এখনো নির্বাচনি মাঠে আ.লীগের এমপি-মন্ত্রীর স্বজন

আসন্ন উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে প্রার্থী হতে পারবেন না আওয়ামী লীগের এমপি-মন্ত্রীর আত্মীয়স্বজন ও ছেলে-মেয়েরা। দল থেকে এমন নির্দেশনা দিলেও তা তোয়াক্কা করছে না নির্বাচনে প্রার্থী হওয়া এমপি-মন্ত্রীর আত্মীয়-স্বজনরা।

উপজেলা নির্বাচনে প্রার্থী হয়ে এখনো মাঠে সরব আছে এমন দুই ডজন প্রার্থীর সঙ্গে কথা বলেছে । এমপি-মন্ত্রীর স্বজন হয়ে উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে প্রার্থী হওয়া ব্যক্তিরা নানা অজুহাত দেখিয়ে প্রার্থিতা প্রত্যাহার না করার সিদ্ধান্তে এখনও অটল।

এমপি-মন্ত্রীর স্বজন— এমন সম্ভাব্য প্রার্থীদের ভাষ্যমতে, দীর্ঘদিন ধরে রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত, কিন্তু এমপি, মন্ত্রীর স্বজন হওয়ায় নির্বাচন করা যাবে না- এই সিদ্ধান্ত মানার মতো না। আবার কেউ বলছেন এমপির স্বজন হলেও তার পরিচয় দিয়ে নির্বাচন করছেন না। বরং এমপিই তাদের পরিচয় দিয়ে এমপি নির্বাচিত হয়েছেন। এমপি-মন্ত্রীর স্বজন হলে নির্বাচন করতে পারবে না— দলের এমন সিদ্ধান্তের পর কেউ কেউ আবার পরিবার থেকে আলাদা হয়েছেন বলে দাবি করেছেন। তাই আওয়ামী লীগ যে সিদ্ধান্ত দিয়েছে এই সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে প্রার্থী হয়ে মাঠে সরব অনেকেই।

নির্বাচন কমিশনের তফসিল অনুযায়ী, এবারের উপজেলা নির্বাচনের প্রথম ধাপের মনোনয়নপত্র বাছাই শেষে আপিল নিষ্পত্তি হবে রবিবার (২১ এপ্রিল)। প্রার্থিতা প্রত্যাহারের শেষ সময় সোমবার (২২ এপ্রিল)। তার পরদিন মঙ্গলবার প্রতীক বরাদ্দ হবে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এখন পর্যন্ত দলীয় এমপি-মন্ত্রীর প্রায় দুই ডজন স্বজন উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে প্রার্থী হয়েছেন । এদের মধ্যে নরসিংদী-২ আসনের সংসদ সদস্য আনোয়ার আশরাফ খানের শ্যালক মো. শরিফুল হক নরসিংদীর পলাশ উপজেলায়, প্রতিমন্ত্রী জুনায়েদ আহমেদ পলকের শ্যালক লুৎফুল হাবীব রুবেল সিংড়া উপজেলায় প্রার্থী হয়েছেন। এছাড়া মাগুরা-২ আসনের সংসদ সদস্য বীরেন শিকদারের ছোট ভাই বিমল শিকদার, মাদারীপুর-১ আসনের সংসদ সদস্য শাহজাহান খানের ছেলে আসিবুর রহমান খান, বগুড়া-১ আসনের সংসদ সদস্য সাহাদারা মান্নানের ছেলে মোহাম্মদ সাখাওয়াত হোসেন ও ছোট ভাই মিনহাদুজ্জামান ওরফে লিটন ভিন্ন ভিন্ন উপজেলায় চেয়ারম্যান প্রার্থী হয়েছেন।

