দেশের পরিস্থিতি বেগতিক দেখে গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করে হেলিকপ্টারে করে ভারতে পালিয়ে যান। পরে ড. মুহাম্মদ ইউনূস অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব গ্রহণ করেন।
বিশ্লেষকরা বলছেন, বাংলাদেশের ক্ষমতাচ্যুত নেত্রী শেখ হাসিনার প্রত্যর্পণের মতো বিতর্কিত বিষয় নিয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে দেখা করতে চান না।
দক্ষিণ এশিয়া ইনস্টিটিউটের পরিচালক মাইকেল কুগেলম্যান বলেছেন, ঢাকার সঙ্গে নয়াদিল্লির সম্পর্ক ‘অত্যন্ত সংবেদনশীল একটি ইস্যু’ হয়ে উঠেছে। কারণ অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে উচ্চপর্যায়ের যেকোনো আলোচনার জন্য ভারতকে আগে যে বিষয়ে ফোকাস করতে হবে তারা এই মুহূর্তে সেই বিষয়টি এড়িয়ে যেতে চাইছে। এর মধ্যে প্রধান হলো বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারতে উপস্থিতি।
কুগেলম্যান বলেন, অন্তর্বর্তী সরকার তাকে বাংলাদেশের কাছে হস্তান্তরের কথা বলেছিল কিন্তু দিল্লি তাকে ছাড়তে রাজি হয়নি দেশের অনেক নেতার সঙ্গে হাসিনার ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের কারণে। মোদি যদি ইউনূসের সঙ্গে দেখা করতেন, তাহলে এ ইস্যুতে আলোচনা এড়ানো তার পক্ষে অসম্ভব ছিল।
ভারতীয় মিডিয়া গত সপ্তাহে জানিয়েছে, দিল্লি এখনো নিশ্চিত করতে পারেনি- তারা মোদি এবং ইউনূসের মধ্যে বৈঠকের জন্য ঢাকার অনুরোধে সাড়া দেবে কিনা। জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে যোগ দেওয়ার জন্য এ মাসের শেষের দিকে দুজনেরই নিউইয়র্কে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
গত মাসে প্রথমে মোদির সঙ্গে ফোনে কথা বলেছেন ড. ইউনূস এবং তাকে আশ্বস্ত করেছেন যে- অন্তর্বর্তী সরকার ‘বাংলাদেশের হিন্দু এবং সমস্ত সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর সুরক্ষাকে অগ্রাধিকার দেবে’।
বাংলাদেশের পররাষ্ট্র বিষয়ক উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন সম্প্রতি বলেছেন, জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের সাইডলাইনে যেকোনো বৈঠক করার জন্য ‘নির্দিষ্ট পদ্ধতি’ অনুসরণ করতে হবে। কারণ এ ধরনের আলোচনা আগে থেকে পরিকল্পনা করা হয়নি।
বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল জানিয়েছে, আগস্টে গণবিক্ষোভ দমনে কর্তৃপক্ষ যে মারাত্মক সহিংসতার আশ্রয় নিয়েছিল সেই বিচারের মুখোমুখি হওয়ার জন্য হাসিনার ভারত থেকে প্রত্যর্পণ নিশ্চিত করতে পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। হাসিনা প্রাথমিকভাবে অল্প সময়ের জন্য ভারতে থাকবেন বলে আশা করা হয়েছিল, কিন্তু এখন জানা যাচ্ছে যে যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতে আশ্রয় নেওয়ার তার প্রচেষ্টা এখনো পর্যন্ত সফল হয়নি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক লাইলুফার ইয়াসমিন বলেন, মোদি-ইউনূস বৈঠক যত তাড়াতাড়ি হবে তা দিল্লির জন্যই মঙ্গল। দিল্লিকে বাস্তবতা মেনে নিতে হবে এবং ‘বাংলাদেশ ২.০’-এর সঙ্গে সম্পৃক্ত হতে হবে, যা ভারতের সমীকরণে কখনই ছিল না।
ইয়াসমিন মনে করেন, প্রথম বৈঠকের লক্ষ্য হওয়া উচিত- পরিবর্তিত বাস্তবতাকে স্বীকৃতি দেওয়া এবং উভয় দেশের মধ্যে সম্পর্কের বরফ গলানো। কারণ ভারত হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগের উপর বাজি ধরেছিল এবং বাংলাদেশিদের ‘স্পন্দন বোঝার’ চেষ্টা করেনি।
ভারতের জন্য এটা উপলব্ধি করার সময় এসেছে যে, শুধুমাত্র একটি রাজনৈতিক দলের মাধ্যমে দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক স্থাপন করা যায় না।
ভারতের ৫৩ বছরের বাংলাদেশ নীতিতে দূরদর্শিতার অভাব ছিল বলে উল্লেখ করে ইয়াসমিন বলেন, ভারত এর বাইরে কিছু দেখতে চায়নি, তারা বাস্তবতা থেকে তাই অনেক দূরে ছিল।
সাম্প্রতিক ঘটনাগুলো ভারতের কাছে তার প্রতিবেশীদের সঙ্গে একটি নতুন দৃষ্টিভঙ্গিতে সম্পর্ক স্থাপনের বার্তা হিসেবে কাজ করতে পারে। যদি ভারত একটি বৈশ্বিক শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হওয়ার আশা করে, তাহলে দক্ষিণ এশিয়াকে ‘পরিচালনা’ করার পরিবর্তে, এ অঞ্চল থেকে ‘সম্মতির’ প্রয়োজন হবে ভারতের।
