ইসলাম এক শান্তিপূর্ণ ধর্ম। ইসলাম ধর্মের প্রতিটি নির্দেশ ও আমলের পেছনে যেমন রয়েছে আধ্যাত্মিকতা, ঠিক এর বিপরীতে রয়েছে বিজ্ঞানময় ব্যাখ্যা। ইসলামে যেসব বিধিবিধান সরাসরি মানুষকে সংযত, আত্মশুদ্ধি ও আধ্যাত্মিক চেতনা ও প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ করে, মাহে রমজানের সিয়াম সাধনা তথা রোজা তার মধ্যে অন্যতম। রমজান পালন আধ্যাত্মিকতা, ব্যক্তি ও সম্প্রদায়ের আত্ম-উন্মেষের আলোকবর্তিকা হিসাবে কাজ করে। সংযমের মাস রমজানে বান্দা নির্বিঘ্নে আল্লাহর ইবাদত-বন্দেগি করে থাকেন, দান-সদকা করেন, জাকাত আদায় করেন, দুস্থ-অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ান, তাদের সেবায় এগিয়ে আসেন। অথচ রমজান এলেই বাজারে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির ফলে বান্দার সেবা ও জনকল্যাণমূলক কাজ অনেকটাই চাপা পড়ে যায়। বিশ্বের অন্যান্য মুসলিম রাষ্ট্রগুলোতে দেখা যায়, ব্যবসায়ীরা ১১ মাস ব্যবসা করলেও রমজান মাসে মানুষের সেবা করে পক্ষান্তরে আমাদের দেশে দেখা যায় পুরো ভিন্নচিত্র। ১১ মাস দাম যেমন থাকে রমজানে তার দ্বিগুণ বা তিনগুণ হয়ে যায়।
রমজান মাসে নিত্যপণ্যের চাহিদা বেড়ে যাওয়ার ফলে এক শ্রেণির মজুতদার, মুনাফাখোর, অসাধু ব্যবসায়ী অধিক মুনাফা লাভের আশায় পণ্য মজুদ রেখে কৃত্রিম সংকট তৈরি করে বাজারমূল্য আরও বাড়িয়ে দেয়। সংযমের মাসে তারা হয়ে ওঠে অসংযমী। এ জন্যই ইসলাম মানুষের অযাচিত হস্তক্ষেপ থেকে বাজার ব্যবস্থাকে রক্ষার জন্য মজুতদারি, অত্যধিক মুনাফাখোরি ও প্রতারণা নিষিদ্ধ করেছে।
বর্তমানে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির দাম আকাশছোঁয়া। সাধারণত সারা বিশ্বে খাদ্যের অভাবে জিনিসপত্রের দাম বাড়ে না, দাম বাড়ে অসৎ ও অসাধু ব্যবসায়ী ও মজুতদারদের পণ্য মজুদের কারণে। মজুতদারির ফলে অর্থনৈতিক ভারসাম্য ক্ষুণ্ণ হয় ও বাজারে পণ্যের মূল্য অস্বাভাবিক হারে বৃদ্ধি পায়।
স্বাভাবিকভাবে মুনাফা লাভের আশায় মজুতদারি করা অভিশাপ বা গুনাহের কাজ। মূলত একদল মধ্যস্বত্বভোগী ব্যবসায়ী অবৈধভাবে মুনাফা লাভের আশায় এ ঘৃণিত কাজটি করে থাকে। হানাফি মাযহাবের মতে এটি মাকরুহে তাহিরমি আর অন্যান্য মাযহাবের মতে সম্পূর্ণরূপে হারাম।
