ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানের পর পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে অনেকটা একঘরে দেশের অন্যতম রাজনৈতিক দল জাতীয় পার্টি (জাপা)। আওয়ামী লীগের পৃষ্ঠপোষকতায় গত তিনটি সংসদ নির্বাচনে অংশ নেওয়ায় দলটি তুমুল সমালোচনার মুখে পড়ে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সঙ্গে সংলাপে এখনো আমন্ত্রণ পায়নি দলটি। বর্তমানে রাজনৈতিক মিত্র হিসেবে আর কেউ অবশিষ্ট না থাকায় ‘একলা চলা’র কৌশল নিয়েছে দলটি।
এই পরিস্থিতিতে দলের করণীয় ঠিক করতে গতকাল সোমবার দলটির কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে সারা দেশে দলের অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনগুলোকে শক্তিশালী করার উদ্যোগ গ্রহণের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন শীর্ষ নেতারা।
জাপার কয়েকজন শীর্ষ নেতাসহ বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের বিরুদ্ধে এরই মধ্যে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে গণহত্যায় জড়িত থাকার অভিযোগে মামলা করা হয়েছে। এই অভিযোগ অস্বীকার করে এসব মামলা প্রত্যাহারের দাবিতে রাজধানীসহ সারা দেশে কর্মসূচি ঘোষণা করেছে দলটি।
গতকাল সোমবারের বৈঠকে জাপা চেয়ারম্যান জি এম কাদের দলের নেতাদের উদ্দেশে বলেন, ‘একটি চক্র জাতীয় পার্টিকে ছাত্র আন্দোলনের বিপক্ষের দল হিসেবে চিহ্নিত করতে অপচেষ্টা চালাচ্ছে। অথচ আন্দোলনে আমরা সমর্থন দিয়েছি, আমাদের নেতাকর্মীরা আন্দোলনে অংশ নিয়ে হামলা-মামলার শিকার হয়ে জেল খেটেছেন। ওই আন্দোলনে হত্যা মামলায় জাতীয় পার্টির নেতাকর্মীদের আসামি করা হচ্ছে।’
জাপা মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু বলেন, ‘আমরা আওয়ামী লীগের প্রতিটি কর্মকাণ্ডের বিরোধিতা করেছি।
আমাদের চেয়ারম্যান জি এম কাদের প্রকাশ্যে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে সমর্থন দিয়েছেন। এখন আমাদের বিরুদ্ধে গণহত্যার অভিযোগ আনা হচ্ছে, এই অভিযোগ ভিত্তিহীন। আমাদের নেতাকর্মীদের সারা দেশে মিথ্যা মামলা প্রত্যাহারের দাবিতে কর্মসূচি পালনের নির্দেশ দিয়েছি।’
প্রতিষ্ঠার পর থেকেই জাতীয় পার্টি ক্ষমতাসীন বা ক্ষমতার নিকটবর্তী দল হিসেবে পরিচিত। দলটি ক্ষমতাসীন বড় দলের সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখে বলে নানা সময় আলোচিত হয়েছে।
ক্ষমতা হারানোর পর ১৯৯১ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ৩৫টি আসন নিয়ে জাতীয় পার্টি তৃতীয় শক্তি হিসেবে দেশের রাজনীতিতে অবস্থান নেয়। তবে ভোটারবিহীন ও একতরফা হিসেবে আখ্যা পাওয়া দশম, একাদশ ও দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নেওয়ায় দলটি অন্যান্য রাজনৈতিক দলের কাছে ‘আওয়ামী স্বৈরতন্ত্রের সহযোগী’ হিসেবে অভিহিত হয়।
