মানব মন পাপপ্রবণ। মহান আল্লাহ ইরশাদ করেন, ‘…মানুষের মন অবশ্যই মন্দ কর্মপ্রবণ। কিন্তু সে নয়, তার প্রতি আমার রব দয়া করেন।’ (সুরা : ইউসুফ, আয়াত : ৫৩)
কিন্তু মন্দ কাজে ধাবিত এই মনকে শাস্তি না দিলে সে আশকারা পেয়ে যায়।তাই মনের মুহাসাবা বা আত্মপর্যালোচনা দরকার।
মুমিন যখন তার মনের হিসাব নেবে তখন দেখতে পাবে, মন কোনো না কোনো পাপ করেছে কিংবা ইবাদতমূলক কাজে শিথিলতা দেখিয়েছে। ফলে যা ছুটে গেছে তার প্রতিকারের জন্য মনকে শাস্তি দেওয়া তার কর্তব্য, যাতে ভবিষ্যতে এমনটা আর না ঘটে এবং মন কর্মতৎপর হয়।
মনকে কর্মতৎপর না রাখলে, হিসাব না নিলে এবং শাস্তি না দিলে মন সোজা থাকবে না।আশ্চর্য হলো, মানুষ কখনো কখনো চারিত্রিক দোষ কিংবা অন্য কোনো ত্রুটি-বিচ্যুতির কারণে নিজ পরিবারের সদস্য ও চাকর-বাকরদের শাস্তি দেয়, কিন্তু সে নিজে কোনো মন্দ কাজ করলে নিজেকে শাস্তি দেয় না। অথচ নিজেকে শাস্তি দেওয়াই উত্তম ও সুবিবেচনাপ্রসূত কাজ।
কখনো কখনো শাস্তির নামে উপেক্ষা ও ছাড় দিতে দেখা যায়। তবে নিজেকে শাস্তি দানের মূল লক্ষ্য নিজের মনকে আল্লাহর অনুগত রাখা এবং আগে করা হয়নি এমন সব ভালো কাজে নিজেকে নিয়োজিত করা।মনকে শাস্তি দানের পূর্বসূরিদের পদ্ধতি এমনই ছিল। এখানে তার কিছু নমুনা তুলে ধরা হলো—
ওমর ইবনুল খাত্তাব (রা.)-এর একবার আসরের সালাতের জামাত ছুটে গিয়েছিল। সে জন্য নিজেকে শাস্তিস্বরূপ তিনি এক খণ্ড জমি দান করে দেন। যার মূল্য ছিল দুই লাখ দিরহাম! (উমদাতুল কারি : ১২/১৭৩)
ইবনে ওমর (রা.)-এর কোনো সালাতের জামাাত ছুটে গেলে সেদিন তিনি পুরো রাত ইবাদত-বন্দেগিতে কাটাতেন! (ইহইয়াউ উলুমিদ্দিন : ৪/৪০৮)
একবার ওমর বিন আবদুল আজিজ (রহ.)-এর মাগরিবের সালাত আদায়ে এতটুকু বিলম্ব হয়েছিল যে সন্ধ্যাকাশে দুটি তারা নজরে আসছিল। তাতেই তিনি দুজন গোলাম আজাদ করে দিয়েছিলেন, যদিও মাগরিবের সালাতের ওয়াক্ত তখনো শেষ হয়নি! (ইবনে তায়মিয়া, শারহুল উমদাহ : ৪/২১০)
ইবনে আবি রবিআ (রহ.)-এর একবার ফজরের দুই রাকাত সুন্নত ছুটে গিয়েছিল।সেই দুঃখে তিনি একটি গোলাম আজাদ করে দিয়েছিলেন। (ইহইয়াউ উলুমিদ্দিন : ৪/৪০৮)
ইবনে আউন (রহ.)-কে তাঁর মা ডাক দিলে তিনি তাঁর ডাকে সাড়া দিয়েছিলেন। কিন্তু তাতে তাঁর কণ্ঠস্বর মায়ের কণ্ঠস্বর থেকে একটু উঁচু হয়ে গিয়েছিল। তাতেই তিনি দুজন গোলাম আজাদ করে দিয়েছিলেন! (হিলয়াতুল আওলিয়া : ৩/৩৯)
