নেতৃত্বশূন্য দক্ষিণ জেলা বিএনপির কমিটিতে আসছেন যাঁরা

চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা বিএনপির আহবায়ক কমিটি বিলুপ্তির পর দলের তৃণমূলে নতুন নেতৃত্ব নিয়ে ব্যাপক আলোচনা এবং নানা গুঞ্জন চলছে। দলের নীতিনির্ধারকদের ওপর আস্থা রেখে কারা আসবেন নতুন নেতৃত্বে এবং তারা কীভাবে দলের ভেতরের পরিস্থিতি সামাল দেবেন এসব প্রশ্ন এখন কর্মী এবং সমর্থকদের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে।

দক্ষিণ জেলা বিএনপির সাংগঠনিক কমিটি বিলুপ্ত করার সিদ্ধান্তের পর থেকেই তৃণমূলের নেতাকর্মীদের মধ্যে উত্তেজনা তৈরি হয়েছে। একজন আরেকজনের বিরুদ্ধে নানা মিথ্যা অভিযোগ এনে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ ঘায়েল করার অপচেষ্টা চালাচ্ছে।সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে নতুন কমিটি ঘোষণা হতে পারে যেকোনো দিন। তাই নেতা হওয়ার দৌড়ে প্রার্থীরা ঢাকার কেন্দ্রীয় নেতাদের কাছে ছুটছেন এবং তাদের সমর্থন লাভের চেষ্টা করছেন। বর্তমানে সভাপতির পদ এবং সাধারণ সম্পাদক বা সদস্য সচিবের পদে সম্ভাব্য প্রার্থীদের নাম নিয়ে দলীয় মহলে নানা আলোচনা চলছে।

চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা বিএনপির সভাপতির পদে আলোচনায় আছেন যারা তারা হলেন- জেলা বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক গাজী মোহাম্মদ শাহজাহান জুয়েল, সাবেক সাধারণ সম্পাদক সরওয়ার জামাল নিজাম, সাবেক সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক শেখ মো. মহিউদ্দিন, সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক আলহাজ্ব আলী আব্বাস, সাবেক সহসভাপতি অ্যাডভোকেট ইফতেখার হোসেন চৌধুরী মহসিন।

সাধারণ সম্পাদক বা সদস্য সচিব পদে যাদের নাম শোনা যাচ্ছে তারা হলেন- সাবেক সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক এনামুল হক এনাম, সাবেক যুগ্ম আহবায়ক লেয়াকত আলী, সাবেক যুগ্ম সম্পাদক কামরুল ইসলাম হোছাইনী, সাবেক যুগ্ম সম্পাদক আসহাব উদ্দিন চৌধুরী, বিলুপ্ত কমিটির সদস্য মজিবুর রহমান, খোরশেদ আলম, লায়ন মো. হেলাল উদ্দিন।

দলটির তৃণমূল নেতাকর্মীরা চান, আগামীর নতুন নেতৃত্বে এমন রাজনৈতিক ব্যক্তি আসুক যিনি সত্যিকারের সাচ্চা শহীদ জিয়ার আদর্শের কর্মী। যারা বিগত ১৭ বছরে দলের আন্দোলন-সংগ্রামে সক্রিয় ছিলেন। যারা সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়েছেন এবং ত্যাগ স্বীকার করেছেন, তাদেরই নেতৃত্বে আসা উচিৎ।তারা আরো মনে করছেন, বিতর্কিত বা হাইব্রিড নেতাদের দিয়ে কমিটি গঠন করলে তা তৃণমূলে গ্রহণযোগ্যতা পাবে না এবং দলের মূল লক্ষ্য উদ্দেশ্য পূরণ হবে না।

চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা বিএনপির সর্বশেষ সম্মেলন হয় ২০০৯ সালে। সে কমিটিতে জাফরুল ইসলাম চৌধুরীকে সভাপতি এবং শেখ মো. মহিউদ্দিনকে সাধারণ সম্পাদক করা হয়েছিল। এরপর ২০১১ সালে পুনর্গঠন করা হয় এবং জাফরুল ইসলাম চৌধুরীকে সভাপতি এবং গাজী শাহজাহান জুয়েলকে সাধারণ সম্পাদক করা হয়। এই কমিটি দীর্ঘ আট বছর পাঁচ মাস দায়িত্ব পালন করার পর ২০১৯ সালের অক্টোবরে বিলুপ্ত করেন কেন্দ্রীয় কমিটি।

এরপর, ২০২৩ সালের ৭ মে বিলুপ্ত কমিটির ৪নং সদস্য এনামুল হক এনামকে ১ম যুগ্ম আহ্বায়ক করা হয়। তিনি এস আলম গ্রুপের বিলাসবহুল গাড়ি সরানোর কেলেঙ্কারিতে পড়ে এনাম তার প্রাথমিক সদস্য পদ হারান। সেই সঙ্গে দক্ষিণ জেলা কমিটিও বিলুপ্ত ঘোষণা করেন কেন্দ্রীয় কমিটি।