সুনামগঞ্জ-৩ আসনে সংসদ সদস্য এম এ মান্নানের ছেলে শাহাদাত মান্নান সুনামগঞ্জের শান্তিগঞ্জ উপজেলায়, সুনামগঞ্জের সাবেক সংরক্ষিত আসনের সংসদ সদস্য ও জেলা মহিলা আওয়ামী লীগের সভাপতি শামসুন্নাহার বেগমের ছেলে ফজলে রাব্বি, মানিকগঞ্জ-৩ আসনের সংসদ সদস্য জাহিদ মালেকের ফুপাতভাই ইসরাফিল হোসেন সদর উপজেলায়, কুষ্টিয়া-৩ আসনের সংসদ সদস্য আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মো. মাহাবুবউল আলম হানিফের চাচাতভাই আতাউর রহমান কুষ্টিয়া সদর উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থী, নোয়াখালী-৬ আসনের সংসদ সদস্য মোহাম্মদ আলীর ছেলে আতিক আলী অমি হাতিয়া উপজেলার প্রার্থী হয়েছেন। একইসঙ্গে এমপি মোহাম্মদ আলীর স্ত্রী ও সাবেক এমপি আয়েশা আলীও উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে প্রার্থী।

নোয়াখালী-৪ আসনের সংসদ সদস্য মোহাম্মদ একরামুল করিম চৌধুরীর ছেলে আতাহার ইশরাক শাবাব চৌধুরী সুবর্ণচর উপজেলায়, টাঙ্গাইল-১ আসনের সংসদ সদস্য ও সাবেক কৃষিমন্ত্রী মো. আব্দুর রাজ্জাকের খালাতভাই ধনবাড়ীয়া উপজেলায়, পিরোজপুর-১ আসনের সংসদ সদস্য শ ম রেজাউল করিমের ছোট ভাই নূর-ই আলম নাজিরপুর উপজেলায়, বরিশাল-১ আসনের সংসদ সদস্য আবুল হাসানাত আবদুল্লাহর ছোট ছেলে আশিক আব্দুল্লাহ আগৈলঝাড়া উপজেলায়, শরীয়তপুর-১ আসনের সংসদ সদস্য ইকবাল হোসেন অপুর চাচাতভাই বিল্লাল হোসেন নিপু সদর উপজেলা নির্বাচনে প্রার্থী হয়েছেন।

দলীয় এমপি-মন্ত্রীর স্বজনদের উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে প্রার্থী না হওয়ার জন্য কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ নির্দেশনা দিলেও তা মানছে না অনেকে।

ইতোমধ্যে নির্বাচনে ছেলের পক্ষে প্রভাব খাটাতে গিয়ে নোয়াখালী-৬ আসনের সংসদ সদস্য একরামুল করিম চৌধুরী এক জনসভায় বলেছেন, নোয়াখালীর সুবর্ণচরে নিজের ছেলেকে ভোট না দিলে উন্নয়নকাজ করবেন না তিনি।

একরামুল করিম চৌধুরী ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘আমার ছেলে উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের প্রার্থী হলেও দলীয় কোনো নির্দেশনা অমান্য করছে না। তার নির্বাচন করার অধিকার আছে তাই করবে।’

এছাড়া নাটোরে প্রতিমন্ত্রী পলকের শ্যালক লুৎফুল হাবিবের বিরুদ্ধে প্রতিপক্ষ প্রার্থীকে অপহরণের অভিযোগ উঠেছে। এসব অভিযোগের বিষয়ে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন আওয়ামী লীগ নেতারা। দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের দলীয় এমপি-মন্ত্রীদের স্পষ্ট বার্তা দিয়েছেন সংসদ সদস্যদের সন্তান, পরিবারের সদস্য ও স্বজন কেউ উপজেলা নির্বাচন করতে পারবে না। এবং দলের কোনো এমপি, মন্ত্রী তাদের পক্ষে সমর্থন করলে তাদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

নরসিংদী-২ আসনের সংসদ সদস্য আনোয়ার আশরাফ খানের শ্যালক মো. শরিফুল হক নরসিংদী পলাশ উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে প্রার্থী। তিনি ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘আমি কোনো এমপির পরিচয় দিয়ে উপজেলা নির্বাচন করছি না। বরং তিনি আমাদের পরিচয় দিয়ে এমপি হয়েছেন। দীর্ঘদিন ধরে রাজনীতি করি। আমি আমার পরিচয়ে নির্বাচন করব। দল আমাকে সরে যাওয়ার নির্দেশনা দেয়নি, নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়াবো না।‘

