কলেজ ‘শাটডাউন’ ঘোষণা, আজ ফের অবরোধ

রাজধানীর সরকারি তিতুমীর কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরের দাবিতে সব ধরনের একাডেমিক কার্যক্রম বন্ধ ঘোষণা করেছেন শিক্ষার্থীরা। গতকাল সোমবার রাত সাড়ে ৯টায় তারা সড়ক অবরোধ তুলে নিয়েছেন। তবে আজ মঙ্গলবারও সকাল ১১টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত মহাখালী অবরোধের কর্মসূচি ঘোষণা করেছেন তারা।

গতকাল রাতে এক সংবাদ সম্মেলনে শিক্ষার্থীরা বলেন, ‘আমরা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দাবি জানিয়েছিলাম।

এর আওতায় থাকবে সড়কপথ ও রেলপথ।’এর আগে গতকাল সোমবার মহাখালী এলাকায় সড়ক ও রেলপথ টানা সাড়ে চার ঘণ্টা অবরোধ করে রাখেন তিতুমীর কলেজের শিক্ষার্থীরা। এতে রাজধানীজুড়ে ব্যাপক যানজট সৃষ্টি হয়ে দুর্ভোগ পোহায় হাজারো মানুষ। ঢাকা থেকে বন্ধ হয়ে যায় সারা দেশের ট্রেন চলাচল।

অবরোধ চলাকালে এক পর্যায়ে নোয়াখালী থেকে আসা আন্ত নগর ট্রেন উপকূল এক্সপ্রেস লক্ষ্য করে পাথর ছুড়লে শিশুসহ পাঁচজন যাত্রী আহত হয়। এ ঘটনায় ট্রেনের কয়েকটি জানালার কাচ ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

সকাল সাড়ে ১১টার দিকে শিক্ষার্থীরা কলেজ ক্যাম্পাস থেকে এসে মহাখালী লেভেলক্রসিং এলাকায় সড়ক ও রেলপথ অবরোধ করেন। এতে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরমুখী সড়কের দুই পাশে যান চলাচল বন্ধ হয়ে ব্যাপক জট লেগে যায়। তা ছড়িয়ে পড়ে ঢাকার অন্যান্য সড়কে।

ঢাকার সঙ্গে সারা দেশের ট্রেন চলাচলও বন্ধ হয়ে যায়।ঢাকা বিভাগীয় রেলওয়ে কমান্ড্যান্ট মো. শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘সকালে উপকূল এক্সপ্রেস ট্রেনটিতে হামলার ঘটনায় ট্রেনের গ্লাস ভাঙচুর করা হয়। ট্রেনটি চলন্ত অবস্থায় ছিল।’

রেলওয়ে কন্ট্রোলরুম সূত্র জানায়, শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের কারণে মহাখালী এলাকায় দুটি আন্ত নগর ট্রেন আটকে যায়। এর মধ্যে একটি জামালপুরের তারাকান্দিগামী অগ্নিবীণা এক্সপ্রেস এবং অন্যটি চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে ছেড়ে আসা ঢাকামুখী বনলতা এক্সপ্রেস।

এ বিষয়ে রেলের মহাপরিচালক সরদার সাহাদাত আলী বলেন, ‘দুপুর পৌনে ১২টার দিকে নোয়াখালী থেকে আসা উপকূল এক্সপ্রেস মহাখালী পার হচ্ছিল। এ সময় আন্দোলনকারীরা ট্রেনে পাথর ছুড়লে শিশুসহ কয়েকজন যাত্রী আহত হয়। এতে পাঁচটি কোচের জানালার ২৯টি কাচ ভেঙে যায়। আহতদের আমরা প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়েছি।’

ঘটনাস্থল পরিদর্শনকারী বনানী থানার ওসি রাসেল ‍সারোয়ার বলেন, এ সময় সড়কে তীব্র যানজট সামলাতে ট্রাফিক পুলিশের পাশাপাশি বাড়তি পুলিশ সদস্যরা কাজ করেন।

বিকেল ৪টা পর্যন্ত তাদের এই আন্দোলন কর্মসূচি চলে। দুই ঘণ্টা বিরতির পর সন্ধ্যা ৬টার দিকে শিক্ষার্থীরা আবার সড়ক অবরোধ করেন।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, বিকেলে দাবির বিষয়ে সচিবালয়ে শিক্ষার্থীরা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বৈঠক করেন। কর্তৃপক্ষের আশ্বাসে সন্তুষ্ট হতে না পেরে সচিবালয়েই অনশনে বসেন ১৩ জন শিক্ষার্থী।

ভুক্তভোগীদের ভাষ্য

সরেজমিনে দেখা যায়, অবরোধের কারণে মহাখালী ফ্লাইওভারে যান চলাচল করেনি। মহাখালীর আমতলী, কাঁচাবাজার ও লেভেলক্রসিংয়ে শত শত শিক্ষার্থী জড়ো হয়েছেন। বনানী থেকে জাহাঙ্গীর গেট হয়ে ফার্মগেট পর্যন্ত সড়কপথে যান চলাচল বন্ধ হয়ে আছে।

অবরোধ চলাকালে কুর্মিটোলা থেকে বনানী পর্যন্ত রাস্তায় গাড়ি আটকে থাকে। বনানী থেকে তেজগাঁও, মহাখালীর আমতলী থেকে জাহাঙ্গীর গেট এবং মহাখালী থেকে গুলশান পর্যন্ত যান চলাচল বন্ধ ছিল। এ সময় যাত্রীদের গাড়ি থেকে নেমে হেঁটে গন্তব্যে যেতে দেখা যায়।

ভুক্তভোগী এক ব্যক্তি বলেন, ‘শিক্ষার্থীদের দাবি যৌক্তিক হলে তারা সরকারের কাছে গিয়ে তা পেশ করুক। রাস্তাঘাট বন্ধ করে মানুষকে জিম্মি করা তো অন্যায়।’

