ইসলামের সূচনাকাল থেকেই ওয়াজ-নসিহতের পবিত্র ধারা অদ্যাবধি চলে আসছে। ওয়াজ-নসিহত কখনো জাঁকজমকপূর্ণ মাহফিলে, কখনো একান্ত হালাক্বায়, কখনো খুসুসীভাবে ভিন্ন ভিন্ন উপলক্ষ্য ও ভিন্ন ভিন্ন শিরোনামে হয়ে থাকে। ওয়াজ -মাহফিল দিনমজুর থেকে শুরু করে বিভিন্ন পেশার মানুষের জন্য সংক্ষিপ্ত পরিসরের একটি পাঠশালা। হাকীমুল উম্মত আশরাফ আলী থানভী (রহ.) লেখেন;যারা বৃদ্ব হয়ে গিয়েছে, তাদের দ্বীন শিখার অন্যতম মাধ্যম হলো ওয়াজ শোনা। ওয়াজ অর্থ বক্তৃতা, উপদেশ, নসিহত। যিনি ওয়াজ করেন তাকে ওয়ায়েজ বা বক্তা বলা হয়। আদর্শ সমাজ বিনির্মাণে ওয়াজ-নসিহতের গুরুত্ব অপরিসীম। ওয়াজ-নসিহত দ্বীন প্রচারের অপার মাধম। মানব জাতির ইমান,আমল ও আখলাক পরিশুদ্ধ করনেও এর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে।
বান্দাদের উদ্দেশ্যে ওয়াজতো খোদ আল্লাহ তাআলাও করেছেন। আল্লাহ তাআলা কুরআনে পাকে বলেন : নিশ্চয়ই আল্লাহ ইনসাফ, দয়া এবং আত্মীয়-স্বজনকে (তাদের হক) প্রদানের হুকুম দেন আর অশ্লীলতা, মন্দ কাজ ও জুলুম করতে নিষেধ করেন। তিনি তোমাদেরকে উপদেশ দেন, যাতে তোমরা উপদেশ গ্রহণ কর। (আন নাহ্ল : ৯০)। উম্মতের উদ্দেশ্যে ওয়াজ নসিহত করা নবী-রাসূলদেরও মৌলিক দায়িত্ব ছিল। আর আমাদের নবী (সা.)-এর উত্তরাধিকারী হলেন উলামায়ে কেরাম। তাই কিয়ামত পর্যন্ত এটা অব্যাহত রাখা তাদের দায়িত্ব। এই উম্মতের শ্রেষ্ঠত্ব এ কারণে যে, তারা ভালো কাজের আদেশ দান কারী ও অসৎ কাজ হতে নিষেধকারী। আল্লাহ তাআলা বলেন : তোমরাই শ্রেষ্ঠ উম্মত, মানবজাতির জন্যে তোমাদের আবির্ভাব হয়েছে; তোমরা সৎকাজের নির্দেশ দান কর, অসৎকাজে নিষেধ কর আর আল্লাহর ওপর বিশ্বাস কর। কিতাবীগণ যদি ঈমান আনত তবে তাদের জন্যে ভাল হত। তাদের মধ্যে কিছুসংখ্যক মু’মিন আছে; কিন্তু তাদের অধিকাংশ সত্যত্যাগী। (আলে ইমরান : ১১০)।
ওয়াজ করার পূর্ব শর্ত হলো ওয়ায়েজের পর্যাপ্ত ইলমি যোগ্যতা থাকা ও নবী (সা.) এর আদর্শে আদর্শবান হওয়া। আলেমগণ ওয়ায়েজের প্রাথমিক যেসব অপরিহার্য গুণের কথা উল্লেখ করেছেন, তা হলো : এক. ওয়ায়েজ প্রাপ্তবয়স্ক ও মানসিকভাবে সুস্থ হতে হবে। দুই. ন্যায়পরায়ণ হতে হবে। তিন. হাদিসের অর্থ, ব্যাখ্যা ও হাদিস শাস্ত্রের পর্যাপ্ত জ্ঞান থাকতে হবে। চার. কোরআনের তাফসির জানতে হবে, কোরআনের জটিল আয়াতগুলো সম্পর্কে ধারণা থাকতে হবে এবং পূর্বসূরি তাফসিরকারদের তাফসির সম্পর্কে জ্ঞান থাকতে হবে। (আল-মাওসুআতুল ফিকহিয়্যাহ : ৪৪/৮১)।
ওয়াজ মাহফিলে কয়েকটি বিষয়ে সতর্কতা একান্ত কাম্য। ১. মুখলিস বক্তা নির্বাচন করা। বেআমল চুক্তিবাদী বক্তাকে দাওয়াত না দেওয়া। ২. বিষয়বস্তু নির্ধারিত থাকা। ওয়াজ হতে হবে ইসলামের কোনো সুনির্দিষ্ট ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে। ৩. সভা স্থলের বাহিরে মাইক ব্যবহার না করা। ৪. ওয়াজ বানোয়াট কিসসা-কাহিনী থেকে মুক্ত হওয়া। ৫.ওয়াজ মাহফিলের ব্যবস্থাপনায় মিতব্যয়ী হওয়া। ৬. মাহফিল গভীর রাত পর্যন্ত না হওয়া; গভীর রাত পর্যন্ত ওয়াজ হলে সাধারণ মানুষের ঘুমে ব্যাঘাত হওয়াসহ নানা অসুবিধা হয়, এবং পরদিন ফজরের নামাজ কাযা হওয়ার আশংকা থাকে। আমাদের সমাজে কিছু মানুষকে বলতে শোনা যায় এত ওয়াজ মাহফিল হচ্ছে মানুষ তো হেদায়েত হচ্ছে না । আসলে তারা জানেই না হেদায়েতের মালিক আল্লাহ! তিনি যাকে ইচ্ছা হেদায়েত দেবেন। আলেমদের কাজ হলো- হক-বাতিল, হালাল-হারামের কথা বলে যাওয়া।
তবে ওয়াজকারীদের ওয়াজ দ্বারা উদ্দেশ্য যেন হয় শ্রোতাদেরকে দুনিয়া বিমুখ করা এবং নিজেও দুনিয়া বিমুখ হওয়া। আর ওয়ায-নসীহতের মূল ভিত্তি হতে হবে কুরআন ও সুন্নাহ। রাসূল (সা.) বলেছেন, সর্বশ্রেষ্ঠ কথা হচ্ছে আল্লাহর কিতাব এবং সর্বশ্রেষ্ঠ হিদায়াত হচ্ছে মুহাম্মাদ (সা.) এর হিদায়াত। (সহীহ মুসলিম, ৮৬৭)। ওয়াজ মাহফিলের অন্যতম উপকারিতা হলো এর দ্বারা কম বেশি সবাই সওয়াবের ভাগীদার হয়। মাহফিলে আমলের কথা শুনে কেউ যদি একটি আমল করে, যে আমল করল সে তো সওয়াব পাবে, যিনি এই আমলের কথা বললেন তিনিও সওয়াব পাবেন, যারা মাহফিলের আয়োজন করেছেন তারাও সওয়াবের ভাগীদার হবেন।