হাসিনা তার শাসনামলে ভারতের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে দৃঢ় সম্পর্ক বজায় রেখেছিলেন। জুলাই মাসে তার দিল্লি সফরের সময় সামুদ্রিক সহযোগিতা, ডিজিটাল অংশীদারিত্ব এবং মহাকাশ প্রযুক্তি থেকে রেল সংযোগের ক্ষেত্রে দশটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল। তবে তার শাসনকালের সময়টি জোরপূর্বক গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যা এবং বিরোধীদের দমনের অভিযোগের দ্বারা বিদ্ধ। তার বিরুদ্ধে দেশটির গত তিনটি সাধারণ নির্বাচনে কারচুপি করার অভিযোগও আনা হয়েছিল, যার মধ্যে সর্বশেষ জানুয়ারির নির্বাচনের পর তিনি চতুর্থ মেয়াদে ক্ষমতায় এসেছিলেন। ভারত অবশ্য নির্বাচনের ফলাফলকে স্বাগত জানিয়ে অনেক বাংলাদেশিকে ‘ইন্ডিয়া আউট’ প্রচারাভিযান শুরু করতে প্ররোচিত করেছে। কারণ তারা দিল্লিকে নিজের স্বার্থ রক্ষার জন্য হাসিনাকে সমর্থন করার অভিযোগ তুলেছেন।
ভারতের অবজারভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের সহযোগী ফেলো সোহিনী বোস বলেন, দিল্লি যখন শেখ হাসিনার সরকারের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক বজায় রেখে কাজ করেছিল, তখন সম্পর্কটি পারস্পরিক নির্ভরতার ভিত্তিতে তৈরি হয়েছিল। বাস্তবতাকে মেনে নিয়ে ভারতকে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে ‘অনিবার্যভাবে’ একটি কার্যকর সম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে।
বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে দুই দেশের কূটনৈতিক সম্পর্ক অত্যন্ত ‘সূক্ষ্ম’ একটি বিষয় হওয়ায়, সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে ‘তাড়াহুড়ো’ না করার পরামর্শ দিচ্ছেন সোহিনী বোস। তার মতে, সম্পর্ক পুনরুদ্ধার করার সর্বোত্তম উপায় হলো সংযোগ এবং শক্তি প্রকল্পগুলোতে মনোনিবেশ করা।
গত নভেম্বরে ভারতের সহায়তায় নির্মিত তিনটি প্রধান সংযোগ ও শক্তি প্রকল্পের উদ্বোধন করেছে দুই দেশ, যার মধ্যে প্রতিবেশীদের সঙ্গে সংযোগ স্থাপনের জন্য একটি রেললাইন অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।
কুগেলম্যান বলেছেন, যদি দুই দেশের সম্পর্ক বরফ কঠিন হয়ে যায় তাহলে সীমান্ত নিরাপত্তার মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে আলোচনা চালানো কঠিন হয়ে যাবে।
তিনি বলেন, বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের বৃহত্তম বাণিজ্য অংশীদার, অন্যদিকে ভারত এশিয়ায় বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম বাণিজ্য অংশীদার।
ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানায়, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বাংলাদেশ ভারতে ১.৯৭ বিলিয়ন ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছে, যেখানে মোট দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য ছিল ১৪.০১ বিলিয়ন ডলার।
কুগেলম্যানের মতে, ভারত ও বাংলাদেশের নিজ নিজ রাষ্ট্রদূতদের অবিলম্বে তাদের স্বাগতিক সরকারের সঙ্গে আরও ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করতে হবে, যাতে তারা ‘উচ্চ পর্যায়ের সংযোগের পথ প্রশস্ত’ করতে পারে। হাসিনা-পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের রাজনীতিতে যে গভীর পরিবর্তন এসেছে তার পরিপ্রেক্ষিতে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক কতদূর যেতে পারে, তার সীমাবদ্ধতা থাকবে।
অদূর ভবিষ্যতে আওয়ামী লীগকে ‘আলোচনার বাইরে’ রেখে কুগেলম্যান বলেন, যে বাংলাদেশি রাজনৈতিক দলগুলো শূন্যস্থান পূরণ করবে তাদের সমালোচনা, কিছু ক্ষেত্রে শত্রুতারও সম্মুখীন হতে পারে ভারত।
ঢাকা যুক্তি দিতে পারে যে, এই পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে দিল্লির সঙ্গে সম্পর্ক ‘উষ্ণ না হলেও’, দুই দেশ একসঙ্গে কাজ করবে; কিন্তু কুগেলম্যান মনে করেন, এটি ভারতের জন্য উদ্বেগের বিষয় হবে। হাসিনার যুগে ভারত যে গভীর, কৌশলগত অংশীদারিত্ব উপভোগ করেছিল, সেই সম্পর্ক তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা কম। নতুন সম্পর্ক সম্ভবত আরও লেনদেনমূলক এবং কৌশলী হবে। সূত্র: সাউথ চায়না মর্নিং পোস্ট