বন্যায় পানি কমতেই ভেসে উঠেছে ক্ষতচিহ্ন

ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢল ও হাওড়া বাঁধ ভেঙে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া উপজেলার ৩টি ইউনিয়নে অন্তত ৪০টি গ্রাম প্লাবিত হয়। উপজেলায় সৃষ্ট আকষ্মিক বন্যা পরিস্থিতি অনেক উন্নতি হয়েছে। বেশিরভাগ জায়গা থেকে পানি নেমে গেছে। আর এখন জেগে উঠছে আকষ্মিক বন্যার ক্ষতচিহ্ন।

বন্যায় অসংখ্য কাঁচা, আধাপাকা ঘরবাড়ি, ফসলি জমি, মাছ, রাস্তাঘাট, কালভার্ট ব্যাপক ক্ষতি হয়। পানি জমে থাকায় গোখাদ্যের সংকট দেখা দিয়েছে বিভিন্ন গ্রামে। বন্যাদুর্গত এলাকায় অব্যাহত রয়েছে ত্রাণ বিরতণ কার্যক্রম। এদিকে উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় বন্যায় বাড়িঘর ভেঙে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া অনেকে মানবেতর জীবন যাপন করছেন। তারা আপন ভিটায় ফিরে যেতে চাইলেও টাকা পয়সার না থাকায় ঘর তৈরি বা মেরামত করতে পারছেন না। তবে সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন খাত থেকে ত্রাণ পেলেও ঘর বানানোর কোনো সাহায্য না পাওয়ায় বিপাকে পড়েছেন নিম্ন আয়ের মানুষ। এরইমধ্যে বন্যার পানি সরে গেলও ঘরহীন অনেক লোক এখনো আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে বসবাস করছেন।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, গত মঙ্গলবার ভারী বর্ষণ, ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢল ও হাওড়া বাঁধ ভেঙে আখাউড়া-আগরতলা সড়কের দুপাশের কালিকাপুর, বীরচন্দ্রপুর, আবদুল্লাহপুর, বঙ্গেরচর, রহিমপুর , সাহেবনগর ও মোগড়া এলাকায় হাওড়া বাঁধ ভেঙে বাউতলা, উমেদপুর, নীলাখাত, নয়াদিল, টানোয়াপাড়া, নোয়াপাড়া, নুনাসার, বচিয়ারা, ধাতুর পহেলা,কুসুম বাড়ি, আদমপুর সহ অন্তত ৪০টি গ্রাম প্লাবিত হয়। এতে ওইসব গ্রামের অনেক বাড়িঘর, রাস্তাঘাট, ফসলি জমি, ছোট বড় অসংখ্য পুকুর পানিতে তলিয়ে যায়। সরেজমিন উপজেলার রাজেন্দ্রপুর, খলাপাড়াসহ বেশ কয়েকটি গ্রামে গিয়ে দেখা যায় অনেক লোকজন বন্যায় তাদের ঘর হারিয়ে খোলা আকাশের নিচে বসে আছেন। গত কয়েক দিন ধরে সকাল বিকাল ক্ষতচিহ্নময় শূন্য বসতভিটার দিকে ফেলফেল করে তাকিয়ে থাকছেন।

এদিকে আত্মীয়স্বজনরা এসে তাদের সান্তনা দিলে তাতে দুশ্চিন্তা আরো বাড়ছে। একাধিক লোকজন জানায়, বন্যায় আমাদের সবকিছু তছনছ করে ফেলেছে। বাড়িঘরের কোনো চিহ্নও নেই। পড়ার কাপড় ছাড়া অন্য কিছু নেই। উপজেলার খলাপাড়া গ্রামের মো. সেলিম ভূঁইয়া বলেন, গত বুধবার দিন রাতে বাড়ির পাশে হাওড়া নদীর বাঁধের ওপর পানি ওঠায় আমরা কয়জন মিলে সেখানে কাজ করতে ছিলাম। হঠাৎ পানির স্রোত বৃদ্ধি পেয়ে বাঁধ ভেঙে যায়।

এক পর্যায় দেখি আমার ঘরে পানি উঠছে। মুহূর্তের মধ্যে পানির তোড়ে আমার ২ টি ঘর ভেসে নিয়ে যায়। চোখের সামনে আমার সবকিছু শেষ হয়ে গেছে। তিনি আরো বলেন, সারা জীবনের সব সঞ্চয় দিয়ে আধাপাকা ঘর তৈরি করেছিলাম। বুকভরা স্বপ্ন ছিল নিজ ঘরের মধ্যে সুন্দর ভাবে থাকবো।

কিন্তু বানের জলে আমার সব স্বপ্ন ভাসিয়ে নিয়ে গেছে। বর্তমানে স্ত্রী দুই ছেলে ও তিন মেয়ে নিয়ে এক প্রতিবেশীর বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছি। আমার কোনো টাকা পয়সা নেই। এখন কীভাবে নতুন করে ঘর নির্মাণ করব তা বুঝতে পারছি না। একই গ্রামের মো. আব্দুর রউফ ভূঁইয়া বলেন, আমার দুটি ঘর হাওড়া নদীর বাঁধ ভেঙে মুহূর্তের মধ্যে পানির তীব্র স্রোতে ভাসিয়ে নিয়ে যায়। ঘর থেকে মালামাল কিছুই আনতে পারেনি।

এরপর থেকে এক আত্মীয়ের বাড়িতে থাকছি। তবে সরকারি-বেসরকারি ও বিভিন্ন খাত থেকে ত্রাণ পেলেও ঘর মেরামতের জন্য সাহায্য পাননি। তিনি বলেন, একটি ঘর মেরামত করতে অনেক টাকার প্রয়োজন। আব্দুল্লাহপুর গ্রামের জামিলা বেগম বলেন, আমাদের একটি টিনের ঘর ও একটি মাটির ঘর ছিল।

বন্যায় বাড়িতে কোমরসমান পানি উঠে। কোন উপায় না পেয়ে সন্তান নিয়ে আশ্রয় কেন্দ্রে উঠি। এরইমধ্যে মাটির ঘরটি ভেঙে পড়ে যায়। অভাব অনটনের সংসার হওয়ায় কি ভাবে ঘর তৈরি করব তা বুঝতে পারছি না। তিনি আরো বলেন, মানুষ আমাদেরকে শুধু ত্রাণ সামগ্রি দিয়ে যাচ্ছেন।

কিন্তু ঘর নির্মাণে কেউ সহযোগিতা করছে না। মোগড়া ইউপি চেয়ারম্যান মো. আব্দুল মতিন বলেন, বন্যায় এই ইউনিয়নে কয়টি ঘর ভাসিয়ে নিয়ে গেছে। এরইমধ্যে ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা তৈরি করা হচ্ছে। ঘর মেরামতের জন্য এখনো কোনো বরাদ্দ আসেনি। আখাউড়া উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) গাজালা পারভীন রুহি জানান, একেবারেই ঘর নেই এমন পাঁচটি পরিবারের তালিকা করা হয়েছে। তাদেরকে প্রয়োজনীয় সহায়তা দেওয়ার চিন্তা করা হচ্ছে।