শরীয়তপুর সদর উপজেলা নির্বাচনের প্রার্থী শরীয়তপুর-১ আসনের সংসদ সদস্য ইকবাল হোসেন অপুর চাচাতভাই বিল্লাল হোসেন নিপু ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘আমি নির্বাচন করবো, এটাই আমার সিদ্ধান্ত। এমপি-মন্ত্রীর স্বজনরা উপজেলা নির্বাচন করতে পারবে না- এমন নির্দেশনা আওয়ামী লীগ থেকে দেওয়া হয়নি।’

পিরোজপুর-১ আসনের সংসদ সদস্য শ ম রেজাউল করিমের ছোট ভাই নূর-ই আলম নাজিরপুর উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের প্রার্থী। তিনি ঢাকাটাইমসকে বলেন, আমি উপজেলা নির্বাচন করবো। নির্বাচনের মাঠে আছি, থাকবো। আমার বড় ভাই এমপি হলেও তাদের সঙ্গে সর্ম্পক নাই। তিনি আর আমি আলাদা থাকি। আমি নির্বাচন করবো।

নোয়াখালী-৪ আসনের সংসদ সদস্য মোহাম্মদ একরামুল করিম চৌধুরীর ছেলে আতাহার ইশরাক শাবাব চৌধুরী সুবর্ণচর উপজেলা পরিষদের প্রার্থী। তিনি ঢাকাটাইমসকে বলেন, আমি উপজেলা পরিষদ নির্বাচন করবো এবং নির্বাচনের মাঠে আছি। আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে আমি তেমন সম্পৃক্ত না। তাই দলীয় নির্দেশনা আমার জন্য নয়।

উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের নানা বিষয় নিয়ে গত বৃহস্পতিবার রাজধানীর ধানমন্ডিতে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার রাজনৈতিক কার্যালয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে বৈঠক হয়েছে দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের নেতৃত্বে। সাংগঠনিক সম্পাদক মির্জা আজম, আবু সাইদ আল মাহমুদ স্বপন, এসএম কামাল হোসেন ও আফজাল হোসেন এই বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন। বৈঠকে দলের সাংগঠনিক সম্পাদকদের বিভিন্ন নির্দেশনা দেন ওবায়দুল কাদের।

দলীয় সূত্রে জানা গেছে, আওয়ামী লীগের যেসব এমপি-মন্ত্রীর ছেলে-মেয়ে ও আত্মীয়স্বজন উপজেলা নির্বাচনে প্রার্থী হচ্ছেন তাদের তালিকা করা হচ্ছে এবং নজর রাখছেন দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা।

আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আফজাল হোসেন বলেন, উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের নানা বিষয় নিয়ে দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের কয়েকজন সাংগঠনিক সম্পাদকের সঙ্গে কথা বলেছেন। তিনি দলীয় এমপি-মন্ত্রীদের জন্য স্পষ্ট বার্তা দিয়েছেন তাদের কোনো আত্মীয়স্বজন ও ছেলে-মেয়েরা অংশ নিতে পারবে না। যদি দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গ করে উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে অংশ নেয় এবং এমপি-মন্ত্রী তাদের পক্ষে সমর্থন করে তাহলে তাদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেবে দল। এমপি, মন্ত্রী–সংসদ সদস্যরা যাতে উপজেলা নির্বাচনে প্রভাব বিস্তার করতে না পারেন, সে জন্য স্থানীয় প্রশাসন ও পুলিশকেও নানা নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে সরকারের পক্ষ থেকে।

আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম বলেন, দলের এমপি, মন্ত্রীর স্বজনরা উপজেলা নির্বাচনে প্রার্থী হতে পারবেন না— দল থেকে এই নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। যদি কেউ অমান্য করে প্রার্থী হয় তাহলে দল নিয়ম অনুযায়ী ব্যবস্থা নেবে। সবকিছুর দিকে দল নজর রাখছে।

উপজেলা নির্বাচনসহ নানা বিষয় নিয়ে শিগগিরই আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদেরও বৈঠক হওয়ার কথা রয়েছে। দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্য করলে গঠনতন্ত্র অনুযায়ী সরাসরি বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত আসতে পারে সেই বৈঠকে।