পথে পথে উল্লাস

অবশেষে আন্দোলনে শেষ হাসি হাসলেন আন্দোলনকারীরা। শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করে ছোট বোন শেখ রেহানাকে নিয়ে দেশ ছেড়েছেন। কোটা সংস্কারের দাবিতে শুরু হওয়া আন্দোলনে অনেক প্রাণহানির কারণে এক মাসের মধ্যেই রূপ নেয় এক দফায়। তা ছিল শেখ হাসিনার পদত্যাগ। গতকাল সোমবার তাই হয়েছে। এক মাস ধরে শিক্ষার্থীরা রাজপথে থেকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের হামলার শিকার হয়েছেন। গতকাল যখন শেখ হাসিনা সরকারের পতন হলো, তখন গোটা দেশের জনতা ফেটে পড়ে উল্লাসে।

শেখ হাসিনার পদত্যাগ ও দেশ ছাড়ার খবর ছড়িয়ে পড়ার পরপরই রাজধানীসহ দেশের প্রায় সব জায়গায় বিজয়োল্লাস করতে দেখা যায় ছাত্র-জনতাকে। আন্দোলনকারীদের দীর্ঘদিনের রাগ ক্ষোভ বদলে গিয়ে হাসিতে পরিণত হয়। কেউ কেউ আনন্দে কাঁদতে কাঁদতে মাটিতে বসে পড়ে মোনাজাত শুরু করেন। কারও কারও গলায় শোনা গেছে আনন্দ মেশানো চিৎকার। বিক্ষোভকারীরা তাদের আনন্দে শামিল করেছেন সেনাবাহিনীকেও। রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে থাকা ট্যাংকের ওপর চড়ে আন্দোলনকারীরা সেনাসদস্যদের সঙ্গে হাত মেলায়। আন্দোলনকারীরা প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন গণভবনে ঢুকে স্লোগান ও উল্লাসের মাধ্যমে বিজয় উদযাপন করে। অনেকে বাংলাদেশের পতাকা হাতে গণভবনের মাথায় চড়ে আনন্দে চিৎকার করে। আন্দোলনকারীদের একাংশ গণভবনের যেতে দেখা যায়। শেখ হাসিনার শয়নকক্ষে ঢুকে তার বিছানায় শুয়ে পড়েও অনেককে উল্লাস করতে দেখা গেছে। সাধারণ মানুষ বলছে, এ আনন্দোল্লাসের মধ্য দিয়ে দ্বিতীয়বারের মতো স্বৈরাচারমুক্ত বাংলাদেশের স্বাধীনতা উপভোগ করল তারা।

দেশের নগর-বন্দর-পাড়া-মহল্লায়-ঘরে ঘরে চলছে উৎসবের বন্যা। রাজধানীতে উৎসবের এই দৃশ্য বর্ণনাতীত। পতনের আওয়াজ পেয়েই পঙ্গপালের মতো বেরিয়ে আসে নারী-পুরুষ-শিশু-কিশোরসহ সর্বস্তরের মানুষ। জাতীয় পতাকা উড়িয়ে, মুক্তপ্রাণের ধ্বনিতে মুখরিত ছিল রাজপথ থেকে প্রতিটি অলিগলি।

উল্লাসকারী আরও বলছে, বহুল আকাক্সিক্ষত পথ পাড়ি ও শতসহস্র প্রাণের রক্তের বিনিময়ে তাদের বিজয়োল্লাস। ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর থেকেই সারা দেশে বিরোধী মত ও মানুষের ওপর অনেকটা প্রতিশোধের পর্ব শুরু হয়। ছাত্র-জনতার মহাবিপ্লবে ধসে পড়ল শেখ হাসিনার মসনদ।

নির্বাচন বিশ্লেষক ও সাবেক সামরিক কর্মকর্তা এম সাখাওয়াত হোসেন গণমাধমে দেওয়া তাৎক্ষণিক এক প্রতিক্রিয়ায় বলেছেন, ‘দেশে যা ঘটেছে, এটাই হওয়ার কথা ছিল। গণঅভ্যুত্থান কখনো ঠেকানো যায় না। শিক্ষার্থীদের কোটা সংস্কার আন্দোলন সহজেই সমাধান করা যেত। কিন্তু শেখ হাসিনার জেদের কারণে এত মানুষ মারা গেল।’ তিনি বলেন, ‘১৫ বছর মানুষ ভোট দিতে পারেননি। দিনের পর দিন ভোটচুরি করা হয়েছে। দীর্ঘদিনের পুঞ্জীভূত ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। শেখ হাসিনার বোঝা উচিত ছিল, তিনি ও তার দল কতটা অজনপ্রিয়। এই যে এত প্রাণহানি, এর জবাব দেবে কে? দেশে সুশাসনের মারাত্মক অভাব। তিনি সুশাসন দিতে পারেননি।’

