তিথির কারণে একই দিনে দুর্গোৎসবের মহানবমী ও দশমী পূজা হয়েছে। এদিনে রাজধানীর মণ্ডপগুলোতে ভক্ত ও দর্শনার্থীর ভিড় দেখা গেছে। ঢাকের বাদ্যের সঙ্গে মন্ত্রপাঠে আনন্দময়ীকে অঞ্জলি দিচ্ছেন ভক্তরা। পূজা ও সন্ধ্যা আরতি শেষে বিদায়ের সুর বাজতে শুরু করেছে।আজ রবিবার বিদায় নেবেন দেবী দুর্গা। প্রতিমা বিসর্জনের মধ্য দিয়ে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের পাঁচ দিনের দুর্গাপূজার আনুষ্ঠানিক সমাপ্তি ঘটবে। নিরাপত্তার বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে সন্ধ্যার আগেই প্রতিমা বিসর্জনের নির্দেশনা দিয়েছে বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদ।
হিন্দু সনাতন শাস্ত্রমতে, এই নবমী তিথিতে রাবণ বধের পর রাজা শ্রী রামচন্দ্র এই পূজা করেছিলেন।নীলকণ্ঠ ফুল ও যজ্ঞের মাধ্যমে অনুষ্ঠিত হয় নবমী বিহিত পূজা। নবমী পূজার মাধ্যমে মানবকুলে সম্পদলাভ হয়। তাই শাপলা, শালুক ও বলিদানের মাধ্যমে দশভুজা দেবীর পূজা হয়েছে। নীল অপরাজিতা ফুল মহানবমী পূজার বিশেষ অনুষঙ্গ।নবমী পূজায় যজ্ঞের মাধ্যমে দেবী দুর্গার কাছে আহুতি দেওয়া হয়। ১০৮টি বেল পাতা, আম কাঠ ও ঘি দিয়ে এই যজ্ঞ করা হয়। পরদিন সকালের আগেই দশমী তিথি শেষ হওয়ায় এবার নবমীর পরই দশমী পূজা করা হয়েছে।
ঢাকেশ্বরী জাতীয় মন্দিরের পুরোহিত প্রণব চক্রবর্তী জানান, গতকাল সকাল ৬টা ১২ মিনিটের মধ্যে মহানবমীর বিহিত অধিক পূজা শেষ হয়। এরপর বিজয়া দশমীতে ‘বিহিত পূজা’ ও পরে ‘দর্পণ বিসর্জনের’ মধ্য দিয়ে দুর্গাপূজার শাস্ত্রীয় সমাপ্তি ঘটেছে।দশমী পূজায় প্রতিমার হাতে জরা, পান, শাপলা ডালা দিয়ে আরাধনা করা হয়। পূজার আনুষ্ঠানিকতা শেষে সিঁদুর খেলায় মেতে ওঠেন ভক্তরা। সন্ধ্যায় আরতি শেষে দেবীর বন্দনায় প্রতিটি পূজামণ্ডপে বিষাদের সুর বাজতে শুরু করেছে।
আজ প্রতিমা বিসর্জনের আগে ঢাকেশ্বরী জাতীয় মন্দির থেকে শোভাযাত্রা বের করা হবে, যা রাজধানীর বিভিন্ন সড়ক ঘুরে সদরঘাটে গিয়ে শেষ হবে।
গতকাল বিকেলে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ঢাকেশ্বরী মন্দির পরিদর্শন করেন। প্রধান উপদেষ্টার এই কর্মসূচি ঘিরে মন্দির প্রাঙ্গণে নিরাপত্তা বাড়ানো হয়।
বিজয়া দশমী উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন ও প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস পৃথক বাণী দিয়েছেন। এ ছাড়া বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সংগঠনের নেতারা হিন্দু সম্প্রদায়কে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন। আজ দুর্গোৎসব উপলক্ষে সরকারি ছুটি। গত বৃহস্পতিবার সাধারণ ছুটি ঘোষণা করায় এবার পূজায় সবাই টানা চার দিন ছুটি পেয়েছে।
