আল্লাহ তা’আলা বলেছেন : তোমাদের রব বলেন, আমাকে ডাকো, আমি তোমাদের ডাকে সাড়া দিবো। যেসব মানুষ গর্বের কারণে আমার দাসত্ব থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয় তারা অচিরেই লাঞ্ছিত ও অপমানিত হয়ে জাহান্নামে প্রবেশ করবে। (মু’মিন : ৬০)। আবু হুরায়রা রা: থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আরাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন : আল্লাহ তা’আলা বলেছেন, আমার বান্দার ধারণা অনুযায়ী আমি আছি। আর যখন সে আমাকে ডাকে আমি তার ডাকে সাড়া দেই। (মুসলিম : ৬৭২২)।
প্রকৃত অর্থে দু’আ বা আল্লাহকে ডাকা একটি বড় ধরণের ইবাদাত। দু’আ করলে আল্লাহ খুশি হন। আল্লাহকে ডাকা মানে এ কথার স্বীকৃতি দেয়া যে, তিনিই একমাত্র দাতা, তিনি দেখেন,শুনেন এবং তিনি অতি প্রাকৃতিক ক্ষমতার অধিকারী। আর এই কারণেই মানুষ তার আভ্যন্তরীন বিশ^াস ও অনুভূতি থেকেই আল্লাহকে ডাকে। নির্জনে শয়নে স্বপনে, যখন যেখানে প্রতিদিন প্রতি মহুর্তে সারা বেলায় তাঁর সাহায্য প্রার্থনা করে। এটি একটি বিশ^াসের ভিত্তিতেই হয়। সেই বিশ^াসটি হচ্ছে, সেই সত্তা সর্বত্র সর্বাবস্থায় তাকে দেখছেন। তার মনের কথা শুনছেন। তিনি এমন অসীম ক্ষমতার অধিকারী যে, প্রার্থনাকারী যেখানেই অবস্থান করুন না কেন তিনি তাকে সাহায্য করতে পারেন, তার বিপর্যস্ত ভাগ্যকে পুনরায় তৈরী করে দিতে পারেন। চরম অসহায়ত্বে তাকে সহায়তা দান করতে পারেন। সুরা আল ফাতিহায় আমরা প্রতিদিন প্রতিটি সালাতের প্রতিটি রাকা’আতে আমরা এই স্বীকৃতিই দিচ্ছি। আমরা বলে থাকি, আমরা একমাত্র তোমারই গোলামী করি আর তোমার কাছেই সাহায্য প্রার্থনা করি। (সুরা ফাতিহা : ৪)।
এই কথার মাধ্যমে আমরা এই স্বীকৃতি দেই যে, আমরা তোমার আনুগত্য করি এবং তোমার বন্দেগী ও দাসত্বও করি। আমরা এই সম্পর্ক একমাত্র তোমারই সাথে রাখি। অন্য কাউকে আমরা তোমার সাথে শরীক করি না। আর তুমি যেহেতু তুমি আমাদের মালিক ও মাবুদ, তাই সাহায্য প্রার্থনাও একমাত্র তোমার কাছেই করি। আমরা জানি তুমিই সমগ্র বিশ^জাহানের রব। সমস্ত শক্তি তোমারই হাতে কেন্দ্রীভূত। তুমি একাই যাবতীয় নিয়ামত ও অনুগ্রহের অধিকারী। তাই আমাদের অভাব প্রয়োজন পূরণের জন্য আমরা তোমারই দুয়ারে ধর্ণা দেই। তোমারই সামনে নিজেদের সোপর্দ করে দেই এবং তোমারই সাহায্যের ওপর নির্ভর করি। এ জন্য আমাদের এই আবেদন নিয়ে আমরা তোমার দুয়ারে হাজির হয়েছি। এটিই উবুদিয়াতের দাবীও বটে।
