সাবেকের সঙ্গে বর্তমান সঙ্গীর তুলনা, যে রোগে ভুগছেন অনেকে

বিয়ের সময় বেশি সময় কাটানোর সময় পাননি। তবে জানতেন, যে পুরুষটিকে বিয়ে করতে চলেছেন, তিনি পূর্ববিবাহিত। আর বিয়ের পরে ক্রমশ শুরু হলো তুলনা। পূর্ববর্তী স্ত্রীর সঙ্গে বর্তমান স্ত্রীর। এবার বর্তমান স্ত্রী আগের স্ত্রীকে প্রতিদ্বন্দ্বী ভাবতে শুরু করলেন। সেই ভাবনা এক সময়ে রূপ নিল মানষিক অসুখে।

‘রেবেকা সিনড্রম— এই নামেই অসুখটিকে চিহ্নিত করেন মনোবিদরা। অবশ্য এর একটি বিজ্ঞানসম্মত নামও রয়েছে— ‘রেট্রোঅ্যাক্টিভ জেলাসি’ এবং এই সমস্যা যে এক সময়ে শারীরিক আকার ধারণ করে, সে কথাও মনোবিদরা জানান।

শুধু বিবাহিত নারীদের ক্ষেত্রে নয়, প্রেমের সম্পর্কেও দেখা দিতে পারে রেবেকা সিনড্রম। প্রেমিকের আগের প্রেমিকার সঙ্গে বর্তমান সঙ্গিনীর তুলনা থেকে জন্ম নিতেই পারে রেট্রোঅ্যাক্টিভ জেলাসি। বাস্তবে এমন ঘটনা আদৌ বিরল নয়; বরং এ ধরনের সমস্যায় প্রায়ই পড়তে দেখা যায় পুরুষ ও নারী উভয়কেই।

রেবেকা সিনড্রমের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে বিখ্যাত এক সহিত্যকর্মের নাম। ব্রিটিশ সাহিত্যিক দাফনে দু’ মরিয়েরের উপন্যাস ‘রেবেকা’র নামানুসারেই এই বিশেষ মনোবৃত্তিটিকে চিহ্নিত করা হয়। ১৯৩৮ সালে ‘রেবেকা’ প্রকাশিত হয়। সেই উপন্যাসের কথক চরিত্রটি একজন নারী। উপন্যাসের কোথাও তার নাম উল্লেখ না করা হলেও বোঝা যায় তার বয়স ২০ এর মতো। মাক্সিম ডে উইন্টার নামে এক ধনাঢ্য ব্যক্তির সঙ্গে স্বল্প পরিচয়ের পর তার বিয়ে হয়। বিয়ে ও মধুচন্দ্রিমার পর তিনি স্বামীর সঙ্গে তার এস্টেটে বসবাস শুরু করেন।

রেবেকা ছিল মাক্সিমের প্রথম পক্ষের স্ত্রীর নাম। কথকের সঙ্গে মাক্সিমের বিয়ের এক বছর আগে তিনি এক দুর্ঘটনায় মারা যান। মাক্সিমের এস্টেটের হাউসকিপার মিসেস ডানভার্স ক্রমাগত নববধূর সঙ্গে প্রয়াত রেবেকার তুলনা শুরু করে। প্রকাশ্যে সে মনিবের নববধূকে বিভিন্নভাবে হেনস্থাও করতে শুরু করে। বার বার মনে করিয়ে দিতে থাকে, রেবেকার সৌন্দর্যের কাছে সে কিছুই নয়।

কাহিনির কথক নারী যখন তার স্বামীর এস্টেটে কিছু পরিবর্তন আনতে চায়, তখন মিসেস ডেনভার্স তাকে জানায়, রেবেকার এস্টেট পরিচালনার সঙ্গে তার তুলনাই চলে না। ডেনভার্সের এই তুলনা কথকের আত্মবিশ্বাসকে আহত করে।

কথক ক্রমে বিশ্বাস করতে শুরু করেন যে, মাক্সিম তাকে বিয়ে করার পর প্রয়াত স্ত্রীর সঙ্গে তার তুলনা করে হতাশায় ভোগে। তার মনে হতে থাকে, রেবেকার মধ্যে যে সৌন্দর্য, আকর্ষণীশক্তি এবং পরিশীলন ছিল, তা তার মধ্যে নেই। এবং ক্রমশ প্রয়াত রেবেকার সঙ্গে নিজের তুলনা করে যেতে যেতে তিনি প্রায় মনোবিকারগ্রস্ত হয়ে পড়েন।

মরিয়েরের উপন্যাস এর পর রহস্যকাহিনির দিকে মোড় নেয়। বিভিন্ন ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্যে দিয়ে ক্রমেই উন্মোচিত হতে থাকে প্রয়াত রেবেকার প্রকৃত চরিত্র। জানা যায়, মাক্সিমের সঙ্গে রেবেকার বিয়ে আদৌ সুখের ছিল না। রেবেকাও ছিল অত্যন্ত খারাপ চরিত্রের নারী। স্বামী মাক্সিমের প্রতিও সে বিশ্বস্ত ছিল না। শেষ পর্যন্ত মাক্সিমই তাকে হত্যা করে এবং তার লাশ এক নৌকায় ভাসিয়ে দুর্ঘটনার রূপ দেয়।

আধুনিককালেও ‘রেবেকা’ তার ছায়া রেখে গিয়েছে। মনোবিদরা জানাচ্ছেন, রেবেকা সিনড্রমে ভুগতে থাকা মানুষের শুধু মন নয়, ক্ষতিগ্রস্ত হয় তাদের শরীরও। আজানা প্রতিদ্বন্দ্বীর সঙ্গে প্রতিযোগিতায় নেমে এই অসুখে ভুগতে থাকা মানুষ তার যাবতীয় সম্পর্ককেই এক সময় বিষময় বলে ভাবতে থাকেন।

রেবেকা সিনড্রমে ভুগতে থাকা ব্যক্তি এক সময়ে আত্মবিশ্বাস হারাতে শুরু করেন। এছাড়া অবসাদগ্রস্তও হয়ে পড়েন। রেবেকা সিনড্রম থেকে মুক্তির উপায় হলো- সাবেক প্রেমিকার সঙ্গে বর্তমান সঙ্গীর তুলনা না করা। সেই সঙ্গে অতীত সম্পর্কের স্মৃতির মধ্যে বাস করা থেকেও বিরত থাকতে হবে। না হলে অসতর্ক মুহূর্তেও তা বেরিয়ে এসে বর্তমান সঙ্গীকে আহত করতে পারে। এ দিক থেকে দেখলে আগে থেকে সাবধানি হওয়াই এর প্রধান ওষুধ। এক বার রেবেকা সিনড্রমে আক্রান্ত হলে তা থেকে মুক্তি পাওয়া খুব সহজ নয়।