অধিক মুনাফার আশায় পণ্য মজুত করাকে ইসলাম অবৈধ ঘোষণা করেছে। হানাফি মাজহাবে, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য মজুত করা মাকরুহ তাহরিমি (হারাম পর্যায়ের)। অন্যান্য মাজহাবে এটি হারাম। কেননা এর ফলে সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে যায় এবং বহু মানুষ দুর্ভোগে পতিত হয়।
রাসূল (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি ৪০ দিন খাদ্যদ্রব্য মূল্যবৃদ্ধির উদ্দেশ্যে গুদামজাত করে রাখবে সে আল্লাহর হেফাজত থেকে বেরিয়ে যাবে। আর আল্লাহ তার ওপর থেকে তাঁর দায়িত্ব তুলে নেবেন।’ (মুসনাদে আহমাদ, হাদিস নং-৪৮৮০; মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বা, হাদিস নং-২০৭৬৯)।
সাধারণ মানুষদের জিম্মি করে সম্পদশালী হয়ে গেলেও কোনো লাভ নেই। এ সম্পদে তার কোনো বরকত হবে না। বরং দুনিয়াতেই এ সম্পদ তার জন্য অভিশাপ হবে। রাসূল (সা.) বলেছেন, ‘কেউ যদি খাদ্য গুদামজাত করে কৃত্রিম সংকট তৈরি করে, আল্লাহতায়ালা তাকে দুরারোগ্য ব্যাধি ও দারিদ্র্য দ্বারা শাস্তি দেবেন।’ (ইবনে মাজাহ, হাদিস নং-২১৫৫)।
মজুতদারি না করে সৎ নিয়তে ব্যবসা করা ইবাদত। এমন ব্যক্তির উপার্জনে আল্লাহতায়ালা বরকত দান করেন। তাকে অপ্রত্যাশিত রিজিক দেন। রাসূল (সা.) বলেছেন, ‘খাঁটি ব্যবসায়ী রিজিকপ্রাপ্ত হয় আর পণ্য মজুতকারী অভিশপ্ত হয়।’ (ইবনে মাজাহ, হাদিস নং-২১৫৩)।
নবি (সা.) মজুদদার ও কালোবাজারিদের অভিশপ্ত উল্লেখ করে বলেন, ‘যে ব্যক্তি আমদানি করবে সে রিজিকপ্রাপ্ত হবে। আর যে গুদামজাত করবে, সে অভিশপ্ত হবে।’ (ইবনে মাজাহ্ : ২১৪৪)
অবৈধভাবে অর্থোপার্জনের উদ্দেশ্যে দ্রব্যমূল্যের মূল্য বৃদ্ধি করাকে ইসলামে অত্যন্ত গর্হিত কাজ। এ জন্য তাদের শাস্তির কথা বলা হয়েছে। তা-ই নবি (সা.) বলেছেন, ‘কোনো ব্যক্তি মুসলমানদের লেনদেনে হস্তক্ষেপের মাধ্যমে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির কারণ ঘটালে কিয়ামতের দিন আল্লাহ্ তাআলা আগুনের ওপর তাকে বসিয়ে শাস্তি দেবেন।
মানুষের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনার জন্য মদিনায় রাসূল (সা.) ইসলামি বাজার প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। বনু কায়নুকার বাজারটির পরিচালনার দায়িত্ব তিনি নিজেই নিয়েছিলেন। এ বাজারটির বৈশিষ্ট্য ছিল-এখানে কোনো রকম ধোঁকা-প্রতারণা, ঠকবাজি, মাপে কম-বেশি করার বা পণ্যদ্রব্য মজুত অথবা গুদামজাত করে কৃত্রিম মূল্যবৃদ্ধি করে জনগণকে কষ্ট দেওয়ার সুযোগই ছিল না। