আজ আন্তর্জাতিক নারী দিবস

প্রশাসনে নারীর অংশগ্রহণ বেড়েই চলছে। সব ধরনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে তারা সামনে এগিয়ে যাচ্ছেন। সরকারের নীতি সহায়তার সুবাদে নারী কর্মকর্তারা মেধা ও যোগ্যতাবলে গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করছেন। এর ফলে সহকারী কমিশনার ভূমি (এসি ল্যান্ড) থেকে সিনিয়র সচিব পর্যন্ত প্রশাসনের প্রতিটি স্তরে রয়েছে নারী কর্মকর্তাদের সরব উপস্থিতি। পাশাপাশি সশস্ত্র বাহিনী, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, রাজনৈতিক অঙ্গনে জনপ্রতিনিধি (সংসদ-সদস্য), ব্যবসায়ী উদ্যোক্তা, সাংবাদিকসহ সব পর্যায়ে নারীর অংশগ্রহণের অনুপাত ক্রমান্বয়েই বাড়ছে। এছাড়া পরিবারেও বাড়ছে আগের তুলনায় নারীর কর্তৃত্ব। সরকারি হিসাবে দেশে ১৭ দশমিক ৪ শতাংশ পরিবারের প্রধান হচ্ছেন নারী, যা ২০২১ সালে ছিল ১৬ শতাংশ।

এ অগ্রযাত্রার মধ্য দিয়ে আজ ৮ মার্চ পালিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক নারী দিবস। এবারের প্রতিপাদ্যে ‘নারীর সম-অধিকার, সমসুযোগ এগিয়ে নিতে হোক বিনিয়োগ’। দিবসটি উপলক্ষ্যে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ের প্রতিষ্ঠান ও সংগঠন বিভিন্ন কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। এ উপলক্ষ্যে মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয় শোভাযাত্রার আয়োজন করেছে। দিবসটি ঘিরে রাজনৈতিক দলগুলোও পৃথক কর্মসূচি পালন করবে।

প্রশাসনে নারীর সরব উপস্থিতি সম্পর্কে জানতে চাইলে বেশ কয়েকজন জ্যেষ্ঠ নারী কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, নারী কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আজকের এই অগ্রগতির পেছনে প্রথমে নারীর নিজ নিজর ত্যাগ, তিতিক্ষা, অধ্যবসায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। দ্বিতীয়ত, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের নানামুখী সহযোগিতা নারীকে নানা স্তরে সাফল্যের স্বীকৃতি এনে দিয়েছে। তবে এতকিছুর পরও বিদ্যমান সমাজব্যবস্থায় নারীর সামনে ঘরে-বাইরে এখনো প্রতিবন্ধকতার নানা দেওয়াল দাঁড়িয়ে রয়েছে।

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের হিসাব অনুসারে, বর্তমানে প্রশাসনের শীর্ষ পদে ১০ জন সচিব দক্ষতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করছেন। ময়মনসিংহ বিভাগের বিভাগীয় কমিশনার উম্মে সালমা তানজিয়া। তাই নারী এখন শুধু ডিসি হিসাবে নন, বিভাগীয় কমিশনারের দায়িত্বও পালন করছেন। অর্থ মন্ত্রণালয়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ পদে সিনিয়র সচিবের দায়িত্ব পালন শেষে সম্প্রতি অবসরে যান ফাতিমা ইয়াসমিন। বর্তমানে গ্রেড-১ পদে (সচিব) কর্মরত ৪, অতিরিক্ত সচিব ৫৮, যুগ্মসচিব ১৪৬, উপসচিব ৩৯৬, ডিসি ৭, সিনিয়র সহকারী সচিব পদে ৬০০, সহকারী সচিব পদে ১৮৪ এবং এসি ল্যান্ড পদে ১২৮ নারী কর্মকর্তা কাজ করছেন।

নারী কর্মকর্তাদের সমস্যা ও সম্ভাবনা নিয়ে কথা বলার জন্য ক্যাডার নারী কর্মকর্তাদের সংগঠন বিসিএস উইমেন নেটওয়ার্কের সভাপতি পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. ফারহিন আহমেদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও কথা বলা সম্ভব হয়নি। সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (মাপ্র/অনি ও ননি) সায়লা ফারজানা যুগান্তরকে বলেন, গঠনতন্ত্র এবং সংগঠনের সাধারণ সভার সিদ্ধান্ত অনুসারে আমি বলতে পারি না। আমাকে নারী বিষয়ে কথা বলতে বারণ করা হয়েছে, যা বলার সভাপতি বলবেন।