রাজধানীর বেশ কয়েকটি মণ্ডপ ঘুরে দেখা যায়, ধর্মীয় রীতি অনুযায়ী বিভিন্ন আয়োজনের মাধ্যমে উত্সবমুখর পরিবেশে পূজা উদযাপন করছেন সনাতন ধর্মাবলম্বীরা। মণ্ডপগুলোতে সকাল থেকে মানুষের আগমন দেখা যায়, যা বিকেলের দিকে ভিড়ে পরিণত হয়। বিশেষ করে মা-বাবার সঙ্গে শিশুদের উপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মতো।
মহালয়ার মধ্য দিয়ে গত ২ অক্টোবর এবারের দুর্গোৎসবের ক্ষণ গণনা শুরু হয়। ওই দিন থেকে দুর্গোত্সবের আনুষ্ঠানিকতার সূচনা। এরপর গত বুধবার ষষ্ঠী থেকে পাঁচ দিনের যে দুর্গোৎসব শুরু হয়েছিল, আজ প্রতিমা বিসর্জনের মধ্য দিয়ে শেষ হবে এ আয়োজন।
শেরপুরে কার্টনের কাগজে তৈরি হয়েছে প্রতিমা
শেরপুর প্রতিনিধি জানান, পরিত্যক্ত বাক্স আর কার্টনের কাগজে তৈরি পরিবেশবান্ধব প্রতিমায় চলছে অর্ধশত বছরের ঐতিহ্যবাহী শেরপুর মার্চেন্ট ক্লাবের শারদীয় দুর্গোৎসব। শহরের কালীরবাজার মা ভবতারা কালীমন্দির চত্বরে স্থাপিত এ পূজামণ্ডপটি মহাসপ্তমীর দিন থেকে সবার আগ্রহের বিষয়ে পরিণত হয়েছে। পুণ্যার্থী ও সাধারণ মানুষ পূজামণ্ডপটি একনজর দেখার জন্য কালীমন্দিরে ভিড় করছেন।
এক আঙিনায় মসজিদ-মন্দির
টাঙ্গাইল প্রতিনিধি জানান, একই আঙিনায় রয়েছে মসজিদ ও মন্দির। সেখানে ৫২ বছর ধরে পাশাপাশি চলছে আজান-নামাজ ও পূজা অর্চনা। হিন্দু-মুসলিম সম্প্রীতির এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত এটা।
টাঙ্গাইলের নাগরপুর উপজেলা সদরের চৌধুরীবাড়ির আঙিনার এই পরিবেশ অসাম্প্রদায়িকতার নজির সৃষ্টি করেছে।
এখানে প্রতিবছরের মতো এবারও হচ্ছে শারদীয় দুর্গাপূজা। পাশের মসজিদের আজান ও নামাজের সময় বন্ধ থাকছে ঢাক-ঢোলের বাজনা। উভয় ধর্মের লোকজন নিজ নিজ ধর্মীয় আচার নিয়ম পালন করছেন। কোনো সমস্যা হচ্ছে না।
শত বছর ধরে পাশাপাশি মসজিদ-মন্দির
জামালপুর সংবাদদাতা জানান, জামালপুরের মেলান্দহ উপজেলার পৌর শহরে মসজিদ, মাদরাসা, মন্দির ও মাজার পাশাপাশি। আজান শুনে এলাকার মুসল্লিরা নামাজ আদায় করতে আসেন মসজিদে। হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের পূজা-অর্চনা চলে পাশের মন্দিরে। প্রায় ১০০ বছর ধরে ধর্মীয় অনুষ্ঠান পালন নিয়ে কখনো বিরোধ হয়নি, বরং সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির সাক্ষী হয়ে পাশাপাশি আছে মসজিদ, মাদরাসা, মন্দির ও মাজার। মতবিরোধ ছাড়াই যুগ যুগ ধরে ধর্মীয় আচার পালন করে আসছেন দুই সম্প্রদায়ের স্থানীয় ধর্মপ্রাণ মানুষ।