তাঁকে ডাকলে তিনি শুধু শুনেন, তা নয় বরং তিনি সে ব্যাপারেও সিদ্ধান্তও গ্রহণ করেন। সমুদ্রের অতল দেশের মাছের পেটের অন্ধকার কুটরী থেকে ইউনুস আ: আল্লাহকে ডাক দিয়েছিলেন। আল্লাহ তাঁর ডাক শুনেছেন এবং তাঁকে সেখান থেকে মুক্ত করে পৃথিবীর আলো-বাতাসে বিচরণ করার সুযোগ করে দিয়েছিলেন। আল্লাহ তা’আলাই একমাত্র ওহাব বা প্রকৃত দাতা। আমাদের সমাজ ব্যবস্থায় কিছু কিছু বিষয় মনকে দারুনভাবে পীড়া দেয়। এর মধ্যে একটি হলো, কিছু কিছু মূর্খ মানুষ সেই প্রকৃত দাতা আল্লাহ তা’আলাকে বাদ দিয়ে বিভিন্ন ব্যক্তি মানুষের দরবারে সন্তান কামনা করে থাকে। খুব ভাল করে মনে রাখা প্রয়োজন এ ধরনের আচরণ সুস্পষ্ট শিরকের অন্তর্ভূক্ত। সন্তান দেয়ার একমাত্র মালিক আল্লাহ রাব্বুল আলামীন। হযরত ইবরাহিম (আ.) শেষ বয়সে এসে আল্লাহর কাছে বলছিলেন : আমি আমার রবের দিকে যাচ্ছি, তিনিই আমাকে পথ দেখাবেন। হে পরোয়ারদিগার! আমাকে একটি সৎকর্মশীল পুত্র সন্তান দাও। (এ দু’আর জবাবে) আমি তাকে একটি ধৈর্যশীল পুত্রের সুসংবাদ দিলাম। (সা-ফ্ফাত : ১০০-১০১)।
কাজেই আমাদের প্রত্যেককে অক্ষম ও বানোয়াট খোদার দ্বারে দ্বারে মাথা ঠুকে মরার অজ্ঞতা ও মূর্খতার বেড়াজাল ছিঁড়ে বেরিয়ে আসতে হবে। একজন ব্যক্তি দুনিয়ায় জীবন যাপনের জন্য প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে, বস্তুগত বা অবস্তুগত যতকিছুর অভাব বা প্রয়োজনের সম্মুখীণ হয়, সবগুলোরই প্রকৃত দাতা একমাত্র আল্লাহ তা’আলা। দু’আ করার মাধ্যমে আরেকটি অনিবার্য স্বীকৃতি এই দাঁড়ায় যে, বান্দা আল্লাহ ছাড়া পৃথিবীর আর কোন শক্তির কাছে প্রার্থনা করে না। ক্ষমতা ও ইখতিয়ারের মালিক খালিছভাবে আল্লাহ তা’আলাকে প্রদান করে। আর তাই সে তাঁর শাহী দরবারে সাহায্যের জন্য দু’টো হাত প্রসারিত করে দেয়। তার মানে সে শিরক করে না, শিরক থেকে বেঁচে থাকে। সে এমন ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর কাছে দরখাস্ত পেশ করে না যারা নিজেরাই দীন ভিক্ষুকের মতো দু’টো হাত প্রসারিত করে মালিকের সাহায্যের জন্য বসে আছে।
দাস তার মালিকের কাছেই চাইবে এটাই বাস্তবতা আর এটাই প্রাকৃতিক নিয়ম ও দাসত্বের প্রধান দাবী ও বৈশিষ্ট। দাসদের আনুগত্যশীলতাও এর উপড় নির্ভরশীল। কারণ আল্লাহর এক নাম সাবুর অর্থাৎ মহা ধৈর্যশীল। বার বার চাইলেও তিনি বিরক্ত হন না। বরং উল্টো তিনি খুশি হন। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাহাবী আগার আল মুযানী রা. থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, আমার অন্তরে কখনো কখনো অলসতা দেখা দেয়, তাই আমি দৈনিক একশ’ বার আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করে থাকি। (মুসলিম : ৬৭৫১)।
আল্লাহর কাছে চাইবেন, তিনি দিবেন, যা চেয়েছেন হয়তো হুবহু সেটিই দিবেন বা তার চেয়ে ভালটা দিবেন, বা দিবেন না, আখিরাতের কল্যাণের জন্য রেখে দিবেন। তবে তাড়াহুড়ো করবেন না। দু’আ কবুলের অনেকগুলো মহুর্ত ও কার্যকারণের মধ্যে এটিও একটি বিষয় যে, তাড়াহুড়ো করবেন না তাহলে দু’আ কবুল হবে। সুতরাং প্রতি মহুর্তে তাঁকেই ডাকুন, নিজের সকল দু:খ-কষ্ট-বেদনা ও অভাব-অনটন তাঁর কাছেই পেশ করুন। দু’আর ফলে একদিকে আপনার ইবাদাত তথা দাসত্বের হক আদায় হবে অন্যদিকে আপনার চাহিদাও আল্লাহ তা’আলা পূরণ করে দিবেন।