ভুক্তভোগীদের একজন সাইদুর রহমান অসুস্থ স্ত্রী আয়েশা বেগমকে নেত্রকোনার কেন্দুয়া উপজেলা থেকে ঢাকার ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস ও হাসপাতালে চিকিৎসক দেখাতে নিয়ে এসেছিলেন। স্বামী-স্ত্রী দুজনই বয়স্ক। সাইদুর রহমান বলেন, ‘রাস্তা আটকে এভাবে মানুষকে হয়রানি করা ঠিক নয়।’

মহাখালী সরকারি সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতালে যাওয়ার জন্য মিরপুরের কালশী থেকে বাসে ওঠেন মাহমুদা আক্তার। তিনি বলেন, ‘এক ঘণ্টা ধরে বাসে বসে আছি। দুই বাচ্চা নিয়ে তো হেঁটে যাওয়ারও উপায় নাই। জনগণের কষ্ট কেউ বোঝে না।’

বিকেলে বৈঠক

শিক্ষার্থীরা ঘোষণা দেন, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা সুনির্দিষ্ট আশ্বাস না দিলে তারা কলেজে ফিরে যাবেন না। দুপুরে মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে শিক্ষার্থীদের প্রতিনিধিদলের সঙ্গে বৈঠক করার প্রস্তাব দেওয়া হয়।

শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বিকেল সাড়ে ৩টার দিকে সরকারের পক্ষ থেকে বিষয়টি নিয়ে আলোচনার জন্য শিক্ষার্থী প্রতিনিধিদের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে ডাকা হয়। বৈঠক করতে ১২ সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে যায়। ১২ সদস্যের এই দলে ছিলেন মেহেদী হাসান, মাহামুদুল হাসান, জাহাঙ্গীর সানি, আমিনুল, নুর উদ্দিন জিসান, কাউসার আহমেদ, মোশারফ হোসেন, তোহা, নুর মোহাম্মদ, হাবিব উল্লাহ রনি, আব্দুল হামিদ ও নীরব হোসেন।

প্রতিনিধিদলের সদস্য হাবিব উল্লাহ রনি জানান, সচিবসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠকে কথা বলেছেন তারা। সেখান থেকে বিশ্ববিদ্যালয় করতে কমিশন গঠনসহ গ্রহণযোগ্য ও সুনির্দিষ্ট আশ্বাস পেয়ে তারা কর্মসূচি স্থগিত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তাদের দাবি বাস্তবায়িত না হলে শিক্ষার্থীদের মতামতের ভিত্তিতে শিগগিরই নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে।

সন্ধ্যায় ফের সড়কে শিক্ষার্থীরা

বিকেল ৪টায় অবরোধ তুলে নিলেও সন্ধ্যা ৬টার দিকে আবার কলেজের সামনে মহাখালী-গুলশান সড়কে অবস্থান নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরের দাবি জানাতে থাকেন শিক্ষার্থীরা। এতে এই সড়কের দুই পাশেই যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। তাদের দাবি, সন্ধ্যার পর মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা আগের অবস্থান থেকে সরে আসায় তারা আবার সড়কে নেমেছেন।

সন্ধ্যায় বনানী থানার ওসি রাসেল সারোয়ার বলেন, ‘সন্ধ্যায় ফের কলেজের সামনে শিক্ষার্থীরা অবস্থান নেন। এতে সড়কের দুই পাশেই যান চলাচল বন্ধ রয়েছে। খবর পেয়ে আমরা ঘটনাস্থলে গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টায় রয়েছি।’

ইংরেজি বিভাগ তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী হাবিবুর রহমান বলেন, ‘সকালে আমাদের প্রতিনিধিরা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে যান। সেখানে তাদের তিন দিনের মধ্যে তিতুমীর কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরের কমিশন গঠনের আশ্বাস দেওয়া হলেও সন্ধ্যায় মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা সেই অবস্থান থেকে সরে আসেন। তারা বলছেন, কমিটি গঠন হবে না। উপদেষ্টারা জানিয়েছেন, বিষয়টি নিয়ে কী করা হবে, সেটি বিবৃতি দিয়ে জানানো হবে। এখন সরকার কী সিদ্ধান্ত নিয়েছে এবং সেটি বিবৃতি দিয়ে না জানানো পর্যন্ত শিক্ষার্থীরা ধোঁয়াশার মধ্যে আছেন। এমন পরিস্থিতিতে দ্রুত বিবৃতির দাবিতে সড়ক অবরোধ করা হয়েছে।’

৭ কলেজের বিষয়ে কথা চলছে : প্রেসসচিব

তিতুমীর কলেজের শিক্ষার্থীদের শান্ত হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার প্রেসসচিব শফিকুল আলম। গতকাল সন্ধ্যায় সমসাময়িক বিষয়ে রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইংয়ের ব্রিফিংয়ে এই আহ্বান জানান তিনি।

শিক্ষার্থীদের তিন দফা দাবি

তিতুমীর কলেজ শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের দাবিতে তিন দফা দাবি জানিয়েছেন। দাবিগুলো হলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্তি বাতিল করে সাত কলেজ থেকে তিতুমীর কলেজকে পৃথক করতে হবে; তিতুমীর কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরের লক্ষ্যে কমিশন গঠন করতে হবে এবং তিতুমীরকে একটি স্বতন্ত্র বিশ্ববিদ্যালয় বাস্তবায়নের রূপরেখা প্রণয়ন করতে হবে।

সরকারি তিতুমীর কলেজকে পূর্ণাঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরের দাবিতে দুই মাস ধরে আন্দোলন করছেন শিক্ষার্থীরা।