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূল (সা.) একদিন এক বিক্রেতার খাদ্যের স্তূপের সামনে দিয়ে যাচ্ছিলেন, তখন তিনি তাঁর হাত ওই খাদ্যের স্তূপে প্রবেশ করান, এতে তাঁর হাত ভিজে গেল এবং অনুপযুক্ত খাদ্যের সন্ধান পেলেন। তখন রাসূল (সা.) বললেন, হে খাদ্য বিক্রেতা! এগুলো কী? তখন সে বলল, ইয়া রাসূলাল্লাহ! খাদ্যগুলো বৃষ্টিতে ভিজে গেছে। রাসূল (সা.) বললেন, তুমি এই ভিজা খাদ্যগুলো ওপরে রাখোনি কেন, যাতে সবাই তা দেখে নিতে পারে? যে ব্যক্তি কাউকে ধোঁকা দেবে সে আমার উম্মত নয়। (সহিহ মুসলিম, হাদিস নং-২৯৫; তিরমিযি, হাদিস নং-১৩১৫)।
এছাড়াও হজরত মুয়াজ ইবনে জাবাল (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে তিনি বলেন, ‘আমি নবি (সা.)-কে বলতে শুনেছি, ‘মজুতদার ব্যক্তি খুবই নিকৃষ্টতম ব্যক্তি। যদি জিনিসপত্রের দর হ্রাস পায়, তখন সে চিন্তিত হয়ে পড়ে। আর যদি দর বেড়ে যায়, তখন আনন্দিত হয়।’ (মিশকাত শরিফ : ২৭৭১)
মজুতদারি করা মানব সম্প্রদায়ের ওপর এমন একটি জুলুমকার্য, যার কারণে আল্লাহ্ তাআলা মজুতদারদের মহামারি ও দরিদ্রতায় নিক্ষেপ করেন। তা-ই নবি (সা.) মজুদদারদের প্রতি হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেছেন, ‘কেউ যদি মুসলমানদের থেকে নিজেদের খাদ্যশস্য আটকিয়ে রাখে (মজুতদারি করে), তবে আল্লাহ্ তা’আলা তার ওপর মহামারি ও দরিদ্রতা চাপিয়ে দেন।’ (আবু দাউদ : ৫৫, ইবনে মাজাহ : ২২৩৮)
আল্লাহতায়ালা ব্যবসাকে হালাল করে ঘোষণা করে বলেছেন, ‘তোমাদের জন্য ব্যবসাকে হালাল করা হয়েছে আর সুদকে করা হয়েছে হারাম।’ (সূরা বাকারা, আয়াত-২৭৫)। ব্যবসায়ীদের সুসংবাদ দিয়ে রাসূল (সা.) আরও বলেছেন, সত্যবাদী ও বিশ্বস্ত ব্যবসায়ীরা কিয়ামতের দিন নবি, সিদ্দিক ও শহিদদের সঙ্গে থাকবে। (তিরমিযি, হাদিস নং-১২০৯)।
অন্য হাদিসে এসেছে, রাসূল (সা.) বলেছেন, সত্যবাদী ব্যবসায়ী প্রথম জান্নাতে প্রবেশ করবে। (মুসান্নাফে ইবনে আবি শাইবা, হাদিস নং-৩৭১৯৬)। সুতরাং বোঝা গেল, ব্যবসা করাও একটি ইবাদত হবে যদি ব্যবসায়ী ভাইরা ব্যবসায় জুলুম, ধোঁকাবাজি, প্রতারণা, ঠকবাজি, মুনাফালাভের আশায় পণ্য গুদামজাত করে কৃত্রিম সংকট তৈরি করে মূল্যবৃদ্ধি, কালোবাজারি এবং হারাম জিনিসের ব্যবসা থেকে বেঁচে থাকেন। এটা সব সময়ের জন্য। আর রমজান যেহেতু ইবাদতের মাস, মানুষের সেবা করে জান্নাতের পথে এগিয়ে যাওয়ার মাস সেহেতু এ মাসে সেবার মাত্রা আরও বাড়িয়ে দিয়ে পণ্যসামগ্রীর দাম কমিয়ে দিলে আল্লাহর প্রিয় বান্দা হওয়ার পথে আরও এগিয়ে যাওয়া যাবে।