‘শত্রু দেশের’ সিরিয়াল দেখতে কেন মুখিয়ে থাকে ভারতীয়রা?

এই মুহূর্তে পাকিস্তানের একটি টিভি সিরিয়ালে বুঁদ গোটা উপমহাদেশের দর্শক। ‘কাভি ম্যায় কাভি তুম’ নামের সে সিরিয়ালের শেষ পর্ব ইউটিউবে আপলোড হওয়ার পর দুই সপ্তাহে ৩ কোটি ৭০ লাখ বারের বেশি দেখা হয়েছে। সে পর্বের ইউটিউব কমেন্ট বক্সে ঢুঁ মেরে দেখা গেল, ভারতীয়দের কমেন্টের মেলা!

কেউ লিখেছেন, ‘ভারত থেকে ভালোবাসা। আমি পাকিস্তানি ড্রামার প্রশংসা করতে চাই…আমরা ভারতীয়রা পাকিস্তানি ড্রামার জন্য অপেক্ষায় থাকি। আরেকজনের মন্তব্য, ‘এটা ভারতে ট্রেন্ড করছে। এজন্য বলা হয়, শিল্পের কোনো সীমা নেই।’ অপর এক ভারতীয় দর্শক লিখেছেন, ‘একজন ভারতীয় হিসেবে বলছি, আমি কাভি ম্যায় কাভি তুম প্রথম পর্ব থেকে দেখছি। কী অসাধারণ একটা জার্নি ছিল!’

পাকিস্তান সিরিয়াল যে শুধু ভারতীয়দের মোহাবিষ্ট করে রেখেছে তা নয়, যেমনটা শুরুতেই বলা হয়, পুরো উপমহাদেশ বা তারও গণ্ডি ছাড়িয়ে এর জনপ্রিয়তা। কিন্তু বিশেষভাবে ভারতীয়দের মধ্যে পাকিস্তানি সিরিয়ালের জনপ্রিয়তার বিষয়টি উল্লেখ করার কারণ স্পষ্ট।

রাজনৈতিক কারণে দুই দেশের আনুষ্ঠানিক ‘মুখ দেখাদেখি’ একপ্রকার বন্ধ। দেশ দুটির শিল্পীরা একসময় সীমান্তের দুই দিকেই সমানতালে প্রতিক্রিয়াশীল রাজনীতিকদের কারণে এখন সেই সাংস্কৃতিক যোগাযোগ বন্ধ রয়েছে। কিন্তু ওই যে খোদ এক ভারতীয় দর্শকই ‘কাভি ম্যায় কাভি তুম’ দেখে বলে দিয়েছেন, শিল্পকে আসলে কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে আটকে রাখা যায় না। এর আবেদন, মানুষকে কাছে টানার ক্ষমতা সব কাঁটাতার ছিন্ন করে পৌঁছে যায় নিজস্ব গন্তব্যে, মানুষের হৃদয়ে।

কিন্তু কেন একটা ‘শত্রুদেশের’ টিভি সিরিয়াল দেখতে এত মুখিয়ে ভারতীয়রা? একটু ঘাঁটাঘাঁটি করলে জানা যায়, ভারতে পাকিস্তানে টিভি অনুষ্ঠানের জনপ্রিয়তার ইতিহাস প্রায় চার দশক পুরোনো। একসময় পাকিস্তানের কিংবদন্তি কমেডিয়ান উমর শরিফ, আমানউল্লাহ খান, আনোয়ার মাকসুদ, মঈন আখতারদের অনুষ্ঠান টিভি পর্দায় উপভোগ করতেন ভারতীয়রা।

এরপর পাকিস্তানের সিরিয়ালও সমানভাবে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। বিশেষ করে অভিনেতা ফাওয়াদ খান অভিনীত সিরিয়াল ‘জিন্দেগি গুলজার হ্যায়’, ‘দাস্তান’ বা ‘হামসাফার’-এর মতো সিরিয়ালগুলোতে বুঁদ হয়েছিলেন ভারতীয় দর্শকরা। অবশ্য শুধু সাধারণ নাটকপ্রেমীরাই নন, ভারতের জনপ্রিয় অভিনেতা-নির্মাতারাও পাকিস্তানি সিরিয়াল নিয়ে তাদের ভালোলাগার কথা সামাজিক মাধ্যমে জানিয়েছেন।

২০১৪ সালে যখন ভারতীয় টিভি চ্যানেল ‘জিন্দেগী’তে ‘হামসাফার’ প্রচারিত হচ্ছিল, তখন সামাজিক মাধ্যম টুইটারে (বর্তমান এক্স) পরিচালক সুভাষ ঘাই লিখেছিলেন, ‘জিন্দেগী চ্যানেলের ইন্টারেস্টিং নাটকগুলোতে যে মানুষ এবং ঘরগুলো দেখানো হয়, তা বাস্তবিক। এগুলো আমার নজর কেড়েছে।’