এদিকে শেখ হাসিনার পদত্যাগ ও দেশত্যাগের খবরে রাজধানীর বাইরে আনন্দ উল্লাস করেছে সাধারণ মানুষ। আমাদের প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর :

চট্টগ্রাম : চারদিকে আনন্দের জোয়ার। জাতীয় পতাকা হাতে নিয়ে চলছে খন্ড খন্ড মিছিল। সাধারণ মানুষের পাশাপাশি রাস্তায় নেমেছেন বিএনপি-জামায়াতের নেতাকর্মীরাও। মাত্র দুদিন আগে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়েছিল নগর বিএনপি অফিসে। কিন্তু গ্রেপ্তার আতঙ্কে আত্মগোপনে থাকা নেতাকর্মীরা তা দেখতেও যেতে পারেননি দুদিন। গতকাল বিকেলে নেতাকর্মীরা ছুটে যান সেখানে। এ সময় বেশ কিছু নেতাকর্মীকে দেখা যায় একে অন্যকে জড়িয়ে ধরে আনন্দের কান্না করতে।

বরিশাল : বিকেল সাড়ে ৩টার দিকে নগরে ঢল নামে সাধারণ মানুষের। সবার হাতে হাতে জাতীয় পতাকা আর প্ল্যাকার্ড। বিজয়ের এ উল্লাস সন্ধ্যার পরও ঢাকা-বরিশাল মহাসড়কসহ গোটা নগরীতে ছড়িয়ে পড়ে। বিকেলে সেনাবাহিনী প্রধানের ভাষণের পর ছাত্রদের সঙ্গে রাস্তায় নেমে আসে সাধারণ মানুষ। নগরীর চৌমাথা থেকে নথুল্লাবাদ পর্যন্ত মহাসড়ক, সদর রোড, নথুল্লাবাদ, রূপাতলীসহ বিভিন্ন এলাকায় আনন্দ মিছিল বের করে জনসাধারণ। পাশাপাশি বিভিন্ন কলেজ, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে শিক্ষার্থীরা মোমবাতি প্রজ্বালন করেন। এ ছাড়া নগরীর নথুল্লাবাদে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা আনন্দ মিছিল নিয়ে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (ববি) সামনে পৌঁছান।

কমলগঞ্জ (মৌলভীবাজার) : বেলা ৩টার দিকে উপজেলার বিভিন্ন এলাকা থেকে মিছিল নিয়ে বের হয় জনতা। মিছিল থেকে শেখ হাসিনার দেশত্যাগ নিয়ে বিভিন্ন স্লোগান দিয়ে মুখর করে তোলে পরিবেশ। আনন্দ উল্লাসে ঐক্যবদ্ধ হয়ে মাঠে নেমেছে সর্বস্তরের জনগণ।

ঠাকুরগাঁও : বিকেলে সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয় বড় মাঠ শহীদ মিনারে জড়ো হয় ছাত্র-জনতা। সেখান থেকে মিছিল বের হয়ে শহরের বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণ করে। এর আগে শহরের বিভিন্ন পাড়া-মহল্লা থেকে রাস্তায় রাস্তায় বেরিয়ে আসে হাজারো মানুষ। এ সময় শেখ হাসিনার পদত্যাগের খবরে অনেকে মিষ্টি বিতরণ করে।

সিরাজগঞ্জ : পদত্যাগ করে শেখ হাসিনার দেশত্যাগের খবরে বৃষ্টি উপেক্ষা করে পথে পথে জনস্রোত নিয়ে আনন্দ মিছিল উদযাপন করে সিরাজগঞ্জের ছাত্র-জনতা। পৌর শহরের বাজার স্টেশন এলাকায় এ আনন্দ মিছিলে অংশ নিতে সর্বস্তরের মানুষ যোগ দেয়। শহরের বিভিন্ন অলিগলি থেকে মিছিল বের হয়। মিছিলে শিক্ষার্থী, চাকরিজীবী, বিএনপি-জামায়াতে ইসলামীর নেতাকর্মী, শিশু, নারী, বয়োবৃদ্ধসহ সব বয়সী মানুষ অংশ নেয়।

