অবশেষে সরিয়ে দেওয়া হলো সাবেক প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু সিন্ডিকেটের আরেক গডফাদার তিতাস গ্যাস কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) হারুনুর রশীদ মোল্লাহকে। তিন বছর ধরে তিনি তিতাস গ্যাস কোম্পানিতে এক ধরনের রামরাজত্ব কায়েম করেছিলেন।
তার বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় অভিযোগ হচ্ছে, তিনি আইনকানুনের তোয়াক্কা না করে তিন বছরে ১৫০টি প্রতিষ্ঠানকে গ্যাসের নতুন সংযোগ ও লোড বৃদ্ধি করে অন্তত ৫৫০ কোটি টাকা ঘুস নিয়েছেন।
প্রতিটি সংযোগ ও লোড বৃদ্ধির ক্ষেত্রে ঘুসের রেট ছিল ৫ কোটি থেকে ১০ কোটি টাকা। তার সময়ে অন্তত ১ হাজার ৪০০টি অবৈধ গ্যাস-সংযোগ দেওয়া হয়। এসব অবৈধ সংযোগ থেকে মাসে ২০ কোটি থেকে ৩০ কোটি টাকা ঘুস আদায় করত তার সিন্ডিকেট। সাবেক বিদ্যুৎ ও জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু ও তার স্ত্রী সীমা হামিদকে মোটা অঙ্কের ঘুস দিয়ে তিনি তিতাসে নিয়োগ বাগিয়ে নিয়েছিলেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
হারুনুর রশীদ মোল্লাহর বিরুদ্ধে আরও অভিযোগের মধ্যে রয়েছে-তিনি কেরানীগঞ্জ এলাকায় কয়েক শ ছোট-বড় শিল্পকারখানায় অবৈধ সংযোগ দিয়ে প্রতিমাসে কোটি কোটি টাকা মাসোহারা নিতেন। গত তিন বছরে এসব কারখানায় একবারের জন্যও অভিযান চালানো হয়নি। সম্প্রতি জ্বালানি বিভাগ থেকে ওই এলাকায় গোপনে অভিযান চালানোর সিদ্ধান্ত হয়। দায়িত্ব দেওয়া হয় জ্বালানি খাতের সবচেয়ে সৎ ও দক্ষ অফিসার হিসাবে পরিচিত গ্যাস ট্রান্সমিশন কোম্পানি লিমিটেডের (জিটিসিএল) ব্যবস্থাপনা পরিচালক শাহনেওয়াজ পারভেজকে। এরপর গত দুইদিনের ঝটিকা অভিযানে ওই এলাকায় অসংখ্য অবৈধ শিল্পকারখানার সন্ধান পাওয়া গেছে।
২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে হারুনুর রশীদ মোল্লাহ তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের এমডি পদে পদোন্নতি পান। দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই তার বিরুদ্ধে একের পর এক ঘুস ও অনিয়মের অভিযোগ উঠতে থাকে। প্রায় দুই বছরে এমডি থাকাকালীন তিনি অবৈধভাবে ১০০ কোটি টাকার বেশি অর্থ হাতিয়ে নেন এই খাত থেকে। এই অর্থের একটা অংশ তুলে দিতেন নসরুল হামিদ বিপু সিন্ডিকেটের হাতে। বিনিময় হিসাবে ২০২৩ সালের আগস্টে তিতাসের এমডি পদে এক বছরের জন্য চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পান তিনি। হারুনুর রশীদ মোল্লাহ বিভিন্ন জায়গায় দাবি করতেন, তার স্ত্রী নসরুল হামিদের স্ত্রীর বড় বোন। তবে গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর রাতারাতি বিএনপিপন্থি সেজে যান হারুনুর রশীদ। এরপর বিএনপির বেশ কয়েকজন শীর্ষ নেতাকে দিয়ে তদবির করে ফের তিতাসের এমডি পদে চুক্তি নবায়নের চেষ্টা চালান। কিন্তু জ্বালানি সেক্টরে তার দুর্নীতি, কমিশন বাণিজ্য আর সংযোগ বাণিজ্য ভয়াবহ আকার ধারণ করায় বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার শুরু থেকেই তার চুক্তি নবায়নের বিরুদ্ধে ছিল।
