আল্লামা ইবনুল কাইয়িম (রহ.) তাঁর ‘রুহ’ নামক গ্রন্থে মানবাত্মার নানা দিক নিয়ে আলোচনা করেছেন।
আল্লামা ইবনুল কাইয়িম (রহ.) তাঁর মতের পক্ষে পবিত্র কোরআনের একটি আয়াত পেশ করেন।
প্রশ্ন হলো স্বপ্নযোগে যখন জীবিত ও মৃত ব্যক্তির আত্মার সাক্ষাৎ হয়, তখন তা পরস্পর থেকে কিভাবে পৃথক থাকে এবং একে অপরকে চিনতে পারে? উত্তরে প্রাজ্ঞ আলেমরা বলেন, আল্লাহ মানবদেহের যেমন অবয়ব দিয়েছেন, তেমনি আত্মারও অবয়ব দিয়েছেন। তবে পৃথিবীতে দৃশ্যমান নয়। মুশাহাদার জগতে (যেখানে অদৃশ্য বস্তু দৃশ্যমান হবে) তা দৃশ্যমান হবে। রুহের জগতে আত্মার নিজস্ব অবয়বের কারণে পরস্পরকে চিনতে পারবে।
আর আত্মার অবয়ব গঠনের ব্যাপারে আল্লাহ বলেন, ‘শপথ (নফস) সত্তার এবং তাঁর, যিনি তা সুঠাম করেছেন।’ (সুরা : শামস, আয়াত : ৭)
স্বপ্নযোগে পাওয়া নির্দেশনার বিধান
আল্লামা ইবনুল কাইয়িম (রহ.) বলেন, স্বপ্নযোগে মৃত ও জীবিত ব্যক্তির আত্মার সাক্ষাৎ হওয়ার আরেকটি প্রমাণ হলো, মৃত ব্যক্তিকে প্রশ্ন করা এবং তাঁর প্রদত্ত উত্তর আল্লাহর ইচ্ছার অনুকূল হওয়া। যেমন ভালো কাজের উপদেশ দেওয়া, সত্য-মিথ্যার পার্থক্য নির্ণয় করা ইত্যাদি। তারা এটা করতে পারে আল্লাহর কাছে উচ্চস্তরে পৌঁছানোর কারণে; অথবা আল্লাহ হয়তো মৃত আত্মার মাধ্যমে ঘনিষ্ঠজনদের এই নির্দেশনা দানের ইচ্ছা করেছেন।
ফকিহ আলেমরা মৃত ব্যক্তির আত্মাকে জীবিত ব্যক্তির আত্মার প্রশ্ন করার বিষয়টি অস্বীকার করেননি। তাঁরা বলেন, এটা সংঘটিত হওয়া সম্ভব। সুতরাং কেউ তা দাবি করলে অস্বীকার করা হবে না। এমন স্বপ্নের ওপর আমলও করা যায়। তবে তার মর্যাদা সাধারণ উপদেশের চেয়ে বেশি নয়। স্বপ্ন যদি শরিয়তের বিধি-বিধানের বিপরীত হয় তা প্রত্যাখ্যান করতে হবে।
স্বপ্নযোগে পাওয়া মৃত ব্যক্তির নির্দেশনার ব্যাপারে তাঁরা আরো বলেন, এমন নির্দেশনাকে কখনোই ভুলত্রুটির ঊর্ধ্বে ভাবা উচিত নয়, চাই মৃত ব্যক্তি যত বড় বুজুর্গই হোন। আর স্বপ্নযোগে পাওয়া নির্দেশনা শুধু তার জন্যই প্রযোজ্য হবে যে তা স্বপ্নে দেখেছে, অন্য কোনো ব্যক্তির ওপর তা চাপিয়ে দেওয়া যাবে না।
সত্য স্বপ্ন বান্দা যেভাবে লাভ করে