খুলনা : বেলা ৩টার পর থেকে হাজার হাজার মানুষ রাজপথে নেমে আসে। নারী-পুরুষ, শিশু-কিশোর, তরুণ-তরুণী সবার হাতে ছিল লাল-সবুজের জাতীয় পতাকা। সবার গন্তব্য ছিল নগরীর শিববাড়ী চত্বর। হাজারো মানুষের গগনবিদারী স্লোগানে স্লোগানে উত্তাল ছিল গোটা নগরী। এ ছাড়া বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা নিয়ে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় (খুবি), খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (কুয়েট) ও সরকারি বিএল কলেজের হাজারো শিক্ষার্থী আনন্দ উল্লাসে মেতে ওঠেন। অনেককে মিষ্টি বিতরণ করতেও দেখা যায়।

কাপাসিয়া (গাজীপুর) : পূর্বঘোষিত কর্মসূচি অনুযায়ী বিকেল ৪টায় কাপাসিয়া বাসস্ট্যান্ড এলাকা থেকে কয়েক হাজার মানুষের মিছিল শহরের প্রধান প্রধান সড়ক প্রদক্ষিণ করে। সন্ধ্যা সাড়ে ৬টা পর্যন্ত দফায় দফায় এ আনন্দ মিছিল চলতে থাকে। এ সময় মিছিলে অংশগ্রহণকারীসহ বিভিন্ন মানুষের মধ্যে গণহারে মিষ্টি বিতরণ করতে দেখা গেছে। এ সময় কাপাসিয়ায় মিষ্টির দোকানে মিষ্টি সংকট দেখা দেয়।

নীলফামারী : খুশিতে নীলফামারী জুড়ে বিজয় মিছিল করছে সাধারণ জনগণ। সেই সঙ্গে এলাকায় সাধারণ মানুষ মিষ্টি বিতরণ করেছে। বিজয় মিছিল থেকে শেখ হাসিনার দেশত্যাগ নিয়ে বিভিন্ন স্লোগান দিয়ে মুখর করে তোলে পরিবেশ। আনন্দ উল্লাসে ঐক্যবদ্ধ হয়ে মাঠে নেমেছে সর্বস্তরের জনগণ।

লক্ষ্মীপুর : নারী-পুরুষসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার হাজার হাজার মানুষ মিছিল বের করে। পাশাপাশি চকবাজার জামে মসজিদ এলাকায় সাধারণ মানুষ মিষ্টি বিতরণ করেছে।

ফেনী : জাতীয় পতাকা হাতে লাখো মানুষ রাস্তায় বেরিয়ে আসে। বিভিন্ন পাড়া-মহল্লা থেকে খন্ড খন্ড মিছিল নিয়ে শহরের প্রধান সড়ক ট্রাংক রোডে সমবেত হয়ে বিজয় উল্লাসে মেতে ওঠে। বিজয় মিছিলে বিএনপি ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরাও অংশ নেন। হাজার হাজার ছাত্র-জনতা আনন্দ উল্লাসে ফেটে পড়ে।

পটুয়াখালী : আনন্দ মিছিল করেছে ছাত্র-জনতা। সোমবার বিকেলে পটুয়াখালী পৌর শহরের বিভিন্ন স্থান থেকে মিছিল বের হয়ে বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণ করে।

কমলগঞ্জ (মৌলভীবাজার) : বেলা ৩টার দিকে উপজেলার বিভিন্ন এলাকা থেকে মিছিল নিয়ে বের হয় জনতা। মিছিল থেকে শেখ হাসিনার দেশত্যাগ নিয়ে বিভিন্ন স্লোগান দিয়ে মুখর করে তোলে পরিবেশ। আনন্দ উল্লাসে ঐক্যবদ্ধ হয়ে মাঠে নেমেছে সর্বস্তরের জনগণ। বিজয় মিছিল থেকে উপজেলার বিভিন্ন সড়কে আওয়ামী লীগের সব ব্যানার-ফেস্টুন ভেঙে সরিয়ে ফেলা হয়। পুরো উপজেলা মোটরসাইকেল মহড়া দেয় সাধারণ জনতা।