নারী কর্মকর্তাদের অনেকেই যুগান্তরকে বলেন, গত কয়েক বছর মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষা, মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার ফলাফলেও মেয়েরা ধারাবাহিকভাবে এগিয়ে আছে। বর্তমানে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক শিরীণ আখতার এবং জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. সাদেকা হালিম ভাইস চ্যান্সেলরের (ভিসি) দায়িত্ব পালন করছেন। অর্থাৎ রাষ্ট্রের সব ক্ষেত্রে দায়িত্বে নারীর সরব উপস্থিতি নারীজাগরণের নমুনা। মেধা ও মননে মেয়েরা অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে এখন অনেক এগিয়ে। তবে এখনো নারীর জন্য শতভাগ নিরাপদ কর্মপরিবেশ ও সমাজ তৈরি করা সম্ভব হয়নি।

তারা যুগান্তরকে আরও বলেন, এখনো অনেক ক্ষেত্রে নারীরা সহকর্মীদের বিকৃত আচরণের শিকার হন। এ ধরনের ঘটনা আগের চেয়ে উল্লেখযোগ্য হারে কমলেও শতভাগ কমেনি। সমাজে তো কিছু বিকৃত মানুষ থাকবেই। পারিবারিক শিক্ষার অভাবেই এ ধরনের ঘটনার সূত্রপাত বলে মনে করছেন তারা। এসি ল্যান্ড ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ছিলেন এমন একাধিক নারী কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, বর্তমান পদ থেকে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলার অনুমতি নেই। তবে এখনো অনেক বিষয় আছে, যা সামনে আসছে না। নারীর প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণগুলো সচেতনভাবেই করা হয়। যেমন, পোস্টিংয়ের ক্ষেত্রে এখনো নারী কর্মকর্তারা বৈষম্যে শিকার হন।

তারা আরও জানান, শুধু প্রশাসন ক্যাডার নিয়ে লিখলে তো দেশ ও সমাজের বাস্তব চিত্র পাওয়া যাবে না। আরও যেসব ক্যাডার রয়েছে, সেগুলোয়ও খোঁজ নিন। নন ক্যাডার পদগুলোর নারীরা কেমন আছেন, তাদের সমস্যাগুলো লেখেন। এর বাইরে প্রাইমারি, হাইস্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে খোঁজ নিন। অনেক কিছু বেরিয়ে আসবে।

সাবেক ডিসি এবং বর্তমান মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের যুগ্মসচিব আনার কলি মাহবুব যুগান্তরকে বলেন, ব্যক্তিগতভাবে আমি চাকরিজীবনের সব ক্ষেত্রে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, সহকর্মী এবং অধীনস্থ সহকর্মীর কাছ থেকে সহযোগিতা পেয়েছি। মা, বাবা আমাকে লেখাপড়া এবং বিসিএস পরীক্ষায় অংশ নিয়ে চাকরিতে যোগদানের ক্ষেত্রে সার্বিক সহযোগিতা করেছেন, প্রেরণা দিয়েছেন। স্বামী এবং আমার সন্তান আমার জন্য যে ত্যাগ করেছে, তা কোনোভাবেই অস্বীকার করা যাবে না। তাদের সমর্থন ও সহযোগিতা না পেলে হয়তো আমার আজকের অবস্থান তৈরি হতো না।

পরিবারের বাইরে আমার বস এবং সহকর্মীরা আমাকে সার্বিক সহযোগিতা করেছেন এবং করছেন। আগের চেয়ে সমাজ সচেতনতা বেড়েছে এবং শিক্ষার হার বৃদ্ধি পাওয়ায় মানুষের মানসিকতার পরিবর্তন হয়েছে। হয়তো সব সমস্যা সমাধান হয়ে গেছে-এমনটা বলা যাবে না। তবে আগের চেয়ে অনেক পরিবর্তন হয়েছে।

