যেসব কারণে নামাজে মনোযোগ বিনষ্ট হয়

একাগ্রতাহীন ইবাদত মূল্যহীন। অথচ কমবেশি আমরা সবাই নামাজের মধ্যে মনকে স্থির রাখতে পারি না। বলে থাকি, নামাজে দাঁড়ালেই নানা চিন্তা এসে হাজির হয়; এমনকি তখন নামাজের রাকাতসংখ্যা ভুলে যাওয়াসহ অনেক সমস্যা দেখা দেয়।

শয়তান সব সময় আমাদের ইবাদতে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে রাখে, তাই এমন হওয়া অস্বাভাবিক নয়।শয়তান মানুষকে পাপ ও পতনের দিকে নিয়ে যায়। মহান আল্লাহর সতর্কবাণী—‘বলো, আমি আশ্রয় চাচ্ছি…আত্মগোপনকারী কুমন্ত্রণাদাতার অনিষ্ট থেকে, যে মানুষকে কুমন্ত্রণা দেয় মানুষের অন্তরে, জিনের মধ্য থেকে অথবা মানুষের মধ্যে থেকেও।’ (সুরা : নাস, আয়াত : ১-৬)

শয়তানের শক্তি এমন যে সে সম্পর্কে সতর্ক করে প্রিয় নবী (সা.) বলেন, ‘শয়তান মানবদেহে রক্ত প্রবাহের ন্যায় শিরা-উপশিরায় চলাচল করে…।’ (বুখারি ও মুসলিম)

শয়তান আমাদের নামাজে বিঘ্ন ঘটায়।

এ প্রসঙ্গে প্রিয় নবী (সা.) বলেন, ‘যখন আজান দেওয়া হয়, শয়তান বায়ু নিঃসরণ করতে করতে পিছু হটে…আবার ইকামত শেষ হলে শয়তান মানুষ ও তার অন্তরের মধ্যে অবস্থান করে…শেষ পর্যন্ত লোকটি ভুলে যায় সে তিন রাকাত, না চার রাকাত পড়ল…!’ (বুখারি ও মুসলিম)তাই ইবাদতে নিবেদিত হওয়ার শিক্ষা দিয়ে মহান আল্লাহ বলেন, ‘বলো, আমার নামাজ, আমার কোরবানি, আমার জীবন-মরণ—সব কিছু বিশ্বপ্রভু আল্লাহর জন্য।’ (সুরা : আনআম, আয়াত : ১৬৫)

ইবাদতে একাগ্রতা ও সর্বাত্মক  নিবেদনের চেতনা শিক্ষা দিয়ে প্রিয় নবী (সা.) বলেন, ‘এভাবে আল্লাহর ইবাদত করো, যেন তুমি তাঁকে দেখতে পাচ্ছ অথবা নিশ্চিত ধারণা করো তিনিই তোমাকে দেখছেন।’ (ভাবার্থ : বুখারি)

একাগ্রচিত্তকে ইসলামের পরিভাষায় ‘খুশু’ বলে। খুশুর আভিধানিক অর্থ দীনতার সঙ্গে অবনত হওয়া, ধীরস্থির হওয়া।

আর আল্লামা ইবনু কাসির (রহ.)-এর ভাষায়, খুশু অর্থ স্থিরতা, ধীরতা, গাম্ভীর্য, বিনয় ও নম্রতা। মহান আল্লাহর নির্দেশ—‘তোমরা আল্লাহর সমীপে দাঁড়াও বিনয়াবনত চিত্তে।’ (সুরা : বাকারাহ, আয়াত : ২৩৮)নামাজে একাগ্রতার তাৎপর্য প্রসঙ্গে প্রিয় নবী (সা.) বলেন, ‘যে যথাযথভাবে অজু করে, তারপর (একাগ্রচিত্তে) মন ও শরীর একত্র করে (ওয়াস্ওয়াসামুক্ত) দুই রাকাত নামাজ আদায় করে; তার জন্য জান্নাত ওয়াজিব হয়ে যায়।’ (বুখারি)

ইমাম ইবনু তাইমিয়া (রহ.) নামাজে একাগ্রতা সৃষ্টির জন্য দুটি উপায় অবলম্বনের পরামর্শ দিয়েছেন—

(ক) একাগ্রতা অর্জনের উপায় শক্তিশালীকরণ।

(খ) একাগ্রতাবিরোধী তৎপরতা থেকে দূরে থাকা।

কাজেই নামাজে একাগ্রতার জন্য নিম্নোক্ত উপায়গুলো অবলম্বন করা বিশেষভাবে উপকারী। যথা—(ক) নামাজের জন্য ভালোভাবে প্রস্তুতি নেওয়া।

(খ) নামাজে তাড়াহুড়া না করা, বরং ধীর-স্থির থাকা।

(গ) মৃত্যুর কথা স্মরণে রাখা।

(ঘ) নামাজে পঠিত আয়াত ও দোয়ার তাৎপর্য অনুধাবণ করা এবং অর্থ বোঝার চেষ্টা করা।

(ঙ) থেমে থেমে ও মধুর স্বরে তিলাওয়াত করা।

(চ) মনে মনে ধারণা পোষণ করা যে মহান আল্লাহ বান্দার ডাকে সাড়া দিচ্ছেন।

(ছ) নামাজরত অবস্থায় সিজদার স্থানের প্রতি দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখা।

(জ) নামাজে তিলাওয়াতের মধ্যে সিজদার আয়াত এলে সিজদা করা।

(ঞ) বিভিন্ন সময়, সম্ভব হলে বিভিন্ন নামাজে ভিন্ন ভিন্ন সুরা ও দোয়া পড়া।

(ট) শয়তানের কুমন্ত্রণা থেকে আল্লাহর আশ্রয় প্রার্থনা করা।

(ঠ) নামাজে একাগ্রতার গুরুত্ব জানা, বোঝা ও অনুধাবণ করা।

(ড) নামাজের পরে প্রামাণ্যসূত্রে বর্ণিত, পঠিতব্য বিভিন্ন দোয়া পড়া ও আমল করা।

(ণ) সব সময় বেশি বেশি কোরআন তিলাওয়াত করা, চর্চা করা।

বস্তুত নামাজের মাধ্যমেই মুমিন হৃদয়ে আল্লাহর প্রেম ও ঈমানি চেতনা জেগে ওঠে। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের উচ্চারণ—

‘মসজিদে ওই শোনরে আজান, চল নামাজে চল।

দুঃখে পাবি সান্ত্বনা তুই বক্ষে পাবি বল।

ওরে চল নামাজে চল।।

তুই হাজার কাজের অসিলাতে নামাজ করিস কাজা,

খাজানা তারি দিলি না, যে দ্বিন দুনিয়ার রাজা।

তারে পাঁচবার তুই করবি মনে তাতেও এত ছল।

ওরে চল নামাজে চল।’