মাদরাসার ছাত্র তারেক মাসুদ যেভাবে হয়ে ওঠেন চলচ্চিত্র নির্মাতা

উপমহাদেশের খ্যাতিমান চলচ্চিত্র নির্মাতা তারেক মাসুদের মৃত্যুবার্ষিকী আজ। ২০১১ সালের ১৩ আগস্ট মানিকগঞ্জে এক মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় তিনি মারা যান। সেদিন ‘কাগজের ফুল’ নামে একটি ছবির শুটিংয়ের লোকেশন নির্বাচন করার জন্য তারেক মাসুদ তার সহকর্মীদের নিয়ে পাবনার ইছামতী নদীর তীরে যান।

লোকেশন নির্বাচন শেষে দুপুর ১২টা ২০ মিনিটে গাড়িবহর নিয়ে ঢাকার উদ্দেশে রওনা দেন নির্মাতা। পথে ঘিওরে ঢাকা-আরিচা মহাসড়কে দুপুর ১২টা ২৫ মিনিটে বিপরীত দিক থেকে আসা একটি বাসের সঙ্গে তারেক মাসুদকে বহনকারী মাইক্রোবাসটির মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়।

সে সময় তারেক মাসুদের সঙ্গে ছিলেন তার দীর্ঘদিনের সহকর্মী সাংবাদিক ও বিশিষ্ট চিত্রগ্রাহক মিশুক মুনীর। তিনিও একই দুর্ঘটনায় মারা যান। এছাড়া ওই দুর্ঘটনায় আরও তিনজনসহ মোট পাঁচজনের মৃত্যু হয়।

এই তারেক মাসুদ সম্পর্কে সিনেমাপ্রেমীদের ধারণা কতটুকু? দর্শকরাই বা কতটুকু জানেন?

তারেক মাসুদ ছিলেন একাধারে চলচ্চিত্র পরিচালক, প্রযোজক, চিত্রনাট্যকার, লেখক ও গীতিকার। ১৯৫৬ সালের ৬ ডিসেম্বর ফরিদপুরের ভাঙ্গা উপজেলার নূরপুরে তার জন্ম। বাবা মশিউর রহমান মাসুদ এবং মা নুরুন নাহার মাসুদ।

চলচ্চিত্র নির্মাতা হিসেবে খ্যাতি পাওয়া তারেক মাসুদ মাদরাসার ছাত্র ছিলেন। ভাঙ্গা ঈদগাহ মাদরাসা থেকে তার শিক্ষাজীবন শুরু। পরবর্তীতে ভর্তি হন ঢাকার লালবাগের একটি মাদরাসায়। সেখান থেকে মৌলানা পাসও করেন। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় তার মাদরাসা শিক্ষার সমাপ্তি ঘটে।

এরপর ভাঙ্গা পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি, নটর ডেম কলেজ থেকে এইচএসসি এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাস বিষয়ে অনার্স, মাস্টার্স সম্পন্ন করেন তারেক মাসুদ। ১৯৮২ সালে বাংলাদেশ ফিল্ম আর্কাইভ থেকে ফিল্ম অ্যাপ্রিসিয়েশন কোর্স শেষ করে প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ শুরু করেন তিনি।

প্রায় ২০ বছর ধরে এ কাজের সঙ্গে জড়িত ছিলেন তারেক মাসুদ। এরপর ঢুকে পড়েন সিনেমা নির্মাণের কাজে। ২০০২ সালে তার নির্মিত প্রথম সিনেমা ‘মাটির ময়না’ মুক্তি পায়। সিনেমাটি তার শৈশবের মাদরাসা জীবনের অভিজ্ঞতা নিয়ে নির্মিত হয়েছিল। যেটি ওই বছর কান চলচ্চিত্র উৎসবে প্রদর্শিত হয়।

এরপর ‘আদম সুরত’, ‘মুক্তির গান’, ‘অন্তর্যাত্রা’ ও ‘রানওয়ে’সহ বেশ কয়েকটি সিনেমা নির্মাণ করেন তারেক মাসুদ। চলচ্চিত্রে বিশেষ অবদানের জন্য তিনি একুশে পদক, জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার, মেরিল প্রথম আলো পুরস্কার, বাচসাস পুরস্কার ও চ্যানেল আই চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করেন।

এছাড়া ফিল্ম সাউথ এশিয়া, কান চলচ্চিত্র উৎসব, মারাকেচ আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব, থ্রি কন্টিনেন্টন উৎসব, ভারতীয় আন্তর্জাতিক ভিডিও উৎসব, কারা চলচ্চিত্র উৎসব, ডিরেক্টরস গিল্ড অব গ্রেট ব্রিটেন, ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল অব বাংলাদেশ অনুষ্ঠানগুলোতেও পুরস্কৃত হন।

তারেক মাসুদের স্ত্রী ক্যাথরিন মাসুদ একজন মার্কিন নাগরিক। এই দম্পতির বিংহাম পুত্রা মাসুদ নিশাদ নামে এক ছেলে রয়েছে। স্ত্রী ক্যাথরিন এবং তারেক মাসুদ মিলে ঢাকায় অডিওভিশন নামে একটি চলচ্চিত্র নির্মাতা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছিলেন। চলচ্চিত্র নির্মাণ ছাড়াও লোকসংগীত ও লোকজ ধারায় বেশ আগ্রহ ছিল তারেক মাসুদের।

এই নির্মাতার মৃত্যুর পর ২০১২ সালে বিভিন্ন সময়ে লেখা তার চলচ্চিত্র সম্পর্কিত প্রবন্ধগুলোকে একত্র করে একটি বই প্রকাশিত হয়। যেটির নাম দেওয়া হয় ‘চলচ্চিত্রযাত্রা’। বইটিতে ভূমিকা লিখেছেন তার স্ত্রী ক্যাথরিন মাসুদ।

লেখক হওয়ার একটা টান সবসময়ই তারেক মাসুদের মাঝে ছিল। তাইতো তিনি বলেছিলেন, ‘চলচ্চিত্রকার না হলে লেখক হওয়ার চেষ্টা করতাম।’