ডিসেম্বরের মধ্যে আওয়ামী লীগের সর্বস্তরে নতুন কমিটি আসতে পারে

কোটা সংস্কার আন্দোলন আওয়ামী লীগকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দিয়েছে। দলের ভেতরে ‘কৌশলগত ব্যর্থতার’ সমালোচনা চলছে। এমন অবস্থায় ক্ষমতাসীন দলটির সর্বস্তরের সংগঠনের নেতৃত্ব বদলাতে পারে এমন গুঞ্জন বেশ জোরেশোরেই শোনা যাচ্ছে। খুব শিগগির এই প্রক্রিয়া শুরু করা হবে। আগস্টের পর শুরু করে ডিসেম্বরের মধ্যে দল পুনর্গঠন করা হবে আলোচনা আছে বলে বিভিন্ন সূত্র জানিয়েছে।

কোটা সংস্কারের দাবিতে গড়ে ওঠা আন্দোলন ও উদ্ভূত পরিস্থিতি সামলানোর ক্ষেত্রে দলের ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে বলে মনে করছেন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরাই। ফলে নেতাকর্মীদের মধ্যে আগাম সম্মেলনের বিষয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে।

সূত্রগুলো জানায়, আগাম সম্মেলন হওয়ার সম্ভাবনাও বেশ প্রবল হয়ে উঠেছে। কোটা সংস্কারবিরোধী আন্দোলন আওয়ামী লীগকে সংস্কারের প্রয়োজন শিখিয়ে দিয়ে গেছে কী করা উচিত, কী করতে হবে সেই পথ দেখিয়ে দিয়েছে। এই আন্দোলনের মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক দুর্বলতা ও দলের অনৈক্যের আসল চিত্র প্রকাশ পেয়েছে।

সূত্রমতে, দলের এই দুর্বলতা কাটাতে নেতৃত্ব বদলানোর ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ইতিমধ্যে দলের সভাপতি শেখ হাসিনা কোথায় ব্যর্থতা, কোথায় দুর্বলতা ছিল, সে ব্যাপারে খোঁজখবর নিতে শুরু করেছেন। এ ছাড়া, মাঠপর্যায়ের কর্মীরাও নেতৃত্ব বদলানোর জোরালো আওয়াজ তুলেছেন।

আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ে কথা বলে জানা গেছে, আন্দোলন ঘিরে মাঠপর্যায়ের কর্মীদের পক্ষ থেকেও নেতৃত্ব বদলের জোরালো দাবি উঠেছে। মাঠপর্যায়ের কর্মীরা মনে করেন, ক্ষমতার বাকি সাড়ে চার বছর পার করতে হলে যেকোনো মূল্যে দলের সাংগঠনিক দুর্বলতা দূর করতে হবে। তারা আরও বলেন, বৈরী পরিস্থিতি মাত্র শুরু হলো, সামনের দিনগুলোয় আরও জটিল পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হবে সরকারকে। ফলে নড়বড়ে সংগঠন থাকলে বিপদ মোকাবিলা করা কষ্টসাধ্য হয়ে উঠবে সরকারের জন্য।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠ একাধিক সূত্র দেশ রূপান্তরকে বলেন, প্রথম ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগকে পুনর্গঠন করতে চান দলীয় সভাপতি শেখ হাসিনা। যেকোনো পরিস্থিতি সামাল দিতে হলে ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগকে শক্তিশালী সংগঠনে পরিণত করতে হবে। সে ক্ষেত্রে প্রথমেই দক্ষ-যোগ্য নেতৃত্বের হাতে ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগ তুলে দিতে চান প্রধানমন্ত্রী। ঘনিষ্ঠ ওই সূত্রগুলো জানায়, ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের দুর্বলতা দলীয় সভাপতিকে বেশ অবাক করেছে। কোটা আন্দোলন পরিস্থিতি সামাল দিতে মহানগর আওয়ামী লীগ ও মহানগর এলাকার সংসদ সদস্যদের (এমপি) ভূমিকা আওয়ামী লীগ সভাপতিকে হতাশ করেছে বলেও তথ্য পাওয়া গেছে।

গত কয়েক দিনের কর্মকাণ্ড নিয়ে ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণের থানা পর্যায়ের অন্তত ২০ নেতার সঙ্গে কথা হয় দেশ রূপান্তরের। তারা সংগঠনের ব্যর্থতা নিয়ে নানা মন্তব্য করেন। তবে প্রকাশ্যে এ নিয়ে কথা বলতে চান না।