সুতরাং পূর্বসূরিরা নিজেকে শাস্তিদান বলতে মনকে নেক কাজে লাগানো এবং জিকির-আজকার ও দোয়া-অজিফায় মশগুল রাখা বুঝতেন। যেসব হাদিসে অল্প আমলে অনেক সওয়াবের উল্লেখ আছে সেগুলো নিয়ে গভীর অনুধাবন ও আমল করাও নফসকে শাস্তিদানে সহায়ক। আবদুল্লাহ বিন আমর বিন আস (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি (রাত জেগে সালাতে) ১০টি আয়াত পড়বে তার নাম গাফিল-অলসদের তালিকায় লেখা হবে না। আর যে (রাত জেগে সালাতে) ১০০ আয়াত পড়বে তার নাম ‘কানিতুন’ বা অনুগতদের তালিকায় লেখা হবে। আর যে (রাত জেগে সালাতে) এক হাজার আয়াত পড়বে তাকে ‘মুকান্তারুন’ বা প্রাচুর্যময়দের তালিকাভুক্ত করা হবে।’ (আবু দাউদ, হাদিস : ১৩৯৮)
কোনো মুসলমান এই হাদিস এবং এ ধরনের অন্য হাদিস মনোযোগসহ লক্ষ করলে তার জীবনের অনেক মুহূর্ত যে অহেতুক ব্যয় হয়ে গেছে এবং শুধুই নিজ দেহকে আরাম দেওয়ার জন্য যে কত সওয়াব থেকে সে বঞ্চিত হয়েছে তা ভেবে সে অনুশোচনায় কাতর হয়ে পড়বে। এবং এ ধরনের অল্প আমল কিন্তু বেশি সওয়াবময় কাজে নিজেকে নিয়োজিত করে তুলবে।
অতীতে মুসলিম মনীষীরা আল্লাহর পথে কী পরিমাণ সাধনা ও ত্যাগ স্বীকার করেছেন আজকের যুগে তাঁদের মতো সাধক মানুষের উদাহরণ মেলা ভার। আবু দারদা (রা.) বলেন, ‘তিনটি জিনিস না থাকলে আমি এক দিনের জন্যও বেঁচে থাকতে পছন্দ করতাম না। এক. দুপুর রোদে আল্লাহর জন্য পিপাসিত হওয়া (আল্লাহর দ্বিন প্রচার ও জিহাদের উদ্দেশ্যে মরুভূমির উত্তাপ সহ্য করা এবং তৃষ্ণার্ত হওয়ার মজা)। দুই. মধ্যরাতে সিজদাবনত হওয়া (তাহাজ্জুদ সালাত আদায় ও তাতে কোরআন পড়ার মজা)। তিন. সেসব লোকের সঙ্গে ওঠাবসার সুযোগ, যারা উত্কৃষ্ট ফল বেছে বেছে সংগ্রহের মতো ভালো ভালো কথা সংগ্রহ করে। (ইবনুল মুবারক, আজ-জুহদ, পৃষ্ঠা-২৭৭)
তাবেঈ মাসরুক (রহ.)-এর স্ত্রী বলেন, মাসরুক এত দীর্ঘ সময় ধরে সালাত আদায় করতেন যে দাঁড়িয়ে থাকার দরুন বেশির ভাগ সময় তাঁর পা দুটো ফুলে থাকত। আল্লাহর কসম! তাঁর প্রতি অনুকম্পাবশত আমি অনেক সময় তাঁর পেছনে বসে কাঁদতাম। (ইবনুল মুবারক, আজ-জুহদ, পৃষ্ঠা-৯৫)
মহান আল্লাহ আমাদের অন্তরকে পরিশুদ্ধ করে দিন।