আজ বিচার বিভাগের রোডম্যাপ তুলে ধরবেন প্রধান বিচারপতি

দেশের অধস্তন আদালতের বিচারকদের উদ্দেশে আজ শনিবার অভিভাষণ দেবেন প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদ। এই অভিভাষণের মাধ্যমে দেশের বিচার বিভাগের জন্য তিনি একটি রোডম্যাপ তুলে ধরবেন।

প্রতিদিন সারাদেশের আদালতগুলোতে মামলার সংখ্যা বাড়ছে। বিচারকের অপ্রতুলতাসহ নানা কারণে তৈরি হচ্ছে মামলা জট। বিচার বিভাগের চলমান বিভিন্ন সংকট নিরসন করা গেলে বাড়বে মামলা নিষ্পত্তির হার। এর মধ্য দিয়ে বিচারপ্রার্থী জনগণের আস্থা বাড়বে বিচার বিভাগের প্রতি।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ৪০ লাখ মামলার ভারে ন্যুজ্ব বিচার বিভাগ। বিপুল সংখ্যক এই মামলা নিষ্পত্তির ভার অধস্তন আদালতের প্রায় দুই হাজার বিচারকের ওপর। শুধু বিচারক সংকটই নয়, রয়েছে এজলাসের স্বল্পতা। এজলাস ও বিচারক সংকটের কারণে স্বল্প সময়ে বিচারপ্রার্থী জনগণকে বিচার নিশ্চিত করাই বিচার বিভাগের জন্য চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। রয়েছে কোর্ট স্টাফের সংকট। এখনো অনেক আদালতে নেই স্টেনোগ্রাফার। ফলে সাক্ষ্যগ্রহণ থেকে শুরু করে রায় ও আদেশ হাতে লিখতে হচ্ছে বিচারকদের। নষ্ট হচ্ছে বিচারিক কর্মঘণ্টা। যার প্রভাব পড়ছে মামলা নিষ্পত্তির হারে।

এছাড়া নতুন আইন প্রণয়ন করা হলেও সেই আইনের অধীনে সংঘটিত অপরাধের বিচারের জন্য নতুন আদালত বা ট্রাইব্যুনাল সৃষ্টি করা হয়নি। ওইসব আইনের মামলার বিচারের ভার পড়ছে অন্য মামলার বিচারের জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত বিচারকদের উপর। ফলে নানা সংকট ও সমস্যার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে জেলা পর্যায়ের আদালত ও এর বিচারকরা। দীর্ঘদিন ধরে পুঞ্জীভূত থাকা এসব সংকট নিরসনে বারবার দাবি জানিয়ে আসছেন বিচারকরা। কিন্তু সেসব সমস্যার প্রতিকার মিলেছে খুবই কম।

এমন পরিস্থিতির মধ্যেই দেশের অধস্তন আদালতের সব পর্যায়ের বিচারকদের উদ্দেশ্যে অভিভাষণ দেবেন প্রধান বিচারপতি। ঘোষণা করবেন বিচার বিভাগের রোডম্যাপ। যেখানে উঠে আসবে নানা সমস্যা ও সমাধানের আশ্বাসসহ বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, স্বতন্ত্রীকরণ ও প্রাতিষ্ঠানিক পৃথকীকরণের বিষয়গুলো। সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণে আয়োজিত এই অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেবেন অন্তর্বর্তী সরকারের আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল ও বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশনের প্রধান আপিল বিভাগের সাবেক বিচারপতি শাহ আবু নাঈম মোমিনুর রহমান। থাকবেন আপিল ও হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতিগণ। অংশ নেবেন নিম্ন আদালতের প্রায় দুই হাজার বিচারক।

প্রসঙ্গত, বিগত সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে ২০০৭ সালের ১ নভেম্বর নির্বাহী বিভাগ থেকে পৃথক হয় বিচার বিভাগ। পৃথকীকরণের পর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে জুডিসিয়াল সার্ভিস কমিশনের মাধ্যম ৩৯৪ জন সহকারী জজ নিয়োগ করা হয়। ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ সরকার।

গত ১৬ বছরে দেশ শাসনের দায়িত্বে থাকলেও আওয়ামী লীগ বিচার বিভাগ পৃথকীকরণ সংক্রান্ত মাসদার হোসেন মামলার রায় অনুযায়ী প্রতিষ্ঠা করেনি বিচার বিভাগের জন্য পৃথক সচিবালয়। ফলে অধস্তন আদালতের বিচারকদের বদলি, পদায়ন ও পদোন্নতির নিয়ন্ত্রণ ছিল একচ্ছত্রভাবে আইন মন্ত্রণালয়ের হাতে। শুধু সুপ্রিম কোর্ট থেকে নেওয়া হতো পরামর্শ।

বিচার বিভাগের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, বিচারকদের পদায়ন, বদলি ও পদোন্নতির বিষয়টি পৃথক সচিবালয় করে সুপ্রিম কোর্টের হাতে রাখা উচিত। এটা করা সম্ভব হলে বিচারকদের বদলি, পদায়ন ও পদোন্নতি নিয়ে ভবিষ্যতে প্রশ্ন উঠার সুযোগ কম থাকবে। বিচারকরা মনে করেন, কোনো রাজনৈতিক সরকার বিচার বিভাগ পৃথকীকরণের উদ্যোগ নেয়নি। নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে বিচার বিভাগ পৃথকীকরণের রায় কার্যকর করা হয়। এখন অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ে বিচার বিভাগের পৃথক সচিবালয় প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেওয়া দরকার। শুধু পৃথক সচিবালয় প্রতিষ্ঠাই নয়, মামলা জট নিরসনে কার্যকর পন্থা বের করার সময় এসেছে বলে মনে করেন বিচারাঙ্গনের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা।

এ প্রসঙ্গে আইন কমিশন মনে করে, গত শতকের আশির দশকের শুরু হতে অনেক নতুন নতুন আইনের আওতায় নানা ধরনের আদালত সৃষ্টি করা হয়। সেই সব নতুন আদালতের দায়িত্ব বিদ্যমান বিচারকগণকেই তাদের পূর্বের বিচারিক কার্যের অতিরিক্ত হিসেবে পালন করতে হয়। ফলে বিচার কার্যের এই বাড়তি চাপ সামাল দেওয়া সম্ভব হয় না। এর ফলে একদিকে স্তূপীকৃত মামলার পরিমাণ বাড়তে থাকে। অন্যদিকে অনেক ক্ষেত্রেই ন্যায় বিচার ব্যাহত হতে থাকে। বিচার বিভাগের ওপর সাধারণ জনগণের আস্থা কমতে থাকে।

কমিশন বলছে, বর্তমানে জেলা পর্যায়ে প্রায় ৪০ লাখ মামলা জটের একমাত্র কারণ না হলেও প্রধান কারণ বিচারকের সংখ্যার অপ্রতুলতা। তার সঙ্গে যোগ হয়েছে এজলাসের সংকট। কিছু নতুন আদালত ভবন নির্মাণ শুরু হলেও প্রয়োজনের তুলনায় তা অপ্রতুল। ফলে এজলাস ও বিচারক সংকটের কারণে এই জট কোনোভাবেই সমাধান সম্ভব নয়। বরঞ্চ মামলা নিষ্পত্তির হার ক্রমাগত বৃদ্ধি পেলেও প্রতিদিনই নতুন নতুন মামলা মোকদ্দমা হচ্ছে এবং মামলার সংখ্যা আরও বাড়ছে।