এক নেতা বলেন, মূল ব্যর্থতা হলো ১৫ বছরে থানা ও ওয়ার্ড পর্যায়ের পূর্ণাঙ্গ আওয়ামী লীগের কোনো কমিটি নেই। একই সঙ্গে আওয়ামী লীগের অন্যতম ভ্যানগার্ড হিসেবে পরিচিত যুবলীগের ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ শাখা দীর্ঘদিন ধরে চলছে ভারপ্রাপ্তদের দিয়ে। একই সঙ্গে ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকা অনেক নেতার থেকে নিজেদের লোকেরা সুযোগ-সুবিধা নিয়ে আর্থিকভাবে লাভবান হয়েছেন। কিন্তু গত কয়েক দিনের বিশেষ পরিস্থিতিতে সুবিধাবাদীরা মাঠে ছিল না। সাবেক ছাত্রনেতাদের অনেকেই মাঠে থেকে সাংগঠনিক তৎপরতা চালিয়েছেন।

থানা পর্যায়ের নেতাদের অভিযোগ, আন্দোলন মোকাবিলায় নেতাকর্মীদের একটি অংশ মাঠে থাকলেও প্রয়োজনের সময় বেশির ভাগ স্থানীয় এমপি, মেয়র, কাউন্সিলরদের সহযোগিতা পাওয়া যায়নি। মাঠে থাকা নেতাকর্মীরা আর্থিক সংকটে থাকলেও তেমন সাহায্য করা হয়নি।

ঢাকা মহানগর দক্ষিণের একটি থানা শাখা আওয়ামী লীগের এক নেতা বলেন, আন্দোলনে নেতাকর্মীদের খোঁজ নেননি এমপিরা। নেতাকর্মীদের চাঙা রাখতে কোনো ধরনের সহযোগিতা করেননি। বৃহস্পতি ও শুক্রবারের সহিংসতা নেতাকর্মীদের আয়ত্তের বাইরে চলে যায়। কিন্তু এর আগে হাতে গোনা কয়েকজন এমপি ছাড়া কাউকে মাঠে দেখা যায়নি।

ঢাকা জেলায় সংসদীয় আসন ২০টি। এর মধ্যে সিটি করপোরেশন এলাকায় ১৬টি। এর মধ্যে তিনজন আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র এমপি। বাকি ১৩টি আসনে নৌকা প্রতীকের এমপি। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের সাধারণ ওয়ার্ড ৫৪টি। দক্ষিণে ওয়ার্ড ৭৪টি। দুই সিটির ওয়ার্ড কাউন্সিলরদের প্রায় সবাই আওয়ামী লীগের। ছাত্র আন্দোলন শুরুতে হাতে গোনা কয়েকজন কাউন্সিলরকে মাঠে দেখা গেছে।

বৃহস্পতি ও শুক্রবার রাজধানীতে ব্যাপক সহিংসতায় জনপ্রতিনিধি ও তাদের সমর্থক নেতাকর্মীদের মাঠে খুব বেশি দেখা যায়নি। আবার উত্তরা, যাত্রাবাড়ী, ডেমরা, বাড্ডা, রামপুরা এলাকায় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা মাঠে নামার চেষ্টা করলেও সহিংসতাকারীদের তোপের মুখে পিছু হটেন।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে টাঙ্গাইল জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ফজলুর রহমান ফারুক দেশ রূপান্তরকে বলেন, এবার যেভাবে সাংগঠনিক দুর্বলতা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে, পঁচাত্তর সালেও তা হয়নি। তিনি বলেন, ‘জনগণের ভাষা বোঝেন, এমন নেতার সংখ্যা আওয়ামী লীগে কমে যাচ্ছে। এটা আওয়ামী লীগের জন্য অশনিসংকেত।’

নোয়াখালী জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এএইচএম খায়রুল আনাম চৌধুরী সেলিম দেশ রূপান্তরকে বলেন, সাম্প্রতিক আন্দোলনে সাংগঠনিক দুর্বলতার কথা সবার মুখে মুখে। আওয়ামী লীগের এ অবস্থা কেন হলো, এ বিষয়টি সবাইকে ভাবতে হবে। সময় এসেছে নতুন করে ভাবার। সর্বস্তরে সংগঠনের এই দশা বলেও মন্তব্য করেন প্রবীণ এ নেতা।

চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, পাবনা, রাজশাহী, লক্ষ্মীপুর, ভোলাসহ বেশ কয়েকটি জেলার শীর্ষস্থানীয় নেতারাও প্রায় একই ধরনের মন্তব্য করেছেন।

তবে তৃণমূল ও মাঠপর্যায়ের কর্মীরা যেভাবে আওয়ামী লীগের ব্যর্থতার আওয়াজ তুলছেন, দলের কেন্দ্রীয় নেতারা সেভাবে ব্যর্থতার কথা মানতে নারাজ। তারা বলেন, ক্ষমতায় থাকলে সব রাজনৈতিক দলেই একটু এদিক-সেদিক হয়। আওয়ামী লীগও এর বাইরে নয়।