ভারতের জনপ্রিয় অভিনেতা জাভেদ জাফরি লিখেছিলেন, ‘জিন্দেগীতে একবসায় তিনটি সিরিয়াল দেখে ফেললাম। এই চ্যানেলের কনটেন্টগুলো (ভারতীয়) ডেইলি সোপগুলোকে হুমকির মুখে ফেলবে।’

ভারতে পাকিস্তানি সিরিয়ালের জনপ্রিয়তার কৃতিত্ব অনেকেই জিন্দেগী চ্যানেলকে দিয়ে থাকেন। ভারতীয় মিডিয়া কর্পোরেশন ‘জি’র এই চ্যানেলে পাকিস্তানি সিরিয়ালগুলো প্রচারিত হতো। যদিও ২০১৬ সালে উরি হামলার পরের বছর চ্যানেলটি বন্ধ হয়ে যায়।

তবে বিশ্বায়নের যুগে টিভি পর্দা থেকে দর্শকরা এখন ইউটিউবসহ বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমে বিনোদন খুঁজে নিচ্ছেন। পাকিস্তানের সব সিরিয়াল এখন ইউটিউবে পাওয়া যাচ্ছে। এছাড়া ইনস্টাগ্রামে রিল আকারে ঘুরে বেড়াচ্ছে সেসব সিরিয়ালের ক্লিপ। ছোট ছোট সেসব ক্লিপ দেখেই পড়ে পুরো নাটক দেখতে আগ্রহী হন দর্শকরা।

ভারতের জেন-জিরাও এখন ভারতীয় সিরিয়াল-সিরিজ ছেড়ে পাকিস্তানি সিরিয়াল বিঞ্জ করছেন। ভারতীয় সংবাদমাধ্যম ইন্ডিয়া টুডে দেশটির জেন-জিদের মধ্যে পাকিস্তানি সিরিয়ালের জনপ্রিয়তার কারণ খুঁজতে কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলেছে। এর মধ্যে নয়ডার ২২ বছর বয়সি সাংবাদিক ভারুল তাদের বলেছেন, ‘সারাজীবন যে মানুষগুলো ঘৃণা করতে বলা হয়েছে, যখন দেখি তারাও আমাদের মতোই, তখন আসলেই বিষয়টি ইন্টারেস্টিং মনে হয়।’

হিসারের ২৬ বছর বয়সি রাষ্ট্রবিজ্ঞান গবেষক অনামিকার ভাষায়, ‘পাকিস্তানি সিরিয়ালগুলো অনেক রিলেটেবল। কারণ আমাদের সংস্কৃতি প্রায় একই, আমাদের পরিবারগুলোও প্রায় একইরকম।’

অথচ ভারতীয় চাইলেই নিজেদের টিভি সিরিয়ালগুলো দেখতে পারেন। হাত বাড়ালেই বিগ বাজেটের পশ্চিমা সিরিজগুলোতে হারিয়ে যেতে পারেন। কিন্তু এরপরও কেন তারা বারবার পাকিস্তানি সিরিয়ালের কাছে ফিরে আসেন। এই প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে ৪৫ বছর বয়সি প্রকাশ ইন্ডিয়া টুডেকে বলেছেন, ‘দেখুন ফ্রেন্ডসের মতো পশ্চিমা সিরিজগুলো উচ্চাকাঙ্ক্ষী হতে পারে, তবে পাকিস্তানি সিরিয়ালগুলো বেশি রিলেটেবল।’

এছাড়া উর্দু ভাষার প্রতি সাধারণ ভারতীয়দের ভালোলাগার কথাও উঠে এসেছে জেন-জিদের কথায়। অনামিকা যেমন বললেন, ‘তারা সংলাপে যেভাবে উর্দু ব্যবহার করে, সেটা খুবই ভালো লাগে। তাদের সংলাপের প্রতিটা শব্দ মনোযোগ দিয়ে শুনি।’

অন্যদিকে ভারতীয় সিরিয়ালে অবাস্তব গল্প, অতিরঞ্জিত চিত্রায়ন বা ভাষার ক্ষেত্রে বেখেয়ালিপনা ক্রমেই সাধারণ দর্শকদের বিরক্তির কারণ হয়েছে। খোদ ভারতীয়রাই এখন নিজেদের সিরিয়াল থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন। একসময় বাংলাদেশে ভারতীয় সিরিয়ালের আধিপত্য চললেও সেটা এখন কমে আসছে। ভারতীয় সিরিয়াল ছেড়ে বাংলাদেশি দর্শকরা পাকিস্তানি ও তুর্কি সিরিয়ালে বুঁদ হয়েছেন।