আল্লামা ইবনুল কাইয়িম (রহ.) বলেন, স্বপ্ন তিন প্রকার : ক. যা মানুষের খেয়াল মাত্র, খ. যা আল্লাহর পক্ষ থেকে, গ. যা শয়তানের পক্ষ থেকে। সত্য স্বপ্ন আল্লাহর পক্ষ থেকে বান্দার অন্তরে ঢেলে দেওয়া হয় বা স্বপ্নের জগতে আল্লাহর অধিক নৈকট্যে পৌঁছার কারণে অথবা জান্নাত ও জান্নাতিদের সান্নিধ্যের কারণে বান্দার অন্তরে তা সৃষ্টি হয়। এ জন্য কখনো কখনো ব্যক্তিকে ভালো কাজের সুসংবাদ দেওয়া হয়, মন্দ কাজের ব্যাপারে সতর্ক করা হয়। আবার সত্য স্বপ্নের মাধ্যমে বহু মানুষ তাওবা করে সৎ হয়েছে, বহু কল্যাণের দুয়ার খুলেছে। যেমন নবীজি (সা.)-এর দাদা স্বপ্নযোগে হারিয়ে যাওয়া জমজম কূপ ও তার ভেতরে থাকা গুপ্তধনের সন্ধান পেয়েছিলেন।
আত্মার কি মৃত্যু হয়
মানুষের আত্মার মৃত্যু হয় কি না, তা নিয়ে ওলামায়ে কিরামের ভেতর মতবিরোধ রয়েছে। একদল আলেম বলেন, দেহের মতো আত্মারও মৃত্যুও হয়। কেননা পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘প্রতিটি সত্তা মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করবে।’ (সুরা : আলে ইমরান, আয়াত : ১৮৫)
অন্যত্র ইরশাদ হয়েছে, ‘আল্লাহর সত্তা ছাড়া সব কিছুই ধ্বংসশীল।’ (সুরা : কাসাস, আয়াত : ৮৮)
একদল আলেমের মতে, শুধু মানুষের দেহের মৃত্যু হয়। তার আত্মার মৃত্যু হয় না। তাঁরা সেসব হাদিস দ্বারা দলিল পেশ করেন, যার দ্বারা বোঝা যায় আত্মার মৃত্যু হয় না, বরং তা রুহের জগতে বিচরণ করতে থাকে। যেমন নবী (সা.) অবিশ্বাসীদের মৃত্যু প্রসঙ্গে বলেন, তার রুহকে তার শরীরে ফিরিয়ে আনা হয় এবং দুজন ফেরেশতা এসে তাকে বসিয়ে প্রশ্ন করেন, তোমার রব কে? সে উত্তর দেয়, হায়! আমি কিছুই জানি না। তারপর তাঁরা প্রশ্ন করেন, তোমার দ্বিন কী? সে বলে, হায়! আমি কিছুই জানি না। তাঁরা প্রশ্ন করেন, এই লোকটি তোমাদের মধ্যে প্রেরিত হয়েছিলেন, তিনি কে? সে বলে, হায়! আমি তো জানি না। তখন আকাশের দিক থেকে একজন ঘোষণাকারী ঘোষণা করেন, সে মিথ্যা বলেছে। সুতরাং তার জন্য জাহান্নামের একটি বিছানা এনে বিছিয়ে দাও এবং তাকে জাহান্নামের পোশাক পরিয়ে দাও, আর তার জন্য জাহান্নামের দিকে একটি দরজা খুলে দাও। তিনি বলেন, অতঃপর তার দিকে জাহান্নামের উত্তপ্ত বাতাস আসতে থাকে। (সুনানে আবি দাউদ, হাদিস : ৪৭৫৩)
আল্লামা ইবনুল কাইয়িম (রহ.) দ্বিতীয় মতকে প্রাধান্য দিয়েছেন। তিনি বলেন, উল্লিখিত আয়াতদ্বয়ে মৃত্যু দ্বারা দেহ থেকে আত্মার বিচ্ছেদ বোঝানো হয়েছে।
আল্লাহ সবাইকে সঠিক জ্ঞান দান করুন। আমিন।