হারুনুর রশীদ মোল্লাহ এতটাই প্রভাবশালী ছিলেন যে, যত বড় অনিয়ম-দুর্নীতি করুক না কেন প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদের ঘনিষ্ঠ হওয়ায় বারবার ছাড় পেয়ে যান। সাবেক প্রতিমন্ত্রীর ছত্রছায়ায় মন্ত্রণালয়ের অনুমতি না নিয়ে ক্যাপটিভ পাওয়ারে গ্যাস-সংযোগ, গ্যাসের নতুন সংযোগ ও অবৈধ সংযোগের দেদার বাণিজ্য করেছেন তিনি। চুক্তি নবায়ন হওয়ার পর তিনি এতটাই বেপরোয়া হয়ে পড়েছিলেন, বড় বড় শিল্পকারখানার মালিকদের কাছে প্রতিমাসে ৫ কোটি থেকে ১০ কোটি টাকা ঘুস দাবি করতেন। যারা তাকে ঘুস দিতেন না, তাদের নানাভাবে হয়রানি করতেন। কোনো কারণ ছাড়াই তাদের শিল্পকারখানার সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিতেন। এরপর নানাভাবে করতেন হয়রানি।
তিতাসের কর্মকর্তারা বলছেন, দেশের কোনো গ্যাস বিতরণ সংস্থা ১০ মেগাওয়াটের বেশি কোনো ক্যাপটিভ পাওয়ার কেন্দ্রে গ্যাস সরবরাহ করতে চাইলে এজন্য জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের অনুমতি নিতে হয়। ১০ মেগাওয়াটের বেশি এমন অন্তত ২০টি ক্যাপটিভ বিদ্যুৎকেন্দ্রকে গ্যাস-সংযোগ দিয়েছেন তিতাসের বর্তমান এমডি হারুন, যেগুলোর একটিরও অনুমতি নেওয়া হয়নি। জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিভাগের অনুমতি ছাড়াই গ্যাস সরবরাহ করা প্রতিটি ক্যাপটিভ কেন্দ্র থেকে ৫ থেকে ১০ কোটি টাকা নেওয়া হয়েছে। বেশকিছু ক্ষেত্রে তিতাসের এমডি ১০ মেগাওয়াটকে ভেঙে একাধিক ভাগে লোড দিয়েছেন। এতে কৌশলে এড়ানো গেছে মন্ত্রণালয়ের অনুমতি। এছাড়া অন্তত ১০০ ক্যাপটিভ কেন্দ্রকে গ্যাস-সংযোগ দেওয়া হয়েছে ঘুসের বিনিময়ে।
গত বছরের সেপ্টেম্বর গাজীপুরের সিলভার টেক্সটাইল মিল বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রীর কাছে গ্যাস-সংযোগের আবেদন করে। ওই আবেদনে জ্বালানিমন্ত্রীর (তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা) কোনো সুপারিশ ছিল না। তবে সেই আবেদনের ফাইল ঢাকায় আনার জন্য তিতাসের গাজীপুর অফিসকে নির্দেশ দেন এমডি হারুন। সেখানে বলা হয়, এটি জ্বালানিমন্ত্রীর তদবির। এরপরই সিলভার টেক্সটাইল মিল সংযোগ পেয়ে যায়।
পরে প্রধানমন্ত্রীর নামে এমন নির্দেশনা দেখে গত বছরের ২৯ আগস্ট প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে জ্বালানি বিভাগের সচিবকে চিঠি পাঠানো হয়। চিঠিতে প্রধানমন্ত্রীর নাম ব্যবহার করে ঘুসের মাধ্যমে শিল্পপ্রতিষ্ঠানে গ্যাস-সংযোগ প্রদানের বিষয়ে ব্যবস্থা নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়কে অবহিত করার জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়। কিন্তু নসরুল হামিদ বিপুর জন্য তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব হয়নি।
অনুসন্ধানে আরও জানা যায়, মেঘনা গ্রুপের এভারেস্ট পাওয়ার জেনারেশন ৮ মেগাওয়াট অতিরিক্ত লোড চালাচ্ছিল। এজন্য লাইনটি কেটে দেওয়া হয়। পরে তিতাস বোর্ডের অনুমোদন ছাড়াই ৩ কোটি টাকা ঘুস নিয়ে ফের সংযোগ দেওয়া হয়। এছাড়া রুপালি ডাইংয়ে মিটার টেম্পারিং করে অবৈধভাবে বা চুরি করে গ্যাস নেওয়ার কারণে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়েছিল। আবার ঘুস নিয়ে ওই রাতে সংযোগ দেওয়া হয়।
সিএনজি স্টেশনে গ্যাস-সংযোগ নিতে হলে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসি) লাইসেন্স নেওয়া বাধ্যতামূলক। এই লাইসেন্স না থাকলেও একের পর এক নতুন গ্যাস-সংযোগ দিয়েছেন তিতাস গ্যাসের এমডি হারুন। তিতাস সূত্র বলছে, ঢাকায় লাইসেন্সবিহীন সিএনজি স্টেশন রয়েছে ৪০টি। এ ছাড়া নারায়ণগঞ্জে ১৫টি, নরসিংদীতে ১০টি, গাজীপুরে ১০টি, মুন্সীগঞ্জে ২টিসহ মোট ৭৯টি লাইসেন্সবিহীন গ্যাস-সংযোগ রয়েছে তিতাসের। অভিযোগ আছে, এগুলোর প্রতিটির কাছ থেকে ৫০ লাখ টাকা করে ঘুস নিয়েছেন তিতাসের এমডি।