাকা।
৫ আগস্ট শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে চলে যাওয়ার পর আওয়ামী লীগ নেতারা নিজেদের অনিরাপদ মনে করে সিলেটে ভারত সীমান্তে জড়ো হতে শুরু করেন। ৮ আগস্টের মধ্যে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক নেতা সীমান্ত দিয়ে ভারত চলে যেতে সক্ষম হন। তবে বেশ কদিন পর সীমান্ত দিয়ে ভারতে পাড়ি জমান সাবেক প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী শফিকুর রহমান চৌধুরী এবং সিলেট সিটি করপোরেশনের (সিসিক) সাবেক মেয়র আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী। আওয়ামী লীগ নেতাদের বেশির ভাগ দনা সীমান্ত দিয়ে ভারতে পাড়ি জমালেও এই দুই নেতা গোয়াইনঘাটের তামাবিল সীমান্ত দিয়ে দেশ ছাড়েন।
যে কারণে নিরাপদ সীমান্তের দনা রুট
কানাইঘাট উপজেলার এক পাশে জকিগঞ্জঘেঁষা দনা সীমান্ত, অন্য পাশে জৈন্তাপুরঘেঁষা সুরইঘাট সীমান্ত।এ দুটি চোরাচালানের ব্যস্ততম রুট। এই রুট দুটিতে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর নজরদারি বাড়লে বিকল্প রুট হয়ে ওঠে লোভাছড়া চা-বাগানঘেঁষা আলুবাড়ি রুট। এই তিনটি রুটের মধ্যে দনা রুট সবচেয়ে নিরাপদ। কারণ দনা অনেকটা দ্বীপের মতো। এক পাশে ভারত সীমান্ত, অন্য পাশে জকিগঞ্জের কারাবাল্লা, বাকি দুই পাশে সুরমা নদীর মূল অংশ দনা সীমান্তকে আলাদা করেছে। নদী পার হয়ে কম জনবসতির পাহাড়ি এলাকা দনায় যেতে হয়। সেখানে মোবাইল নেটওয়ার্কও দুর্বল। ফলে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী চাইলেই হুট করে অভিযান চালাতে পারে না।
এই রুটের বুঙ্গাড়ি সিন্ডিকেটের সদস্যরাই বর্তমানে আওয়ামী লীগ নেতাদের সীমান্ত পারে সহায়তা করছে। সম্পর্কের কারণে প্রথম দিকে দু-একজনকে পারাপারে সহায়তা করলেও পরে এটিকে পরিণত করা হয় মোটা অঙ্কের অর্থ আয়ের মাধ্যম।
দনা সীমান্তের বুঙ্গাড়ি সিন্ডিকেটের সদস্য সাদ্দাম, রাজুসহ কয়েকজন এই কাজে সহায়তা করছেন বলে জানা গেছে। স্থানীয় ইউনিয়ন সদস্য নাজিম উদ্দিন ও মোস্তাক আহমদও এর সঙ্গে জড়িত বলে জানা গেছে। অন্যদিকে সুরইঘাট রুট নিয়ন্ত্রণ করেন তোতা মিয়া। মোবাইলে বহুবার চেষ্টা করেও তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করা যায়নি। আবার কেউ ফোন কল রিসিভ করেননি।
তবে ইউনিয়ন সদস্য নাজিম উদ্দিনের সঙ্গে কথা হলে তিনি অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, ‘আমি আর মোস্তাক না হলে বিচারপতি মানিককে আটকানো সম্ভব হতো না। আমিই প্রথম ফেসবুকে বিচারপতি মানিককে আটকের পোস্ট দিয়েছিলাম। অথচ এখন আমাদের নাম বুঙ্গাড়ি সিন্ডিকেটের সঙ্গে জড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। মূলত সাদ্দাম হোসেন সেখানকার বড় চোরাকারবারি। সে দীর্ঘদিন ধরে বুঙ্গাড়ির সঙ্গে জড়িত। এ ছাড়া রাজু, রহিমসহ আরো কয়েকজন আছেন।’
ডিআই ট্রাকে ঢাকা থেকে সিলেট আসেন নানক
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সিলেট আওয়ামী লীগের গুরুত্বপূর্ণ একজন নেতা জানান, সরকার পতনের পরদিন ৬ আগস্ট আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানক ঢাকা থেকে একটি ডিআই ট্রাকে শেরপুর আসেন। পরে সিলেট থেকে একটি গাড়ি সেখানে গিয়ে তাঁকে তামাবিল সীমান্তে পৌঁছে দেয়। এরপর তিনি ওই সীমান্ত দিয়ে ভারতে প্রবেশ করেন।
দুর্ব্যবহারই কাল হয় সাবেক বিচারপতি মানিকের
দনা সীমান্ত দিয়ে ভারতে পালাতে চেয়েছিলেন সুপ্রিম কোর্টের সাবেক বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক। এর জন্য ১৫ হাজার টাকা রফা হয়। কিন্তু শুরু থেকে তিনি দালালদের সঙ্গে অনবরত দুর্ব্যবহার, ধমক ও তুচ্ছতাচ্ছিল্য করায় দালালরা টাকা নিয়ে তাঁকে মারধর করে সীমান্তে ফেলে যায়।