এদিকে, চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা বিএনপির নেতৃত্বের প্রশ্নে যে উত্তেজনা এবং বিতর্ক তৈরি হয়েছে তা দলের ভবিষ্যৎ কৌশল নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। দলের তৃণমূল নেতাকর্মীরা যেসব দাবি করছেন, তা নতুন নেতৃত্ব নির্বাচনে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে।
তৃণমূল কর্মীদের মতে, আন্দোলন-সংগ্রামে সক্রিয় নেতাদেরকে নেতৃত্বে আনলে দলের ঐক্য এবং শক্তি বজায় থাকবে। বিতর্কিত এবং স্বার্থপর নেতাদের নেতৃত্বে আনা হলে দলের অভ্যন্তরীণ বিভক্তি এবং হতাশা আরো বৃদ্ধি পাবে। পাশাপাশি বর্তমানে চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা বিএনপির নতুন নেতৃত্ব কেমন হবে, তা নিয়ে তৃণমূল কর্মীদের মধ্যে ব্যাপক কৌতূহল ও উত্তেজনা বিরাজ করছে। দলের হাইকমান্ড কাদের ওপর আস্থা রাখবে এবং নতুন নেতৃত্ব কীভাবে দলের সংকট মোকাবেলা করবে, তা আগামী দিনের রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলবে। তৃণমূলের প্রত্যাশা, নতুন নেতৃত্ব দলের জন্য সঠিক পথ নির্দেশ করবে এবং দক্ষিণ চট্টগ্রামের রাজনীতিতে বিএনপিকে আরো শক্তিশালী করবে।

অপরদিকে, টানা ৬ বছর ধরে আহ্বায়ক কমিটিতেই বন্দি ছিল চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা বিএনপির রাজনীতি। বিপরীতে জেলার মতো ৮টি উপজেলা ও পৌরসভারও চলছে আহ্বায়ক কমিটি নির্ভর বিএনপির রাজনীতি। এতে দলটির চেইন অব কমান্ড ভেঙে পড়ে সাংগঠনিক কার্যক্রমে হ য ব র ল অবস্থা বিরাজ করছিল।

দক্ষিণ জেলা বিএনপির তিন মাসের আহ্বায়ক কমিটি টানা ৬ বছর পার করলেও সম্মেলনের প্রস্তুতির কোনো তোড়জোড় ছিল না। বরং যাকে কোন্দল নিরসনের জন্য দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে তাকে ঘিরে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছিল জেলা বিএনপির অভ্যন্তরীণ কোন্দল।

জানা যায়, ২০১৯ সালের ২ অক্টোবর দক্ষিণ জেলা বিএনপির আহ্বায়ক কমিটি গঠন করা হয়। কোন্দল এড়াতে ৬৫ সদস্যের এ কমিটির আহ্বায়কের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল নগর বিএনপি নেতা আবু সুফিয়ানকে। আহ্বায়ক কমিটি করার প্রায় দুই বছর পর ৯টি উপজেলা ও পৌরসভা কমিটি গঠন করা হয়।

অনৈতিক সুবিধা নিয়ে কমিটি গঠন করার অভিযোগ তুলে পাল্টা কমিটি ঘোষণা করেন সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক কর্ণফুলির আলী আব্বাস, সদস্য সাতকানিয়ার অধ্যাপক শেখ মহিউদ্দিন ও বাঁশখালীর লিয়াকত আলী। সে সময় দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে জেলার এ তিন নেতাকে ২০২১ সালের ১০ জানুয়ারি দল থেকে বহিষ্কার করা হয়। এরপর ২০২৩ সালের ৭ মে আহ্বায়ক কমিটির চার নম্বর সদস্য পটিয়ার এনামুল হক এনামকে এক নম্বর যুগ্ম আহ্বায়ক করে কেন্দ্রীয় বিএনপি।

এদিকে, সাড়ে চার বছর পার হলেও উত্তর সাতকানিয়া সাংগঠনিক ইউনিটের কমিটি দিতে পারেনি জেলা বিএনপি। এই ইউনিটে সিনিয়র নেতা বেশি থাকার অজুহাতে কমিটি গঠনে সময়ক্ষেপণ করা হচ্ছে বলে জানা গেছে। ২০২০ সালের ডিসেম্বরে দক্ষিণ জেলা বিএনপির অধীনে ‘উত্তর সাতকানিয়ার নামে সাতকানিয়া উপজেলার খাগরিয়া, কালিয়াইশ, কেওচিয়া, ধর্মপুর, বাজালিয়া ও পুরানগড় ইউনিয়ন নিয়ে নতুন ইউনিটের অনুমোদন দেয় কেন্দ্রীয় বিএনপি।

অভিযোগ রয়েছে, উত্তর সাতকানিয়া সাংগঠনিক উপজেলা বিএনপির কমিটি নিয়ে আর্থিক লেনদেন চলছে। এই ইউনিটে পদ প্রত্যাশী কয়েকজন নেতার কাছ থেকে আর্থিক সুবিধা নিচ্ছেন জেলা বিএনপির সিনিয়র এক নেতা। তবে যেসব আহ্বায়ক কমিটি করা হয়েছে তার মধ্যে পটিয়া ও লোহাগাড়া উপজেলা ছাড়া আর কোনো উপজেলা বা পৌরসভা তাদের আওতাধীন ইউনিয়ন বা ওয়ার্ড কমিটি গঠন করতে পারেনি।

জেলার তৃণমূল নেতাকর্মীদের অভিযোগ, নগর বিএনপির নেতা আবু সুফিয়ানকে জেলা বিএনপির কোন্দল নিরসনের জন্য দায়িত্ব দিলেও তিনি দলকে আরো কোন্দলের দিকে ঠেলে দিয়েছেন। তার পছন্দে যেসব উপজেলা-পৌরসভায় কমিটি গঠন করা হয়েছে তারাও রাজনীতি থেকে অনেকটা নিষ্ক্রিয়। এর মধ্যে অন্যতম সাতকানিয়া উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক জামাল হোসেন। গত বছরের ২৮ অক্টোবর থেকে রাজনীতিতে নিষ্ক্রিয় তিনি। পাশাপাশি আবু সুফিয়ান তার নির্বাচনী এলাকা বোয়ালখালীতে প্রতিপক্ষ নিজ দলের এরশাদ উল্লাহর অনুসারী নেতাদের উপজেলা ও পৌরসভা বিএনপির কমিটিতে জায়গা দেননি। এতে কোন্দল মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছিল।