নির্বাচনে ফেসবুক বটে অপপ্রচার চালিয়েছিল আ.লীগ

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে আওয়ামী লীগ গণমাধ্যম ও বিরোধী দলের ফেসবুক পেজে সংঘবদ্ধভাবে অপপ্রচার চালিয়েছে। এ কাজে তারা বট (বিশেষ সফটওয়্যায়) নেটওয়ার্ক ব্যবহার করেছে। গবেষণাকারী প্রতিষ্ঠান ডিজিটালি রাইটের তথ্য যাচাইয়ের উদ্যোগে ডিসমিসল্যাব প্রায় এক হাজার ৩৬৯টি ভুয়া ফেসবুক অ্যাকাউন্টের একটি নেটওয়ার্কের সন্ধান পেয়েছে।গতকাল বৃহস্পতিবার এ সংক্রান্ত একটি গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে ডিসমিল্যাব।

ডিসমিল্যাব বলছে, বট অ্যাকাউন্ট ও এর করা মন্তব্যের সংখ্যা আরও বেশি হতে পারে।
  • এক হাজার ৩৬৯ ভুয়া ফেসবুক অ্যাকাউন্ট নেটওয়ার্কের সন্ধান
  • ৭৭% প্রোফাইল নারীদের নামে
  • ২৪ শতাংশের নাম ‘আক্তার’ দিয়ে শেষ হয়েছে
  • ১৬% প্রোফাইল পুরুষদের নামে শেষ অংশ আহমেদ দিয়ে

প্রতিবেদনে বলা হয়, বিডি নিউজের ওয়েবসাইট ও ফেসবুক পেজে গত ২১ জুন ‘কালার প্রিন্টারে ছাপানো প্রতিটি পৃষ্ঠায় থাকে অদৃশ্য কোড?’ শিরোনামে প্রকাশিত খবরের নিচে ‘এবারের নির্বাচন স্বচ্ছ হবে। আগামী নির্বাচনে জনগণ স্বাধীনভাবে ভোট দিতে পারবে।

এমন একটি কমেন্ট ডিসমিল্যাবের চোখে পড়ে। নির্বাচনের প্রায় ছয় মাস পরে এসে এমন মন্তব্য কেনো? বিষয়টি যাচাই করতে গিয়ে দেখা যায়, ব্যবহারকারীরা বিএনপির সমালোচনা, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সফল ও সুষ্ঠুভাবে হওয়ার আশাবাদ, ক্ষমতাসীন সরকারের অধীনেই নির্বাচন আয়োজনের দাবিসহ নানা রাজনৈতিক বিষয় নিয়ে একের পর এক মন্তব্য করে যাচ্ছেন। কিন্তু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার এত দিন পরে কেউ এমন মন্তব্য কেন করবেন, তা-ও আবার সম্পূর্ণ অরাজনৈতিক একটি খবরে?এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে একটি বট নেটওয়ার্কের সন্ধান পায় ডিসমিসল্যাব। দেখা যায়, এই অ্যাকাউন্টগুলো বিভিন্ন পোস্টে একই মন্তব্য করেছেন, একই মন্তব্য বিভিন্ন একাউন্ট থেকে পোস্ট করা হয়েছে।

প্রোফাইলগুলো সক্রিয় হয়েছে মূলত গত বছরের জুন থেকে নভেম্বর পর্যন্ত সময়ে, নির্বাচনের আগ দিয়ে। তবে ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বর থেকে নভেম্বর পর্যন্ত সময়ে, অর্ধেক অ্যাকাউন্টই সক্রিয় হয়ে ওঠে। শুধু নভেম্বরের ২৩ থেকে ৩০ তারিখের মধ্যে প্রথমবারের মত পোস্ট করে ৩৪৪টি অ্যাকাউন্ট। এর আগে ২ থেকে ১২ সেপ্টেম্বরের মধ্যে ২৪০টি প্রোফাইল সক্রিয় হয়।বট নেটওয়ার্কের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট প্রতিটি অ্যাকাউন্টকে আলাদাভাবে বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে তাদের বেশিরভাগেরই: প্রোফাইল লক বা প্রাইভেট করা, সেগুলো সক্রিয় হয়েছে নির্বাচনের আগে, প্রোফাইল ছবি নেই অথবা চুরি করা, তাদের বন্ধুসংখ্যা খুব কম বা নেই, এবং বেশিরভাগ অ্যাকাউন্ট দুটি নির্দিষ্ট পেজকে ‘বাংলার খবর’ ও ‘আওয়ামী লীগ মিডিয়া সেল’ পেজ ফলো করে।

এই প্রোফাইলগুলোর বেশিরভাগই (৭৭%) নারীদের নামে। সেই নামেও রয়েছে অদ্ভুত মিল। যেমন নারী প্রোফাইলের ২৪ শতাংশের নাম ‘আক্তার’ (দিয়ে শেষ হয়েছে। যেমন- দিয়া আক্তার, রিয়া আক্তার, লিজা আক্তার, লিমা আক্তার, লিসা আক্তার ও মিসা আক্তার ইত্যাদি।

পুরুষদের প্রোফাইলগুলোতে একটি বড় অংশের (১৬%) শেষ নাম হিসেবে ব্যবহার হয়েছে ‘আহমেদ’। যেমন-নাঈম আহমেদ, নাদিম আহমেদ, কামিল আহমেদ, মাহিন আহমেদ ও সামির আহমেদ ইত্যাদি। যে অভিন্ন বৈশিষ্ট্য নারী-পুরুষ দুই ধরনের অ্যাকাউন্টে দেখা গেছে, সেটি হল, ৯০ শতাংশ নামই দুই শব্দের। কোথাও কোথাও বেশি কষ্ট না করে একটি নামকেই ভেঙে দুই শব্দ করা হয়েছে। যেমন-রি পা, মি না, লি জা, যু থি, লাম ইয়া, মু না, নে হা, জোস না ইত্যাদি।

দেখা গেছে, ২৪৭টি প্রোফাইল লকড অবস্থায় ছিল। বাকি ১১২২টি অ্যাকাউন্টের মধ্যে ৭০ শতাংশের ক্ষেত্রে প্রোফাইল ছবি ইন্টারনেটের অন্য কোনো জায়গা থেকে সংগ্রহ করা। অর্থাত্, ছবিগুলো অন্যের। কোথাও কোথাও একই ছবি বিভিন্ন প্রোফাইলে ব্যবহার করা হয়েছে।

ইউনিভার্সিটি অব মেরিল্যান্ডের ফিলিপ মেরিল কলেজ অব জার্নালিজম এবং ইনফরমেশন স্টাডিজের সহকারী অধ্যাপক ড. নাঈমুল হাসান বলেছেন, ‘ডিসমিসল্যাবের এই অনুসন্ধানের ফলাফল ইঙ্গিত দিচ্ছে যে এখানে কম্পিউটেশনাল টুলের ব্যবহার হয়েছে।’

গবেষণায় দেখাচ্ছে, বট নেটওয়ার্কের বিস্তার গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া এবং নির্ভুল তথ্য ব্যবস্থার ওপর গভীর প্রভাব ফেলতে পারে। জার্নাল অব ডেমোক্রেসিতে (২০১৬) উলি এবং হাওয়ার্ডের প্রকাশিত আরেকটি গবেষণা অনুযায়ী, এই ধরনের নেটওয়ার্কগুলো অন্যান্য দৃষ্টিভঙ্গিকে দমন করার পাশাপাশি নির্দিষ্ট কিছু দৃষ্টিভঙ্গিকে প্রচার করার মাধ্যমে জনসাধারণের মধ্যকার আলোচনা বা আলাপকে বিকৃত করতে পারে।