৫ আগস্টের পর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে গণহত্যায় মদদ দেওয়ার অভিযোগে সম্প্রতি জাতীয় পার্টির রাজনীতি নিষিদ্ধের দাবি জানিয়েছে বিএনপি, গণ অধিকার পরিষদসহ কয়েকটি রাজনৈতিক দল। দলগুলোর অভিযোগ বিষয়ে মুজিবুল হক চুন্নু বলেন, ‘জাতীয় পার্টি নির্বাচনমুখী দল। ২০২৪ সালের নির্বাচন যখন সব দল বর্জন করে তখন জাতীয় পার্টিও নির্বাচন বর্জনের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। এ জন্য আওয়ামী লীগ গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকে দিয়ে আমাদের অবরুদ্ধ করে রাখে। সারা দেশের জনগণ এটি জানে।’
মুজিবুল হক বলেন, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপিও সংসদে ছিল। বিএনপি ও অন্যান্য দলের মতো জাতীয় পার্টিও সংসদে ও রাজপথে আওয়ামী লীগের সব কর্তৃত্ববাদী কর্মকাণ্ডের বিরোধিতা করেছে।
উল্লেখ্য, ১৯৯৬ সালে অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জাতীয় পার্টি ৩২টি আসন লাভ করে। ওই নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন লাভ করে আওয়ামী লীগ। সরকার গঠনে আওয়ামী লীগকে সমর্থন দেয় জাতীয় পার্টি। ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জাতীয় পার্টি (এরশাদ) আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোটে যোগ দেয়। এই নির্বাচনে জাতীয় পার্টির ৪৯ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। জাতীয় সংসদে তাঁরা ২৭টি আসন পান এবং মোট ভোটের ৭.০৪ শতাংশ ভোট লাভ করেন।
২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের পৃষ্ঠপোষকতায় পাতানো নির্বাচনের মাধ্যমে মাত্র ৩৪টি আসন নিয়ে বিরোধী দল হয়ে যায় জাতীয় পার্টি। একাদশ নির্বাচনে ২৫টি আসনে জয়লাভ করলেও সংসদে আওয়ামী লীগের ‘গৃহপালিত বিরোধী দল’ হিসেবে অভিহিত হয় দলটি। সর্বশেষ ২০২৪ সালে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সঙ্গে ২৬টি আসনে সমঝোতা করলেও জয় পায় মাত্র ১১টিতে।
দলের অবস্থা নাজুক : দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর চলতি বছরের ৯ মার্চ জি এম কাদের এবং দলটির প্রতিষ্ঠাতা সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের সহধর্মিণী রওশন এরশাদের নেতৃত্বে দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে যায় জাতীয় পার্টি। এ ছাড়া ওই নির্বাচন ঘিরে দ্বন্দ্বের জেরে দলটি ছেড়ে যান অন্তত ৬৬৮ জন নেতাকর্মী। ফলে বিরূপ প্রভাব পড়ে দলের সাংগঠনিক শক্তিতে।
বিষয়টি নিয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দলটির এক নেতা বলেন, সর্বশেষ ভাঙন এবং দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে ভরাডুবির পর দলের অবস্থা কিছুটা খারাপ। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে গণহত্যার অভিযোগ শীর্ষ নেতাদের নামে মামলা হলে হাতে গোনা কয়েকটি জেলা বাদে বেশির ভাগ জেলায়ই কোনো কর্মসূচি পালন করা যায়নি।
সাংগঠনিক শক্তি বৃদ্ধিই দলটির বর্তমান লক্ষ্য বলে জানিয়েছেন মুজিবুল হক চুন্নু।‘আমরা এখন সাংগঠনিকভাবে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ করার পেছনে জোর দিচ্ছি। দেশের জনগণ জাতীয় পার্টির সঙ্গে ছিল। আমাদের সমর্থকরা বিগত সব নির্বাচনে আমাদের পাশে থেকেছে। কেন্দ্রে ও জেলায় জেলায় কমিটি পুনর্গঠন করা হবে। নতুন প্রজন্মকে সামনে রেখে আমরা আমাদের রাজনৈতিক করণীয় ঠিক করব।’