বিসিএস উইমেন নেটওয়ার্কের একজন সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে যুগান্তরকে বলেন, সংগঠনের পক্ষ থেকে প্রশাসনের অভ্যন্তরে নারী কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ক্ষেত্রে কোথাও কোনো প্রকার হয়রানি কিংবা নাজেহালের অভিযোগ পেলে সে বিষয়ে তাৎক্ষণিকভাবে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হয়। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে সমস্যা সমাধানের উদ্যোগ নেওয়া হয়। সহকর্মীদের কেউ ইভটিজিং করলে তাকে সতর্ক করাসহ প্রয়োজনে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিশ্চিত করা হয়। পোস্টিং নিয়েও অনেক সময় নারী কর্মকর্তাদের নানা রকম বিড়ম্বনায় পড়তে হয়। এরকম অনেক অভিযোগ সংগঠনের পক্ষ থেকে আমলে নিয়ে সুরাহা করা হয়েছে।

নারী দিবসে বিভিন্ন কর্মসূচি : দিবসটি উপলক্ষ্যে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি দিনব্যাপী নানা কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। এর মধ্যে রয়েছে-সকাল ৯টায় ডিআরইউ চত্বর থেকে শোভাযাত্রা, কেক কাটা কর্মসূচি পালন করবে। অ্যাসোসিয়েশন অব ডেভেলপমেন্ট এজেন্সিজ ইন বাংলাদেশ, বাংলাদেশ নারী সাংবাদিক কেন্দ্র এবং বাংলাদেশ মানবাধিকার সাংবাদিক ফোরাম শোভাযাত্রা ও আলোচনাসভার আয়োজন করেছে। এ উপলক্ষ্যে জাতীয় প্রেস ক্লাব বিশেষ আলোচনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে। শনিবার জাতীয় প্রেস ক্লাবের জহুর হোসেন চৌধুরী হলে আলোচনাসভা অনুষ্ঠিত হবে। এদিকে নারী দিবস উপলক্ষ্যে বৃহস্পতিবার রাজধানীর মহাখালীর ইউনিভার্সেল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে (সাবেক-আয়েশা মেমোরিয়াল হাসপাতাল) ‘ফ্রি উইমেন হেলথ ডে’ মেডিকেল সেবা দেওয়া হয়েছে। সকাল ৯টা থেকে সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত নারীদের বিনামূল্যে বিশেষজ্ঞ স্বাস্থ্যসেবা দেন বিশেষজ্ঞরা। আন্তর্জাতিক নারী দিবস উপলক্ষ্যে এক বাণীতে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বাংলাদেশসহ বিশ্বের সব নারীর সুখী-সমৃদ্ধ ও সম্মানজনক জীবন কামনা করেছেন। একই সঙ্গে তিনি নারী সমাজের প্রতি গুরুত্বারোপসহ তাদের সার্বিক উন্নয়নে সবাইকে আন্তরিকভাবে কাজ করার উদাত্ত আহ্বান জানান।

প্রসঙ্গত, ১৮৫৭ সালে শিল্পকারখানায় কর্মজীবী নারীদের শ্রম সময় কমানো, মানবিক আচরণবিধি প্রয়োগ, শ্রম মজুরির বৈষম্য দূরীকরণসহ নানা দাবিকে কেন্দ্র করে নারী শ্রমিকরা রাজপথে নেমে আসেন। নিউইয়র্কের সুতা কারখানার অসংখ্য নারী শ্রমিক এ আন্দোলনের সূচনা করেন। ১৯০৮ সালের ৮ মার্চ নিউইয়র্কের সোশ্যাল ডেমোক্রেট নারী সংগঠনের পক্ষ থেকে বিরাট সমাবেশের আয়োজন করা হয়। এতে জার্মানির সমাজতান্ত্রিক ও রাজনৈতিক কর্মী ক্লারা জেটকিন নেতৃত্ব দেন। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯১০ সালে ডেনমার্কের কোপেনহেগেনে দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক নারী সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এ সমাবেশে সারা বিশ্ব থেকে প্রায় ১০০ জন নারীনেত্রী অংশ নেয়। ৮ মার্চকে আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসাবে ঘোষণা দেওয়ার দাবি জানানো হয়। ১৯১১ সালের ৮ মার্চ নারীদের সম-অধিকার দিবস পালন করা হয়।