এ প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য আবদুর রাজ্জাক বলেন, ‘দলের সাংগঠনিক ব্যর্থতা তেমন কিছু নেই। ছাত্রদের আন্দোলনকে কেন্দ্র করে অনেক রাজনৈতিক দল, বিশেষ করে স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি জামায়াত-বিএনপি সম্পৃক্ত হয়ে ধ্বংসলীলা করেছে। অনেক তাণ্ডব করেছে। রাষ্ট্রীয় সম্পদ ও প্রতিষ্ঠান ধ্বংস করেছে।’

তিনি বলেন, ‘এখান থেকে আমাদের শিক্ষা নিতে হবে। ভবিষ্যতে আমরা কীভাবে রাজনৈতিকভাবে মোকাবিলা করতে পারি, সেগুলো নিয়ে আমরা আলোচনা করছি। নিজেদের আরও সুসংগঠিত করা, সমন্বয় আরও বৃদ্ধির জন্য কাজ শুরু করেছি।’

দলের আরেক সভাপতিম-লীর সদস্য কাজি জাফর উল্লাহ দেশ রূপান্তরকে বলেন, এখান থেকে শিক্ষা নিতে হবে, ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিতে হবে। ব্যর্থতা-সফলতার কথা নয়, সংগঠন নিয়ে ভাবতে হবে। কিছু দুর্বলতা উঠে এসেছে, সেগুলোর মীমাংসা করতে হবে।

কোটা আন্দোলনকে ঘিরে দেশের বিভিন্ন জায়গায় সংঘর্ষ-সহিংসতায় প্রাণ হারিয়েছেন অনেকে। আন্দোলন মোকাবিলায় আওয়ামী লীগ থেকে মাঠে নামতে নির্দেশনা দিলেও দৃশ্যত তা মানেননি নেতাকর্মীরা। পরে যৌথবাহিনীর উপস্থিতিতে পরিবেশ স্বাভাবিক হলে তাদের প্রকাশ্যে দেখা যাচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে সাংগঠনিক ব্যর্থতা নিয়ে আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরে চলছে নানা আলোচনা-সমালোচনা।

কয়েক দিনের কর্মকাণ্ড নিয়ে আওয়ামী লীগ নিজেদের মধ্যে মূল্যায়ন শুরু করেছে। মঙ্গলবার যা নিয়ে যৌথসভা হয়। সেখানে কেন্দ্রীয়, সহযোগী ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনের নেতাদের মধ্যে ব্রিফ করেন সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক সম্পাদকমণ্ডলীর নেতা জানান, ওবায়দুল কাদের তাদের বলেছেন, সহিংসতা মোকাবিলায় নেতাকর্মীদের মাঠে রাখতে না পারাটাই দলীয় সাংগঠনিক ব্যর্থতা। কোটা আন্দোলনে ছাত্রলীগের সাংগঠনিক ব্যর্থতাও সামনে এসেছে বলে কাদের জানান।

গতকাল বুধবার ঢাকা-৪, ৫ ও ১৮ সংসদীয় আসনের এমপি, থানা-ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের নেতা এবং কাউন্সিলরদের নিয়ে তেজগাঁওয়ে মতবিনিময় সভা করেন কেন্দ্রীয় নেতারা। সেখানে থানার নেতারা পরস্পরের বিরুদ্ধে অসহযোগিতার অভিযোগ উত্থাপন করেন। আবার একাধিক নেতা নিজেকে জাহির করেন। ঢাকা মহানগর উত্তর স্বেচ্ছাসেবক লীগের এক নেতা নিজে মাঠে ছিলেন এবং তার কর্মকাণ্ড নিয়ে ২০ মিনিটের মতো কথা বলেন। তিনি উত্তরা এলাকার একটি ওয়ার্ড কাউন্সিলর হলেও আন্দোলনের সময় ধানম-ির ২৭ নম্বর পুরনো সড়কে ছিলেন বলে বক্তব্যে উল্লেখ করেন। এ সময় আওয়ামী লীগের এক কেন্দ্রীয় নেতা তাকে থামিয়ে দেন। নেতারা পরস্পরকে দোষারোপ করা শুরু করলে দলটির এক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক তাদের থামিয়ে দিয়ে বলেন, এখন পরস্পরের বিরুদ্ধে কাদা ছোড়াছুড়ি করে, দলাদলি করে কোনো লাভ হবে না। ভবিষ্যতে দলকে ঐক্যবদ্ধ করে সব ধরনের পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হবে।

আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য শাজাহান খান বলেন, ‘আমাদের সাংগঠনিক ভিত যথেষ্ট শক্ত আছে। এটাকে সংগঠিত করার ক্ষেত্রে আমাদের কিছু দুর্বলতা আছেই। সেই দুর্বলতাকে মেরামত করতে হবে। দুর্বলতা দূর করে সবাইকে সংগঠিত করতে হবে।’-দেশ রূপান্তর