পান্না ও আমিনুল একসঙ্গে ভারতে প্রবেশ করেন
২৪ আগস্ট দনা সীমান্ত দিয়ে একসঙ্গে ভারতে প্রবেশ করেন ছাত্রলীগের সাবেক কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক ইসহাক আলী খান পান্না এবং আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় ত্রাণ ও সমাজকল্যাণ বিষয়ক সম্পাদক মোহাম্মদ আমিনুল ইসলাম। ভারতের জৈন্তিয়া পাহাড় এলাকায় পান্না মারা গেলেও আমিনুল শিলং হয়ে কলকাতা পৌঁছে যান।
প্রথম পর্যায়ে সীমান্ত দিয়ে দেশ ছাড়েন যাঁরা
নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে, ৫ আগস্ট সকাল থেকেই সিলেট আওয়ামী লীগের অনেক নেতা বাসা ছেড়ে নিরাপদ স্থানে চলে যান। সিলেট সিটি করপোরেশনের পাঁচবারের নির্বাচিত কাউন্সিলর ও মহানগর আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আজাদুর রহমান আজাদ ওই দিন দুপুর আড়াইটার পর ভাড়া গাড়িতে সীমান্তে রওনা দেন। পরে সুলেমান নামের স্থানীয় এক নেতার সহযোগিতায় তিনি ভারতে চলে যান।
সূত্রটি জানায়, সুনামগঞ্জ-১ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য রণজিত সরকার এবং সিলেট মহানগর আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক বিধান কুমার ৬ আগস্ট তামাবিল দিয়ে ভারতে চলে যান। কাছাকাছি সময়ে সীমান্ত পাড়ি দেন সিলেট-৩ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য হাবিবুর রহমান হাবিব এবং সিলেট জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট নাসির উদ্দিন খান।
সূত্র আরো জানায়, আওয়ামী লীগ নেতাদের ভারত পাড়ি দিতে সীমান্তে বুঙ্গাড়ি সিন্ডিকেটকে মোটা অঙ্কের অর্থ দিতে হলেও রণজিত, আজাদ ও বিধানের কাছ থেকে তারা টাকা নেয়নি।
ছাত্রলীগসহ অঙ্গসংগঠনের বেশির ভাগ নেতা পাড়ি জমিয়েছেন দনা সীমান্ত দিয়ে
সিলেট জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সহসভাপতি এমদাদ আহমদ, ছাত্রলীগের জেলা সভাপতি নাজমুল ইসলাম, সাধারণ সম্পাদক রাহেল সিরাজ, মহানগর সাধারণ সম্পাদক নাইম ইসলামসহ কয়েকজন নেতা দনা সীমান্ত দিয়ে শিলং চলে গেছেন। পরে সিসিকের ৩২ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর রুহেল আহমদ ও ৩৫ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর জাহাঙ্গীর আলম একই পথে শিলং চলে যান। ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি সাদ্দাম হোসেন ও সাধারণ সম্পাদক শেখ ওয়ালী আসিফ ইনানও দনা সীমান্ত দিয়ে ভারতে চলে যান। যদিও এই তথ্য নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
কলকাতায় আওয়ামী লীগের একাধিক শীর্ষ নেতা
নির্ভরযোগ্য সূত্র জানায়, আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম, ময়মনসিংহের দায়িত্বপ্রাপ্ত কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক শফিউল আলম চৌধুরী নাদেল, কেন্দ্রীয় ত্রাণ ও সমাজকল্যাণ বিষয়ক সম্পাদক মোহাম্মদ আমিনুল ইসলাম বর্তমানে কলকাতায় অবস্থান করছেন। তবে বাহাউদ্দিন নাছিম রৌমারি সীমান্ত দিয়ে পাড়ি জমিয়েছেন বলে যানা গেছে। আর নাদেল কোন রুট দিয়ে পাড়ি জমিয়েছেন তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
শীর্ষ নেতাদের মধ্যে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানক ভারতের শিলংয়ে সিলেট ছাত্রলীগের নেতাদের আতিথ্যে রয়েছেন বলে বিশ্বস্ত সূত্রে জানা গেছে।
দনা সীমান্ত দিয়ে দেশ ছাড়ার হিড়িক প্রসঙ্গে কানাইঘাট থানার ওসি জাহাঙ্গীর হোসেন সরদার বলেন, ‘আমরা এ বিষয়ে খোঁজখবর রাখছি। এমন তথ্য পাওয়া গেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’